১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:১৬:২৬ পূর্বাহ্ন


বিএনপি-জামায়াত লড়াইয়ে উন্মোচিত হচ্ছে মুখোশ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০১-২০২৫
বিএনপি-জামায়াত লড়াইয়ে উন্মোচিত হচ্ছে মুখোশ


বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে চলছে বিভিন্ন ইস্যুতে লড়াই দীর্ঘদিন ধরে, যা এখনো চলমান বরং বর্তমানে বেশ উত্তজনাকর অবস্থায়। তবে বর্তমানে দল দু’টির মধ্যে বিবৃতির লড়াইয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতির লড়াই রাজনৈতিক অঙ্গনে বেরিয়ে পড়ছে থলের বিড়াল, উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে কারো কারো আসল মুখোশ। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির সখ্যতা বহুদিনের। বিএনপিই বহুদলীয় রাজনীতির ধ্যানধারণা-কে লালন করে বাংলাদেশে জামায়াতকে রাজনীতি করা সুযোগ দিয়ে পুন:জন্ম দিয়েছে। এরপর থেকে দলটির সাথে বিএনপি’র বিভিন্ন সময়ে কখনো পাশাপাশি আবার অনেক সময়ে জোট হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। তবে শেখ হাসিনার শাসনের শেষদিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এসময় এমনও শোনা যায় যে, জামায়াতের একটি অংশ আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে গোপনে যোগাযোগ বজায় রেখে নির্বাচনে যেতে দরকষাকষিতে লিপ্ত ছিল। এর আগেও নানা বিষয়ে টানাপোড়েন চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। তবে অতটা জোরালো মতভেদ না। কিন্তু বর্তমানে বিশেষ করে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর থেকে মতভেদ তুঙ্গে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এটি আরও মারমুখীতে রূপ নিয়েছে। অতি সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয় বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের পর নির্বাচন করা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। এর পর একে একে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন নিয়েও মতপার্থক্য প্রকট আকার ধারণ করে। এমন বির্তক বা প্রতিক্রিয়া যে কেবল মাঠ তৃনমূলের নেতাদের মধ্যে ছিল তা-ই না, দেখা যায় বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে চলে গেছে। বলা যায় হাই কমান্ড লেবেলে। 

ফখরুল সংলাপে একাত্তর টেনে আনলেন কেনো?

বিএনপি’র সাথে বক্ততা বিবৃতির লড়াই শুধু যে কেবল হঠাৎ করে শুরু হয়েছে তা নয়। গত ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরে খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করা হয়। এর আয়োজনের পেছনে অনেক রহস্য দেখছেন অনেকে। এই ধরনের একটি সংলাপে ৭১’কে ভুলে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তিনি কেনো এত্তো কিছু কথা থাকতে এমন প্রসঙ্কটি টেনে আনলেন কেনো? তা-র মেন কোনো সন্দেহ থেকে এমন মন্তব্য করা হলো? আবার এর আগে মীর্জা ফখরুল এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সাথে বিএনপি’কে ট্যাগ না করার আহবান জানান। 

এরপর রিজভী যা বললেন 

একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত রির্পোটে দেখা যায়, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তাদের এক সময়ের জোট সঙ্গী জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে অত্যন্ত কঠোর মন্তব্য করেছেন। অবশ্য তিনি জামায়াতের নাম নেননি। রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেছেন, আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে আপনারা সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। আজকে বড় বড় কথা বলেন। কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেন বিএনপির নামে। জেলায় জেলায় টার্মিনাল দখল, সিএনজি স্ট্যান্ড দখল, টেন্ডার ভাগাভাগির মধ্যে কি আপনাদের লোকরা জড়িত নয়?

ইসলামী ব্যাংক দখল?

বক্তব্য রাখতে গিয়ে রিজভী বলেন, আমরা তো প্রথমেই দেখলাম ৫ আগস্টের পরদিনই ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে, এটি কি জনগণ দেখেনি? এটা তো দেখেছে জনগণ। আমরা হাসিনা আমলে দেখেছি চাপাতি লীগ, হেলমেট লীগ, বন্দুক লীগ। আবার জনগণ এটাও জানে খুর লীগ, পায়ের রগ কাটা পার্টি। এরা কারা জনগণ কি জানে না? তাদের জনগণ ঠিকই চেনে।

দলটির বিরুদ্ধে ফায়াদা লুটার অভিযোগ

রিজভী এখানেও কোনো দলের নাম না উল্লেখ করে বলেন, আজকে সব গণতন্ত্রমনা শক্তির এক জায়গায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই শক্তিকে ফাটল ধরিয়ে দুই-একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, এদেশের মানুষ এসব জানে। জনগণ জানে কারা দেশপ্রেমিক, কারা স্বাধীনতা বিশ্বাস করে, কারা সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে, কারা বহুদলীয় গণতন্ত্র বিশ্বাস করে।

ভারতের সাথে গোপন যোগাযোগের তথ্য

এদিকে রিজভী সবচেয়ে বড়ো ধরনের অভিযোগটি করেন ভারতের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক ও গোপন যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে, যা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত ইসলামী। 

