৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন


নিম্ন মধ্যবিত্ত ‘নুন আন্তে পান্তা ফুরানো’ অবস্থায়
কঠিন সময় গভীর সংকট থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৫-২০২৪
কঠিন সময় গভীর সংকট থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ


বিশ্বজুড়ে বিরাজমান বিভিন্ন সংঘাত, সংঘর্ষ থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, ভূরাজনৈতিক প্রভাবে সৃষ্ট জ্বালানি সংকট, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুশাসনের অভাবে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে ঘনীভূত সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। ডলার সংকট, ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা, সামাজিক এবং যোগাযোগমাধ্যমের অপপ্রচার রোধ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বাড়ানো, দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সতর্কতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাই এখন মুখ্য চ্যালেঞ্জ ছয় মাস না পেরোনো চতুর্থটার্মের আওয়ামী লীগ সরকারের। ধারাবাহিকভাবে পঞ্চম টার্মে ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে মোকাবিলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে এখন প্রথম প্রয়োজন দেশবাসীকে সম্পৃক্ত করে অংশীদারমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করন।

২০০৮ থেকে প্রথম যখন বর্তমান সরকার প্রথম দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে সেই সময় থেকে ২০২৪ এসে দেশের অর্থনীতি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। দেশব্যাপী সড়ক, রেল, বিমান যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে। অর্থনীতির আকার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহানগর, নগর, শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সমগ্র দেশ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। বলা যাবে না সেই উন্নয়নের সুবিধা কমবেশি কেউ ভোগ করছে না। দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে না এ কথা বলা যায়। কেউ না খেয়ে থাকছেন এটাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু একই সঙ্গে সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ায় সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। খেটে খাওয়া মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয়ের নিম্ন মধ্যবৃত্ত ‘নুন আন্তে পান্তা ফুরানো’ অবস্থায়।

কিন্তু সুশাসন এবং জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে ব্যাপক উন্নয়নের অনুষঙ্গ হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। বাংলাদেশের পরিশ্রমী কৃষক সমাজ সামান্য সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে বাম্পার ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে মাছে ভাতে সমৃদ্ধ রেখেছে। শ্রমিকরা দেশে এবং বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কিন্তু একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় অশুভ সিন্ডিকেট অবৈধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ কালো অর্থের মালিক হয়ে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। 

ব্যাংক-বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারল্য সংকট। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেনার দায়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। বিদ্যুৎ সুবিধা সারা দেশে সম্প্রসারিত হলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ধারাবাহিকভাবে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে গ্রামেগঞ্জে, শহর অঞ্চলে ছয়-আট ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সরকারপ্রধানকে বলতে হচ্ছে, গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় লোডশেডিং করে গ্রামাঞ্চলের লোডশেডিং সহনীয় করতে।

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে শঙ্কার কারণ ডলার সংকট। এটা ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করছে। খোলাবাজারে ডলারের মূল্য ভীতি ছড়াচ্ছে। চলছে অনিয়ন্ত্রিত ওঠানামা। একই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দ্রুত কমে যাওয়া। ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রফতানি ব্যাহত হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, জ্বালানি বিদ্যুতের অভাবে শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। শিল্পায়ন ব্যাহত হওয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট হচ্ছে।

সমস্যাগুলো ক্রমশ জাতীয় সংকটে পরিণত হলেও সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম বোঝাপড়া হচ্ছে না। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে একধরনের সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটগুলোর অশুভ প্রভাবে সরকারপ্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংকটের গভীরতা সম্যক উপলব্ধি না করেই নানা ধরনের বাহাস করছে সরকারি নেতৃত্ব এবং বিরোধী দলগুলো।

সুধীজন বলছেন, ব্যাঙ্ক খাতে অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যাবহার হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। ব্যাংক থেকে লোপাটকৃত পাচার করা মূলধন ফিরিয়ে আনার কোনো বাস্তবসম্মত কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে না। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে চুনোপুঁটিদের ধরা হলেও রাঘব-বোয়ালরা আছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টির পালন হচ্ছে না জবাবদিহির অভাবে। অনাগত দিনের একটা দুঃসহ অবস্থার আশঙ্কায় দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের সম্পাদিত মেগা প্রকল্পগুলো দীর্ঘসময় পরিচালনার জন্য বিজ্ঞানমনস্ক দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। এমতাবস্থায় সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ গভীর সংকটে পড়তে পারে।

বলতেই হবে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অবর্তমানে সরকারের কোনো জবাবদিহির পরিবেশ নেই। একটি কথা নির্ধিদ্বায় বলেই দেওয়া যায় যে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অথচ বর্তমান সংকটগুলো পেশাদারি মনোভাব নিয়ে সঠিক ব্যক্তিদের, সঠিক স্থানে পদায়ন করে মোকাবিলা না করা হলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। সরকারপ্রধান নিজেও বিভিন্ন সময়ে কঠিন আগামী দিনগুলোর কথা বলে, মন্ত্রিপরিষদসহ নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করেছেন।

শেয়ার করুন