১৮ জুন ২০১২, মঙ্গলবার, ০৮:০০:০৪ অপরাহ্ন


দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি বিরুদ্ধে সোচ্চারে- আ.লীগেরই প্রোটেকশান চায় ১৪ শরিকরা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৬-২০২৪
দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি বিরুদ্ধে সোচ্চারে- আ.লীগেরই প্রোটেকশান চায় ১৪ শরিকরা


আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা ক্ষমতাসীনদের লুটপাট, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করতে চায়। এএগুলো নিয়ে রাজপথে সরব থাকতে চায় শরিকরা। তবে এব্যাপারে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রটেকেশনও চায়। যেনো দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের হাতে পদে পদে হেনস্থা হতে না হয়। এসব খবর মিলেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বোধীন ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতারা সাথে কথা বলে। 


দীর্ঘদিন পর সভা

ক্ষমতা গ্রহণের পর পাঁচ মাস পর সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে কয়েকটি সমাবেশ হয় ১৪ দলের ব্যানারে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে গত ৪ ডিসেম্বর জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগি নিয়ে গত ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

বৈঠকের সাংগঠনিক কারণ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিভিন্ন কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় যে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শরিকদের মধ্যে জমে থাকা নানা ক্ষোভ কমাতে খোদ প্রধানমস্ত্রী শেখ হাসিনা এমন বৈঠক ডেকেছেন। কেননা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের আসন কমিয়েছিল আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে শরিকদেরকে ১৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হলেও ২০২৪ সালে তা কমিয়ে ৭ করা হয়েছে। সাতটি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে তিনটি করে এবং জাতীয় পার্টি-জেপিকে দেওয়া হয়েছে একটি আসন। অই সময়ে চলমান সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের তিনটি করে এবং জেপির একটি আসন ছিল। কিন্তু শেষমেষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা যে ছয়টি আসনে ছাড় পেয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট করেছে, তার চারটিতেই জয়ের মুখ দেখতে পায়নি তারা। কেবল রাশেদ খান মেনন আর রেজাউল করিম তানসেন জয়ী হয়েছেন। হেরে যাওয়া নিয়ে নিজের পরাজয়ের জন্য জাসদ সভাপতি ‘প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে’ দুষেছেন হাসানুল হক ইনু। ভোটে হারের পরদিন নিজের কর্মী ও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেছেন, “কেন প্রশাসনের এই উদ্দেশ্যমূলক নিষ্কিয়তা, সেটা পরে ভেবে দেখব আমি।” ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-২ আসনটি ১৪ দলের শরিক জাসদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাসদের দলীয় প্রতীক মশাল হলেও ইনু আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টির মুহাম্মদ ইবরাহিমকে জয়ী করার পাশাপাশি কিংস পার্টিকে নানাভাবে সহায়তার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগতে দুষেছে শরিকরা। আর এসব সাংগঠনিক ক্ষোভ বা রাগ কমাতেই বলা হয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ১৪ দলের শরিক নেতারা বৈঠকে করেছেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে এসব শরিকদের মূল্য বেড়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে। মোট কথা অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে এসব বিশ্বস্ত শরিকদের ডাক পড়েছে।