জামায়াতের দফায় দফায় পাল্টা বিবৃতি

এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। বলেছেন, ইসলামী ব্যাংক দখল নয়, মায়ের কোলে ফিরেছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক দখল করেনি জামায়াতে ইসলামী, ডাকাতের বেশে নতুন ডাকাতরা ৫ আগস্টের পর ব্যাংক দখল করতে গিয়েছিল। তারা পালিয়ে এসেছে। জামায়াতে ইসলামী ব্যাংক দখল করেনি, বরং এই ব্যাংক তার মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে এমন আলোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতি দেন। এতে তিনি বলেন, বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত’ মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেন, রিজভীর এ জাতীয় বক্তব্য বিগত কয়েক দশক ধরে প্রচার করা হচ্ছে। রগ কাটা, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার, ৭১ এর বিরোধিতা এ সব বক্তব্য জনগণ বহু পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা উচ্চারণ করে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনো করেনি। তিনি জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে ‘ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না’ তার এই বক্তব্য চরম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়, বলেন রফিকুল ইসলাম খান।

বিবৃতি যুদ্ধে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়লো যেভাবে

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন,বর্তমান টালমাটাল সময়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এমন বক্তৃতা বিবৃতির লড়াইয়ে বেরিয়ে পড়ছে থলের বেড়াল। আর খুলে যাচ্ছে দলগুলির মুখোশ। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গিয়ে বেশ কিছু তথ্য রাজনৈতিক মাঠে ছেড়ে দিয়েছেন। তারমধ্যে একটি হলো ভারতের সাথে গোপনে যে জামায়াতের একটি যোগাযোগ আছে। কেননা এই জামায়াত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর কোনো কথা নেই বার্তা নেই একটি মন্তব্য করে ফেলেন। তা ছিল জামায়াত ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পক চায়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দ বাজারে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর ভারত-বিরোধিতা ধারণা ভিত্তিহীন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের নিশানা করে এই মতবাদ ছড়ানো হয়েছে যাতে জামায়াতের রাজনীতির মিথ্যা ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষমহল মনে করে ভারতের সাথে সে-ই সুসর্ম্পক রাখার খাতিরে দলটি কোনো শর্তে কি যুক্ত হয়েছে, যা রিজভী হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায় জামায়াত ইসলামী।’ প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে জামায়াত ভারত বিরোধী আড়ালে চালিয়ে যাচ্ছে গোপন আঁতাত? 

তাহলে বিএনপি কি ব্যর্থ?

আবার এমন প্রশ্ন দেখা দিয়ে যে বিএনপি’ও তলে তলে ভারতের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা কি জামায়াতের আমেরিকার লবির কারণে ব্যর্থ হয়েছে? আর একারণে কি এই বিএনপি’র নেতারা এখন জামায়াতের সাথে ভারতের সফল যোগাযোগের তথ্যে বিচলিত হয়ে এসব কথা ফাস করে দিচ্ছেন? 

জামায়াত কি সব সময় সুযোগসন্ধানী?

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি’র পক্ষ থেকে দেয়া আরেকটি তথ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় বইছে। বিবৃতির যুদ্ধের একপর্যায়ে বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতের বিবৃতির স্ক্রিনশট এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ২০১৮ সালের একটি নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা-‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দর কষাকষি করে ২২ আসন বাগিয়ে নেয় জোট থেকে এবং সে নির্বাচনে ডা. শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সাথে জোট? আর কার সাথে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?’ 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলে এনিয়েও চলছে নানান মন্তব্য কানা ঘুষা। বলা হচ্ছে জামায়াত সময়মতো বিএনপি থেকে সব মধু কেড়ে নেয়। আর সময় ফুড়িয়ে গেলে নিজ প্রয়োজনে তাদের স্বার্থে পিছুটান দেয়। যেমনটা ১৯৮৬ সালের স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে দেখিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। অনেক নাটকীয়তার পর এতে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী। আবার এই জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সাথে আওয়ামী লীগের সাথে গাটছাড়া বেধে বিএনপি’র পতন ঘটিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে যারা দাবি করে, সেই আওয়ামী লীগও কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছিল। সেসময় আওয়ামী লীগের নেত্রী বলেছিলেন, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এটা করেছিলেন। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগ তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে বলে তিনি মনে করেননি সেসময়, যেমনটা জামায়াতও মনে করে। আর এজন্যই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, বর্তমানে জামায়াতের ভারতীয় ও অতীতে আওয়ামী কানেকশান যে এখন-ও সক্রিয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী’র কন্ঠে সে-তথ্যই ফুটে উঠেছে। তবে সামনের দিনে বিএনপি-জামায়াতের এমন বির্তক কোন দিকে টার্ন নেয় তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে একটি বিষয় পরিস্কার রাজনৈতিক দলগুলি মুখে মুখে আধিপত্যবাদ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে থাকে। আর গোপনে তারা ঠিকই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বজায় রেখেই চলে। যা কিন্তু আজকের কোমলমতি ছাত্ররা এখনো ঠাহর করতে পারছে না।

শেয়ার করুন