ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশে। দেশে কোনো জরুরি অবস্থা নেই। সামরিক আইন জারি করা হয়নি। সাবেক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশান্তরী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নোবেল লরিয়েট ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে।
প্রকৃত প্রস্তাবে বিশেষ অবস্থার কারণে গঠিত এই সরকারের কার্যক্রম পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে অনুমোদন করার অত্যাবশ্যকীয়তা রয়েছে। এ সরকার স্বল্পতম সময়ে অপরিহার্য কিছু সংস্কার করে, প্রয়োজনে কনস্টিটিউশন সংশোধন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। ইতিমধ্যে সরকারকে জুডিশিয়াল ক্যু, পুলিশ অসহযোগিতা, আনসার বিদ্রোহ সামাল দিতে হয়েছে। সর্বত্রই বিভিন্ন মহল নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। দেশ চালাতে অভিজ্ঞ রাজনৈতিকদের প্রজ্ঞা লাগে। সরকারে অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে পদে পদে সংকট অনুভূত হচ্ছে।
সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী, সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে বলা যাবে না। বরং নেপথ্যে থেকে একটি রাজনৈতিক শক্তি বিদেশি মহলের সক্রিয় সমর্থনে তাদের জন্য নিরাপদ এবং সহায়ক সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার অদূরদর্শী একনায়কত্বের কারণে ঐতিহবাহী দলটি এখন কোণঠাসা। তৃণমূলে বঙ্গবন্ধু আদর্শের মানুষগুলো নিদারুণ সংকটে আছে। দলের হাল ধরে কেউ যে দলকে সংস্কার করে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনবে তেমন কেউ দৃশ্যপটে নেই। অন্তত পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরবে আশা করা অলীক কল্পনা হবে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে সরকারে দল অস্তিত্ব হারিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিচ্যুত, স্বাধীনতার মূল আদর্শ বিচ্যুত দলটি নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতারা উপেক্ষিত হয়েছে, একটি পরিবারের মানুষগুলো এবং তাদের আশ্রিত সুবিধাবাদী গোষ্ঠী যথেচ্ছাচার আর দুর্নীতি করে দল, দেশ এবং বঙ্গবন্ধু ইমেজের বিশাল ক্ষতি করেছে। ২০২৪ ছাত্র-জনতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের মূল দায়িত্ব কিছুতেই এড়াতে পারবে না পতিত সরকার, তথা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিছু সৎ দেশপ্রেমিক নেতৃত্বকে জাতির কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে দলকে পুনরায় জাগরিত করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ দলের নেতৃত্বে আসা ঠিক হবে না।
পরিবর্তনে অপর প্রধান দল বিএনপি খুব বড় কিছু অর্জন করেছে বলে মনে হয় না। এমনিতেই গত ১৬ বছরে পার্টির সংগঠন নড়বড়ে হয়ে গাছে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার নানাভাবে বিএনপিকে হেস্তনেস্ত করেছে। জনগণ ২০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত সরকারের জনবিরোধী রূপ দেখেছে। তদুপরি কিছু হঠকারী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে। দলটি ১৬ বছরে নিজেদের দলে গণতন্ত্র সৃষ্টি করতে পারেনি। বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা বৈষম্যহীন, ভেজালহীন গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে বিএনপি বর্তমান যুবসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে করার কোনো কারণ নেই। দলটি যদি নিজেদের তৃণমূল থেকে গড়ে তোলার কাজ না করে, তাহলে কিন্তু বর্তমান পরিবর্তনের ফসল ঘরে তুলতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। পার্টিপ্রধান খালেদা জিয়া বয়সের ভারে এবং নানা শারীরিক অসুস্থতার কারণে নেতৃত্বে অনেকটাই সক্ষম আছেন? আইনের দৃষ্টিতে আসামি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এসে নেতৃত্ব দেবে সন্দেহ আছে। পার্টির শীর্ষনেতৃত্বের অনেকের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নেই। আজকের তরুণ কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে অচল মুদ্রার এপিঠওপিঠ ভাবে। হয়তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সচেতন নতুন সমাজ আওয়ামী, বিএনপি কোনো দলকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। তবুও বিশাল সংগঠন নিয়ে এগোতে হলে দলকে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে অচিরেই। জনঘনিষ্ঠ পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে।