তবে শরিকদের ভিন্ন প্রস্তাব

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৪ দলের শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অন্যরকম ঘটনা ঘটে গেছে। জানা গেছে, শরিক নেতারা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সাথে ওই বৈঠকে বেশ সোচ্চার ছিল। একটি সূত্র জানায়, শরিকরা মূলত জানিয়ে দিয়েছে মাঠে তাদেরকে অনেক কথা শুনতে হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কেনো প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার নেই তা নিয়ে অনেক কানা ঘুষা সমাজে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতিহ সংসদ সদস্য হয়েও রাশেদ খান মেনন এই সময়ে বলে ফেলেন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের মতো আরও অনেক বড় রাঘববোয়াল আছে। কথা বলতে হলে তো সরকারের বিরুদ্ধে যাবে। দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বললে সরকারের বিরুদ্ধে বলতে হবে। তাদের ক্ষোভের আরো কারণ হচ্ছে দুর্নীতি আর লুটপাটে দেশের অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। এ কারণে রিজার্ভ ও ডলারের ঘাটতি দেখা গেছে। এখন আজিজ-বেনজীরের পাহাড়সম দুর্নীতির তথ্য বের হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো তৎপরতা নেই কেন? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব কথা বললে তো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। ফুসে উঠে। মাঠে নানান ধরনের বক্তব্য দেন। সামগ্রিক বিষয়ের প্রতি একটি উদাহরণ টেনে ইঙ্গিত করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে তাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসানুল হক ইনু বলেন, কয়েকদিন আগেও একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা তাকে গালাগালি করেছেন। এরপর তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, ওই নেতা থাকলে তিনি সামনের দিনে জোটের কোনো কর্মসূচিতে থাকবেন না। এর পাশাপাশি ঈদের পর তিনি কুষ্টিয়ায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন বলেও জানান। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, মিছিল-মিটিং করবেন। এতে যদি মারামারি লাগে, তাতে তিনি পরোয়া কররেন না। জানা গেছে, এসব বক্তব্য দিয়ে ১৪ দলের শরিক নেতারা বোঝাতে চান যে, মাঠে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-মন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। আর তা করতে গিয়ে যেনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হেনস্থার শিকার যেনো না হতে হয়। 

শেষ কথা

ক্ষমতা গ্রহণের পর পাঁচ মাস পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকটি আসলে একপর্যায়ে অন্যদিকই রূপ নেয়। বৈঠকটি মূলত করা হযেছিল ভূ-রাজনৈতিক কারণে। ডাক পড়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিশ্বস্ত শরিকদের। কেননা বাম উদার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এসব শরিক নেতাদের রাজনৈতিক ময়দানে বক্তৃতা বিবৃতির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে বলে ক্ষমতাসীনরা মনে করেন। এজন্য ভূ-রাজনৈতিক কূটকৈৗশল কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা জানতে চেষ্টা করেছেন বা কোনো পক্ষকে একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন। আর এব্যাপারে যেনো শরিকরাও সোচ্চার হয় সেটি চেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জানতে চেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের হাই কমান্ড যে, ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশল কিভাবে শরিকরা মোকাবেলা করবে। কিন্তু শরিকদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের কারণে আলোচনা ভিন্ন দিকেই মোড় নেয়। অর্থ্যাৎ শরিকরা এখন চায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের নিজেদের মান সম্মান ও দল বাঁচাতে। কারণ শরিকরা মনে করছে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে সরকারের পক্ষে সাফাই গাইলে জনগণের বিরাগভাজন হতে হবে। তা-ই তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই সহায়তা চায় তাদেরই বিরুদ্ধে কথা বলতে। তা না হলে জনগণের কাছে এসব শরিকরা তাদের দলের নেতাকর্মীদের কাছে বেকায়দা পড়বে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে এসব কথা বলতে গিয়ে যদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অন্য ভূমিকা নেয়, তাহলে পরিস্থিতি অন্য দিকে চলে যেতে পারে, যা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতি হবে, জোটও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য তারা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কথা বলতে তাদেরই রাজনৈতিক প্রশাসনিক প্রটেকশান চেয়েছে বলে বৈঠকের একটি সূত্র জানায়। এমনটাই জানা গেছে রাজনৈতিক মাঠ বিশ্লেষণ করে। আর একারণে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পারপরই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো ৬ জুন এক বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয় সম্প্রতি সময় সাবেক পুলিশ প্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধানের দুর্নীতি অনিয়ম ও ক্ষমতা অপব্যবহারের প্রকাশিত সংবাদসমূহ সম্পর্কে বলেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দীর্ঘদিন যাবত ধনীক গোষ্ঠীর এক ক্ষুদ্রাংশ ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা যে লুট, সম্পদবৃদ্ধি ও অর্থপাচারের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে এসব তারই ক্ষুদ্র চিত্রমাত্র। ওয়ার্কার্স পার্টির ওই বিবৃতিতে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে এই দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘বিশেষ কমিশন’ গঠনের আহ্বান জানান হয়। ধারণা করা হচ্ছে এখন থেকে ১৪ দলের শরিকরা সরকারের সমালোচনা করবে। তবে সে-ই সমালোচনা কি সত্যিই সত্যিই না সরকারি প্রটেশানে হবে বা হতে যাচ্ছে কি-না তা সামনের দিনগুলিতে বোঝা যাবে। 

শেয়ার করুন