১৮ জুন ২০১২, মঙ্গলবার, ০৮:০৫:৩৯ অপরাহ্ন


মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে কি ভারতের মন গলবে?
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৬-২০২৪
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে কি ভারতের মন গলবে? বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর


ভারতের নতুন সরকার প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আহবানের পাশাপাশি আশাবাদ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপি এখন থেকে ভারতের বিরুদ্ধে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসতে চাইছে। না-কি আর ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশলের বলির পাঠা হতে চাইছে না দলটি। 

কি বলেছে বিএনপি?

আলোচনা সভাটি ছিল গত ১০ জুন সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে। জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের উদ্যোগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে। ‘আধুনিক কৃষি, অভিন্ন নদীর পানি আগ্রাসন এবং জলবায়ু ভারসাম্যহীনতা রোধে শহিদ জিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভাকালীন সময়ের এক ফাঁকে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি একটি চিরকুট দেয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে। এটা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বীকার করে অকপটেই জানান। তিনি বলেন, ভারতের নতুন সরকার নিয়ে সাংবাদিকরা আমাদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছেন। এই সস্পর্কে আমার বলার একটাই-ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ, নিসন্দেহে আমাদের প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ। আমরা ভারতের নতুন সরকারের কাছে একটাই আশা করব যে, তার দেশে যেভাবে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে এখনো, তাদের নির্বাচন কমিশন যেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাদের বিচার বিভাগ যেভাবে কাজ করতে পারে আমরা এদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে সেই লক্ষ্যেই যুদ্ধ করেছিলাম, সেই লক্ষ্যেই আমরা এখানে কাজ করে গণতন্ত্রকে সেইভাবে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমাদের যেটা প্রত্যাশা যে, ভারতের সরকার, জনগণের যে প্রত্যাশা বাংলাদেশের মানুষের সেই প্রত্যাশাকে তারা মর্যাদা দেবেন সেভাবে তারা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবেন। অবশ্য এর পাশাপাশি তিনি ওই আলোচনা সভায় অভিন্ন নদীর হিৎসা আদায়, তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি না হওয়া এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে শেখ হাসিনা সরকারের ব্যর্থতারও সমালোচনা করেন।

কেন এমন বক্তব্য বিএনপি’র?

রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেনো এই ধরনের বক্তব্য দিলেন? এর আগে পরে কি কিছু ঘটেছে বা হয়েছে? জানা গেছে, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হয়ে যাওয়া নিয়ে বিএনপি’তে নানান কানা ঘুষা দেখা দেয়। বলা হয়ে থাকে এমন নির্বাচন নির্বিগ্নে করতে পারার পেছনে প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশটির সরাসরি হাত রয়েছে। আর এর পর আরেকটি ঘটনা ঘটে যায় বিএনপি’র ভেতরেই। দেখা গেলো বিএনপি’র একটি অংশ নির্বাচনের পর ভারত বিরোধিতায় আরো সরব হয়ে উঠে। এর আগে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। এরপর সংহতি প্রকাশ করেছেন বিএনপির একজন মুখপাত্র। এর পরই দলটির ভারত বিরোধিতার বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। এসময়ে প্রশ্ন দেখা দেয় বিএনপি কি তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবিরোধী অবস্থান নিল? দলীয়ভাবেই ভারতীয় পণ্য বর্জন প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ল? তবে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এবিষয়টি নিয়ে বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা একে পাশ কেটে যান। কিন্তু এমন বির্তক আরো জমে উঠে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি ঘটনায়। ভারতের পণ্য বর্জনের প্রতি সংহতি জানিয়ে একদল কর্মীকে নিয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাঁর গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন তিনি। তখন তাঁর সঙ্গে থাকা কর্মীরা সেই চাদর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ান। এই ঘটনা দলটির ভেতরে নানা আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তবে রুহুল কবির রিজভী এঘটনা নিয়ে যখন দলের প্রচন্ড আলোচনার ঝড় বইতে থাকে তখন কিছু বলেন। একটি গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে পরিস্কার করতে বা বাধ্য হন বক্তব্য দিয়ে। তিনি একঘটনাটি একেবারে ব্যক্তিগত মত বলে জানান ওই গণমাধ্যমে। তিনি জানান ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তিনি তার যে ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়েছেন তা তিনি নিজের চিন্তা থেকে ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলেছেন বলে তা জানিয়ে দেন। তার এমন বক্তব্যের পরও আলোচনা-সমালোচনা পিছু ছাড়েনি বিএনপি’কে। অনেকেই মনে করেন নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের দুই মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং হাছান মাহমুদ স্বীকার করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রতিক্রিয়ায় রিজভী যা করেছেন তা আসলে ক্ষমতাসীনদের ফাঁদে পা দেয়ার মতো। কারণ ক্ষমতাসীন আ.লীগ সরকার চেয়েছে বিএনপি’র ভারতের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক। উল্লেখ্য, রিজভীর এমন ঘটনার আগে আওয়ামী লীগের দুই মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং হাছান মাহমুদ অই সময়ে বলে ফেলেন যে, ভারতের সহযোগিতাতেই তাঁরা বারে বারে ক্ষমতায় এসেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মহল মনে করে এটা বিএনপি’র বিরুদ্ধে ছিল আ.লীগ সরকারের একটি রাজনৈতিক কৌশল বা ফাঁদ, যাতে দলটি’র একটি অংশ কিছু না বুঝেই পা দেয়। আর এমন ঘটনার পর বিএনপি বেকায়দা পড়ে যায় প্রভাবশালী প্রতিবেশীটির কাছে। অন্যদিকে রিজভীর এমন বক্তব্যের পর একটি সুযোগ খুঁজতে থাকে বিএনপি। কিভাবে এর থেকে সম্মানজনকভাবে বেড়িয়ে আসা যায়। আর সেকারণেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতে নতুন সরকার গঠনের পর বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যটি ছিল মোক্ষম সময়, যা দলটির পক্ষ থেকে করা হলো-এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল। তবে অনেকে মনে করেন ওইদিন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভারতের নতুন সরকারের ব্যাপারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিক্রিয়া জানতে না চাইলেও কোনো এক সময়ে অফিসিয়ালি এমন অবস্থান জানাতো বিএনপি। 

