১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ৬:২৩:০৯ পূর্বাহ্ন


জামায়াতের মুখে ‘কঠিন ষড়যন্ত্রের’ কথা : রহস্য কী
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১১-২০২৪
জামায়াতের মুখে ‘কঠিন ষড়যন্ত্রের’ কথা : রহস্য কী


৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেশ ফুরফুরে মোজাজ দেখিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মুখে বক্তব্য মন্তব্য সেই ফুরফুরে মেজাজেরই নমুনা পাওয়া যেতো। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দলটি বলা শুরু করেছে ‘কঠিন ষড়যন্ত্র চলছে’। মন্তব্য করছে এই বলে যে দেশে ‘নানামুখী সংকট, সংঘর্ষ, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র’। আবার বলা হচ্ছে ‘জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে’। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে হঠ্যাৎ দলের একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে কেনোই বা বলা হচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে? আবার দলটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই বা কি যড়যন্ত্রইা বা দেখছে? প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে কিসের আতঙ্কে ভুগছে জামায়াত? কিসের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে দলটি? 

কে কি বললো, বলছেন

এখন দেখা যাক জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে কে কি বলেছেন? সম্প্রতি দলটির একটি অনুষ্ঠানে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার কঠিন ষড়যন্ত্র চলছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বলেছেন, বিভক্ত জাতি কখনো রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। আগামীর বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পরামর্শ তার। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হইনি। তিনি এটাও বলেছেন, প্রথম দিন থেকেই ভারত এই সরকারকে ব্যর্থ করাতে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’

জামায়াতের নাকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়ার নেপথ্যে কি?

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই বিভিন্নভাবে জামায়াতের নামটি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় চলে আসে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই একটি বিষয় আলোচিত হতে থাকে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে। খোদ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে না বললেও বিভিন্ন দল ও ফোরামে বলাবলি করতে থাকে যে, জামায়াতে ইসলামী’কে সমর্থন করে বা তাদের সমর্থিত লোকেরা সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার করছে। এমনকি কি বিএনপি সমর্থিত ও হাতে গড়া বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের জামায়াতের লোকজন প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তুঙ্গে উঠে একটি মন্তব্য-সেটি হলো, ‘দেশ চালাচ্ছে আসলে জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা।’ জামায়াতে ইসলামী’র পক্ষে এমন প্রচার-প্রচারনায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাটে মাঠে ঘাটে একটা ফুরফুরে ভাব লক্ষ্য করা গেছে। এমন সরব অবস্থার মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নিষিদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাজগুলো এতো দ্রুত ঘটে- যা নজর কাড়ে রাজনৈতিক মহলে। উল্লেখ্য জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নিষিদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে থাকা সব ইসলামী দলগুলিকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী একটি বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টাও রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃষ্টি কাড়ে। বিষয়টি বিএনপি’র মতো বড়ো দলকেও ভাবিয়ে তুলে। আবার দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামী প্রতিবেশী ভারতের প্রতি সব ধরণের বিরোধিতা ভুলে একসাথে কাজ ও সর্ম্পক স্থাপনের গভীর ইচ্ছার বিষয়টিও নজর কাড়ে সবার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় মিডিয়ার ঢাকাস্থ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ডা. শফিকুর রহমান ভারত প্রশ্নের এক গণমাধ্যম জানান, সম্পর্ক যে একেবারে ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে আমরা আশা করি এখন ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা উদার। আশা করি ভারতও ইতিবাচক থাকবে। আরো জোড় দিয়ে বলেই ফেলেন, আমরা পরস্পর প্রতিবেশী। চাইলেই প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এটা আমরা তো বটেই কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ওই সংবাদ সম্মেলনেই অতীতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের সুসম্পর্ক ছিল দাবি করে দলটির আমীরের। কথা কথায় যে দেশটিকে শত্রু ভাবা হতো সেই ভারতে এখন বন্ধু বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে জামায়াতে ইসলামী’র এমন আগ্রহসহ আরো কয়েকটি কর্মকাণ্ডে বিএনপি’র একেবারে শীর্ষ থেকে এক পর্যায় মুখে খুলে ফেলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সকলকে সর্তক করে বলেছেন, ‘স্বৈরাচারের পতন হয়তো হয়েছে, কিন্তু ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত রয়েছে। এসময় তারেক রহমান বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল বিভ্রান্ত হয়ে কিছু কথা বলেছেন। এ জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলন চলবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন কারণ তিনি ও তার দল এমনকি সমমনারা দ্রুত একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইলেও একমাত্র জামায়াতে ইসলামী সে-সময়ে বিপরীত বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে বির্তকের পাশাপাশি সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ঝড় তুলে। উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি’র নেতারা আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে। কিন্তু জামায়াত নেতারা গুরুত্ব দেন সংস্কারে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। বিএনপির পরপরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসে জামায়াতে ইসলামী’র নেতারা সংলাপ শেষে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “আমাদের দেওয়া দু’টি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সাথে জামায়াতের অবস্থান বলা চলে মুখোমুখি অবস্থায় চলে যায়। এদিকে জামায়াতের এমন অবস্থানে বিএনপি নড়ে-চড়ে বসে। দলটি তার সাথে এতোদিন ধরে আন্দোলনে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলিও দ্রুত নির্বাচনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দাবি জানানোর পক্ষে মত দেয়। এমনকি দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ কিংবা পদত্যাগ নয়, তাকে রাখার পক্ষেও ঐক্যমত্যে পৌঁছে যায় বিএনপি ও সমমনারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের লক্ষন দেখা দেয় সার্চ কমিটি গঠনে প্রজ্ঞাপন জারির খবরের মধ্য দিয়ে। এতে করে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি হবে তা নিয়ে ধোয়াশা ধীরে ধীরে কেটে যাওয়ার আলামত পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন সব খবরে বিএনপি ও তা সমমনাদলগুলির জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি এনে দেয়। এমন পরিস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনে জামায়াতকে এক ঈর্ষণীয় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। আবার দেখা গেলো, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে থাকা সব ইসলামী দলগুলিকে নিয়ে জামায়াতের বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজন আলেমের পক্ষ থেকে খোদ জামায়াতকেই ইসলামী বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করে বক্তব্য দেয়ার পর থেকে জামায়াতকে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীত নষ্ট হচ্ছে বলে দেশে বিদেশে জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে আবারো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এদিকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জামায়াত একটি প্রতিবেশী দেশের সাথে গভীর সর্ম্পক স্থাপনে দফায় দফায় যে চেষ্টা করেছিল সম্প্রতি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাতে ছেদ পড়ে। আর এমন সব নেতিবাচক ঘটনা ও পরিস্থিতি জামায়াতকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভীষণ নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়, যা দলটির শীর্ষ নেতাদের কাছে এখন ষড়যন্ত্র বলে ঠেকছে-এমনটাই খবর দিয়েছেন রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো। 

শেয়ার করুন