কোটা সংস্কার আন্দোলনে গোটা বাংলাদেশেই থমথমে ভাব বিরাজ করছে। দেশের প্রতিটা স্থানেই রয়েছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা। আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে রয়েছেন এদের অবস্থান। ফলে কে কোথায় কোন আন্দোলনে কেমন আছেন এ নিয়ে যেমনটা জিজ্ঞাসা, তেমনি যাদের সন্তান নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন সেই পরিবার এমনকি ওই অঞ্চলের মানুষের চলছে আহাজারি। সবে শিক্ষার্থী। ভবিষ্যত পরে রয়েছে। এমন সময়ে গুলি কিংবা সংঘর্ষে নিহত হওয়ার ঘটনা সকল বাবা মায়ের মধ্যে নাড়া দেবে এটাই স্বাভাবিক। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলমান কোটা আন্দোলনের সবচে বাজে দিনটি গেল গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার। এদিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ ও বহিরাগতদের সংঘর্ষের সঙ্গে পুলিশ যোগ দিয়ে যে তুমুল সংঘর্ষ হয় তাতে সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে ৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত তিন শতাধিক। ছাত্রলীগ এবং পুলিশের হামলায় আন্দোলন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই সরকার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। ছাত্রছাত্রীদেরহ ল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে এবং সারা বাংলাদেশে বিজেপি মোতায়েন করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের হামলায় ৬ জন ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা প্রেসক্লাবের সম্মুখে দুই বাসে অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। এর আগের দিন সহ প্রায় সারাদেশ জুড়েই জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই অচল। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এলাকাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নেমে আসেন আন্দোলনে। বিপক্ষের গ্রুপও ছিল। ফলে উত্তেজনা ছিল সর্বত্র। দুই পক্ষের আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও তার আশপাশ। আন্দোলনকারীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে।
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্ত না দেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দ্রুত হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা দেয়া হয়। এতে করে বিরাজমান এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে গেল। ১৭ জুলাই বুধবার পবিত্র আশুরা। এ উপলক্ষে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনিতেই বন্ধ ছিল। তবে এদিন (বুধবার) নিহতদের স্মরণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বাদ আছর গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলকারীদের কোনো কর্মসূচি নেই। পরবর্তি কর্মসূচিও তারা ঘোষণা করেনি।
দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশের বিভিন্নস্থানে বিজিবি মাঠে নামিয়েছে সরকার। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার বিজিবির জনসংযোগ কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক নিউজ
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ৬জন নিহত হয়েছেন। প্রায় সপ্তাহজুড়ে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলন অল্প স্বল্প হলেও মঙ্গলবার বিশ্বের বহু নাম কড়া সংবাদ মাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে নিউজ করেছে। অবশ্য গত কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলন মঙ্গলবার ব্যাপক সহিংস রূপ নেওয়ায় এ খবরের গুরুত্ব বাড়ে।
এপি, রয়টার্স ছাড়াও এছাড়া মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট ও এবিসি নিউজ, তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি, ভারতের ইকোনমিক টাইমস, সৌদি আরবের আরব নিউজ, জার্মানীর ডয়েচ ভেলে, ভয়েস অব আমেরিকা, ভারতের এনডিটিভি, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের প্রভাবশালী অন্যান্য সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের চলমান আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় খবর প্রকাশ করেছে।
এএফপি
মঙ্গলবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, শিক্ষার্থীদের সহিংস বিক্ষোভের পর দেশব্যাপী স্কুল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে ছয়জন নিহতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবারের সংঘর্ষে আরও অনেকে আহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এর আগে, সোমবার দেশজুড়ে বিক্ষোভে সহিংসতায় ৪০০ জনের বেশি আহত হন।
রয়টার্স
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে কোটা-বিরোধী সহিংস বিক্ষোভে নিহত ৫। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর নিক্ষেপ করেছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর প্রতিবাদে দেশজুড়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী মঙ্গলবার রাজপথে বিক্ষোভ করছেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন।
এপি
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করেছে। সোমবার রাতে রাজধানী ঢাকার কাছের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতায় কয়েক ডজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে।
আল জাজিরা
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, শিক্ষার্থী কোটা-বিরোধী আন্দোলনে অন্তত ৫ জন নিহত। সরকারি চাকরির জন্য কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। সোমবার বিক্ষোভে সমাবেশে শতাধিক আহতের পর মঙ্গলবার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দ্বিতীয় দিনের মতো দেশব্যাপী বিক্ষোভে যোগ দেয়।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট
বাংলাদেশে বিদ্যমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের উপর সরকার দলের ছাত্র সংগঠন ও পুলিশের হামলায় তীব্র নিন্দা জানা যুক্তরাষ্ট্র। স্টেড ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র এ তথ্য জানান দেন। এছাড়াও এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানায়।
এমনিস্টির বিবৃতি
সোমবার (১৬ জুলাই) মধ্যরাতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়া শাখার ফেসবুক পেজ থেকে এক স্ট্যাটাসে নিন্দা জানানো হয়।
ওই স্ট্যাটাসে অ্যামনেস্টি জানায়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারা দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বর্ণনাটি অতীতে অ্যামনেস্টি যে ধরনের সহিংসতার নথিভুক্ত করেছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বেসামরিক পোশাকে থাকা ব্যক্তিরা হাতুড়ি, লাঠি ও অস্ত্র দেখিয়ে বিক্ষোভে বাধা দেয় এবং বিক্ষোভকারীদের মারধর করে।
স্ট্যাটাসে আরও লেখা হয়, বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন ও নিজস্ব সংবিধানের অধীনে জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে সম্মান করতে হবে। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের আরও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।