এতে কি লাভ হবে? ও শেষ কথা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। এই নিয়ে তিনি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রায় তিন মাসব্যাপী সাত দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আলোচনা এসেছে আগের দুই লোকসভায় তার দল বিজেপি ও জোট এনডিএ’র যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও দাপট ছিল। কিন্তু এবারে একেবারে বিপরীত চিত্র, কারণ লোকসভায় আগের চিত্র সে-টা নেই। কিন্তু তাতে কি? এতে কি বিএনপি’র কি লাভ হবে? নরেন্দ্র মোদি’র শাসন কি বিএনপি’র প্রতি সহানুভুতি এনে দেবে যখন তার আশে পাছে ঠিকই এ-ই ব্যক্তিরাই আছে? যারা এর আগেও ছিলেন? যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন অমিত শাহ। অন্যদিকে সে-ই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেয়েছেন রাজনাথ সিংই। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও এস জয়শঙ্কর রয়েছেন। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ এই তিন মন্ত্রণালয়ের মতো দেশটির অর্থমন্ত্রীর পদেও পরিবর্তন আসেনি। নতুন সরকারেও অর্থ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পেয়েছেন নির্মলা সীতারমণ। তা-ই অনেকের মধ্যে প্রশ্ন পারবে কি মোদির নেতৃত্বে সরকারের মন জয় করতে? যতই বলা হোক না কেনো তিনি ও তার জোট দুইবার একাই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তা পায়নি। আর একারণে নরেন্দ্র মোদি’র সহানুভুতি থাকবে বাংলাদেশের বিএনপি’র বা দলটির সাথে আন্দোলনে শরিক ব্যাপারে? কারণ বিএনপি তো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী’কে পাশ কাটিয়ে চলছে। দীঘদিন ধরে উদার বাম গণতান্ত্রিক দলগুলি সাথে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন ইসলামী দলগুলি সরাসরি বা যুগপৎ না থেকে তারাও সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এত কিছুর পরও কি পারবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্য বা অবস্থান বর্তমান ক্ষমতায় আসা মোদী সরকারের মন গলাতে? পারবে কি ভারতের মনে দাগ কেটে যাওয়া পুরানো ক্ষত সারাতে? কেননা ২০১৩ সালে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। ওই সময়ে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় প্রত্যাখ্যান করে রবি ও সোমবার সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার এই হরতাল করছিল জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে রায়ের দিন জামায়াতের সহিংসতা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনাকে গণহত্যা আখ্যায়িত করে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। আর জামায়াতের হরতালে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ওই সময়ে বাংলাদেশ সফররত ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি সে-ই সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া আজও বিএনপি’কে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। যদিও জীবনের প্রতি হুমকি থাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাননি বলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভারতের একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। তাই পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন সামনের কয়েকটি দিনেই আভাস মিলবে ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে ভারতের মনে দাগ কাটা দাগ সারছে কি-না? পরিস্কার হয়ে যাবে এমন জটিল সমীকরণে বিএনপি’র প্রতি ভারতের বর্তমান অবস্থান কি?

শেয়ার করুন