০৬ মে ২০১২, সোমবার, ০৪:১২:০৪ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্বের লড়াই
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৮-২০২৩
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্বের লড়াই


বাংলাদেশের রাজনীতির রং দ্রুত বদলাচ্ছে। কখনও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা টেনশন, কখনও বিরোধী দলের উচ্ছ্বাস আবার কখনও তাদের দুশ্চিন্তা। রাজনীতির পরিবেশটা এখন এমনই। সাধারণ মানুষও বুঝতে চেষ্টা করছে ঘটনাটা কী। কোন পরাশক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিদের একচ্ছত্র প্রধান্য বিস্তার করবে। কার ইশরায় সব সমস্যার সমাধান। 

বলার অপেক্ষা রাখে না এসবই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নেয়ার সাংবিধানিক সুবিধা নেবে। কিন্তু এ নির্বাচন ঘিরে শুধু সাধারণ মানুষের আশা নিরাশাই নয় যুক্ত হয়েছে বিদেশী বন্ধু প্রতীম দেশসমূহের স্বার্থেরও একটা আশায় বিষয়। আপাতত সমস্যা এখানেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির কলকাঠি যুগ যুগ ধরেই বিদেশীরা নাড়াচাড়া করতেন। সেটা অনেকটাই আড়ালে আবডালে। পেছনের সারিতে থেকে। এবার আর সেটা থাকছে না। প্রকাশ্যেই মানুষ দেখছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এক দেশ এক দলকে অন্যদেশ অন্য দলকে সমার্থন করতে শুরু করেছে। এ প্রতিযোগিতায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা সম্মিলিত জোট, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া। ভারত কোন পক্ষে এ নিয়ে রাজ্যের ধোয়াশা। কেউ কেউ ধারণা করছেন তারা মার্কিনীদের সঙ্গে, আবার কেউ বলছেন তারা প্রকারান্তে রাশিয়া- চীন যা চায় সেটাতেই সমার্থন দিচ্ছে। কেননা বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে যে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফরে আসছেন রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশে তিনি এমন এক মুহূর্তে আসছেন, যখন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোট অনেক দেনদরবার করছেন। এমনি মুহূর্তে তিনি ঢাকায় এসে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তাদের মনভাব ব্যক্ত করবেন কি না সেটা নিছের এখন আলোচনা হচ্ছে। তবে তার সফর না হওয়া ও কী বৈঠক হবে না হবে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধারণা করা যাচ্ছে না।  

এদিকে ভারতের এ ধোয়াশা ভাবটাই সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা চাঙ্গা ভাব দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এর সূচনা ক’দিন আগে সে দেশের তিনটি পত্রিকায় একই স্টাইলের তিন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। আনন্দবাজার, দ্যা টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া অবশ্য একই মিডিয়া হাউজের। বাকিটা হলো দ্যা হিন্দু। এখানে যে বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছে সেটার সারমর্ম হলো- বাংলাদেশে হাসিনা সরকারকে সরানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা কিছু উদ্যোগ (ভিসানীতি, শ্যাংসন) নিয়েছে। এগুলো ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে মঙ্গল হতো। কারণ ওই নীতির কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে বিএনপি জামাতের উত্থান ঘটবে। ইসলামী মৌলবাদীর উত্থান ঘটবে। যা অত্র অঞ্চলে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য যা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। 

অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ভোট মার্কিনীদের মতো ভারতও চায়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান দুর্বল হোক এটা করা যাবে না। এ ব্যাপারে ভারত ও মার্কিনী নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। অতি সম্প্রতি এ ব্যাপারে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট ও অতিরিক্ত চীনমুখী হওয়া থেকে বিরত হওয়া, এ অঞ্চলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে আরো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মত কাজগুলো যাতে হাসিনা সরকার গ্রহণ করে এ ব্যাপারে তাকে নির্দেশনা প্রদান। এ খবরে চাঙ্গা ভাব ক্ষমতাসীন দলে। 

এ ছাড়া বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ করে ভারতের পত্রিকাগুলো এমন সময় এ খবর দিয়েছে, যার ক্ষাণিকটা আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ব্যাপক সন্দেহ প্রকাশ করেন। 

১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই সরব পশ্চিমা জোটের নেতৃত্বদানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত মে মাসে যুক্তরাজ্যে যখন সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তখন বিবিসি’র সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়ত তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ওই সূত্র ধরে মার্কিনী জোট বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। বিশেষ করে গত ২০১৪ ও ২০১৮ সনের নির্বাচনের তুলনা করে এবার জনগণ যাতে নিজের ভোট নিজে দিতে পারে এটাই ওই জোটের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ জন্য বার বার ওইসব দেশের প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশে সফরে আসছেন। ভিসানীতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার প্রসঙ্গে র‌্যাবের উপর শ্যাংসন। এর সবকিছুর অর্থাৎ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মূলেই অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ভোট। ঢাকায় বিভিন্ন কূটনীতিকরাও এ ব্যাপারে ব্যাপক সোচ্চার। যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য কিছুটা হলেও অস্থিরতা। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৬ আগস্ট রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক শোক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে নাম না উচ্চারণ না করে বলেন, “এদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে নির্বাচন না, এদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র না। আমাদের গণতন্ত্রের নাম দিয়ে, নির্বাচনের নাম দিয়ে, নানা নাম দিয়ে এদেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়, যাতে করে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগরের জায়গাটা ব্যবহার করতে পারে।