জাতীয় পার্টি খণ্ডিত এবং নেতৃত্বের সঠিক নির্দেশনার অভাবে পথভ্রষ্ট। আওয়ামী লীগের ছায়ায় থাকা আগাছার মতো দলগুলো নিষ্ক্রিয়। এদের কারোই একক দল হিসেবে বা যৌথভাবে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করার সামর্থ্য নেই।
বরং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সবচেয়ে বড় অর্জন হয়েছে আওয়ামী লীগ ছাড়া একমাত্র আদর্শিক তৃণমূলে সুসংগঠিত দল জাময়াতে ইসলামী। বিগত আন্দোলনে জামায়াতের সংগঠিত ক্যাডার বাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ সরকারের পতন ত্বরান্বিত করেছে। সেনাপ্রধানের প্রথম বক্তব্যে প্রথমেই জামায়াত প্রধানের উল্লেখ করা অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। আওয়ামী লীগ শেষ মুহূর্তে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা ওদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। সরকারের সব স্তরে সুকৌশলে জামায়াত শুভাকাক্সক্ষীরা ভালো অবস্থানে আছে। দেশ-বিদেশে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে জামায়াত এখন ভালো অবস্থানে আছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াত বিষয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্র বা তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অ্যালার্জি আছে। বর্তমান ভারতবিদ্বেষ জামায়াতের অনুকূলে যাবে সন্দেহ নেই। এখন জামায়াত যদি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে বৃহত্তর জোট গঠন করতে পারে, তাহলে জামায়াত কিন্তু সরকার গঠনের অন্যতম প্রধান বিকল্প হবে। জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের উচিত ১৯৭১-এর ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। তাহলে দলটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। জামায়াতের বিভিন্ন স্তরের কর্মিবাহিনী কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ সচেতন।
বর্তমান সরকার কিন্তু নানা সমীকরণের কারণে এখনো সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পুলিশ এখনো পূর্ণ মাত্রায় সক্রিয় নয়। আনসারদের সমস্যা সবাই বিস্ময়ে দৃষ্টিতে দেখলো। আইন-আদালত এখন নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। নানা সংকট সমাধানে এখনো ছাত্রশক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় দুর্নীতিপরায়ণ মানুষগুলো নতুন পরিচয়ে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব শুরু করেছে। এরই মধ্যে একটি মহাপ্লাবন সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো আরো তীব্রতর করেছে। একটি মাস চলে গেল। এখনো কিন্তু নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন করে সক্রিয় করা হয়নি।
অধিকাংশ অফিস-আদালতে ঢিমেতালে কাজ চলছে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক। হাসপাতালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয় না সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তি দিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু সামাল দিয়ে ছয় মাস কেন এক বছরেও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না। দেরি হলে লাভবান হবে জামায়াত এবং সরকারে প্রচ্ছন্ন প্রভাব বজায় রাখা একটি গোষ্ঠীর।
আমি লাভ-লোকসানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো না। আমি চাই রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত বাংলাদেশে সবার অধিকার সংরক্ষিত থাকুক। নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়ী দল জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ পরিচালনা করুক। জনগণ কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি/আওয়ামী লীগের অংশীদার হিসেবে জামায়াতের রাজনীতি দেখেছে। আজকের তরুণসমাজ কিন্তু সাদা-কালোর ব্যবধান জানে। আশা করি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাই অচিরে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনরায় স্থাপন কাজে সরকারকে সহায়তা করবে। সরকারের হাতে আলাদিনের জাদুর লাঠি নেই যে, রতারাতি অনেক দিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করে আলোক প্রদীপ জ্বালাবে।