“এটা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা এবং দেশগুলোকে ধ্বংস করা, এটাই হচ্ছে কারও কারও উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের এত টালবাহানা। এই এলাকাটাকে নিয়ে নানাভাবে খেলার চক্রান্ত চলছে।” এসময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণতন্ত্র সুসংহত ও উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এরা বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০ বছর ধরে যেটা সংঘাত ছিল, আমি সরকার আসার পর সেখানে আমি শান্তি ফিরিয়ে আনি। সেখানে এখন নানা রকম অশান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। যেহেতু আমি জানি, আমি বুঝি, আমাকে কীভাবে ক্ষমতা থেকে সরাবে। তাদের কিছু কেনা গোলাম আছে, পদলেহনকারী আছে। তাদেরকে বসিয়ে এ জায়গাটা নিয়ে খেলবে, এটাই তাদের প্রচেষ্টা।” এ ব্যাপারে তিনি দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সতর্ক ও সজাগ থাকার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতি করে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করি না।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষ রাজনীতি করেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ব মোড়লদের তিনি যেভাবে প্রকাশ্যে ধুয়ে দেন এটা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু এটাও ঠিক, তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে অনেক কথা ঘোরপ্যাচ রেখে সোঝাসাপ্টাও বলে দেন। ১৫ আগস্টের ওই সভা অনেকটাই এমন। এ বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা দুর্বলতা চলে আসে। কারণ প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, এবং কোন কোন বিষয় ক্লিয়ার করেছেন সেটা বুঝতে বাকি ছিলনা কারোরই। কিন্তু পরক্ষণে ভারতের ওই তিন পত্রিকার রিপোর্টে আবারও কিছুটা চাঙ্গা হয়ে গেছেন নেতাকর্মী। 

ঢাকায় আসছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

সেপ্টেম্বরে শুরুর দিকে দুই দিনের সফরে ঢাকা আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র মিডিয়ায় এ তথ্য নিশ্চিত করে। আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন লাভরভ। এর আগে আগে ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর তার ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে।

গত বছরের এপ্রিলে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। ওই সময় থেকেই তার বাংলাদেশ সফর নিয়ে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে রাশিয়া। ঢাকায় রাশিয়া দূতাবাস নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক পর্যায়ে এ সফর নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। জানা গেছে, লাভরভ ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। দুই দেশের সম্পর্কের নানা বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের গুরুত্ব অনুধাবন করা গেছে। 

২৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংলাপ 

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা স্তরের আলোচনার অংশ হিসেবে বুধবার (২৩ আগস্ট) ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈঠকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ কীভাবে অবদান রাখবে, তা নিয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা চুক্তি জিসোমিয়া ও আকসা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো দুই দেশের প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, দুই দেশের ১০ম প্রতিরক্ষা সংলাপে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (এএফডি) অপারেশন ও পরিকল্পনা অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুসাইন মুহাম্মাদ মাসীহুর রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবেন সে দেশের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের কৌশলগত পরিকল্পনা ও নীতিবিষয়ক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টমাস জে জেমস। 

পরিশেষে 

এটা বাস্তব, সব দেশই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ধু প্রতীম দেশের সহযোগিতা ছাড়া দেশ এগিয়ে নেয়াও যায় না বিশেষ করে বাংলাদেশের মত দরিদ্রতম দেশের। তবে এর সঙ্গেও রয়েছে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। এ কথাগুলো আগে বলা হলেও  দ্বিধা বিভক্ত বিশ্ব মোড়লরা এখানেও এসে কর্তৃত্বে ভাগ বসাবে পরস্পরের এটা কাম্য ছিল না। কিন্তু আপাতত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। 

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই চলছে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। কারা কোথায় সংসদ সদস্য হয়েছেন সেটা নিয়ে রাজ্যের অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু এ সূত্র ধরে বিদেশী পরাশক্তি নিজেদের স্বার্থে যদি বাংলাদেশের ভূখন্ড নিয়ে কর্তৃত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় এটা দুশ্চিন্তার। তবে এসব শুধুই ধারণা থেকে। মানুষ মনে করে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের বোধদয় ঘটবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মিটিয়ে ফেললে পরাশক্তিদের আমলে নেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের পরামর্শটা না শুনলেও সমস্যা নেই। মানুষের প্রত্যাশা দেশের রাজনীতিবিদদের সে বোধদয় কবে হবে?

শেয়ার করুন