১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৫:২৬:১৯ পূর্বাহ্ন


ড. ইউনূসের চীন সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৩-২০২৫
ড. ইউনূসের চীন সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনে পৌছে গেছেন/ ছবি পিআইডি


চীন বাংলাদেশ, দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। নানা কারনেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সে সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে প্রফেসর ইউনূস তার ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত যে চীন সফর তাতে সেখানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করবেন বলে আশাবাদ। চীনের সঙ্গে যেমনটা সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে তার চেয়েও বেশি সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশে সহায়তা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় চীন বহুগুণ এগিয়ে। নানা কারণেই বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে তিল তিল করেই চীনের পানে ঝুঁকেই আসছে। গত দের দশকে এর মাত্রা ছিল অনেক বেশি। বাংলাদেশে চীন বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। ছোটখাটোগুলো তো আছেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ তাদের। এর মধ্যে রয়েছে অন্তত ১২ টি মহাসড়ক, পদ্মাসেতুসহ ২১টি সেতু, অনেকগুলো পাওয়ারপ্লান্ট ও অন্যান্য। 

কিন্তু শেখ হাসিনা পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে ওই সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন দেখা গেছে। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই চীন এ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীন সফর করে এসেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদও চীনে সফর করে এসেছেন ৫ আগস্টের পর। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার চায় এ চীন যেন তাদের দেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, সেগুলো তারা যেন বাংলাদেশেই ফ্যাক্টরিগুলো স্থাপন করে বাংলাদেশের সে চাহিদা পূর্ণ করে। এছাড়াও চীনের অন্তত ৩০টি কোম্পানি চট্টগ্রাম ইকোনমিক জোনে তাদের কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাশা পাশি গেল কয়েকমাসে চীন বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন পন্য নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। 

এর মধ্যে বড় একটা বিনিয়োগে ইতিমধ্যে আগ্রহ চীনের। সেটা সোলার প্যানেল প্রকল্পে। বাংলাদেশে বিনিয়োগে চীনের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকরা আগ্রহী বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। জাতিসংঘ অধিবেশনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন গিয়েছিলেন, তখনই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশেনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ওই অফার পান প্রধান উপদেষ্টা। সে সময় ড. ইউনূস বলেন, চীনের সোলার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বড় আকারে বিনিযোগ করতে পারে, যা অনেক ধনী দেশে রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকারের সুবিধা পাবে। 



তখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আরো স্পষ্ট করে বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ড. ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনা সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকরা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। চীনা সরকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। এরপর ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনিও চীনের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারকদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। বাংলাদেশ গত দের দশকে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে যেভাবে ভাড়া করা পাওয়ারপ্লান্ট থেকে চড়া দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করে চাহিদা মেটাচ্ছে সেখানে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সে চাহিদা কমে যাবার সম্ভাবনা থাকবে। 

এছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করেছে চীনের রফতানি পণ্যে। এতে চীন বেকায়দায়ও পড়ে গেছে। ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ের আগেই একটা ধারনা দিয়েছিল যে, তিনি বিজয়ী হলে অন্তত ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করবেন চীনা পণ্যে। সেটা বাস্তবেও ঘটেছে। এরপর থেকেই চীন তাদের ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ সহ এ অঞ্চলে স্থানন্তরে চিন্তা করে আসছে। বাংলাদেশ এর আগে এমন সুযোগ পেলেও তা গ্রহণে অতটা তৈরি ছিলনা। এখন সে সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে এ প্রধান উপদেষ্টার এ সফরের মাধ্যমে সেসব সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে। এছাড়াও এ সফরে ড. ইউনূস চাইবেন, চীন থেকে পাওয়া ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো, সুদহার কমানোর আশ্বাস, কুনমিংয়ের তিনটি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ, ঢাকায় চীনের দ্বারা একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক, কৌশলগত, বাণিজ্যিক, উন্নয়ন সহযোগিতা ও অণ্যান্য দিক বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস। ওই বৈঠকে নজর থাকবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও বিভিন্ন দেশেরও। চীনের বাংলাদেশের রাস্ট্রদূতও ইতিমধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে গত ৫০ বছরে সবচে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত হবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ চীন সফর। 

ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক

৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে যায় ভারতে। সে থেকেই দুই দেশের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি। কারণ শুধু শেখ হাসিনাই নয়, আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন মন্ত্রীও ও দলটির বহু নেতাকর্মী ভারতে বিভিন্নভাবে আশ্রিত। একই সূত্রে ভারত বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেও বেশ টানাপড়েন। বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে যেতেন ভারতে। সেটা অনেকটাই বন্ধ। এতে বাংলাদেশ বেশ জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছে। ভারতে পশ্চিমা বহু দেশের ভিসা সেন্টারে বাংলাদেশিদের গিয়ে ভিসা নিতে হতো। সেটা প্রচণ্ড রকম হুমকির মধ্যে পড়ে। বিপাকে পড়ে উন্নতি ঘটেনি। 

বাংলাদেশ বাধ্য হয়েই এখন চীনে ঝুঁকতে চায়। বিশেষ করে চিকিৎসাসেবার ব্যাপক সহায়তা আশা করছেন চীন থেকে। 

বাংলাদেশ তার চলার পথ প্রসারিত করতে স্বাভাবিকভাবেই এসব বৈদেশিক বিনিয়োগ লাভের দিকে ঝুঁকবে। বিশেষ করে চীন যেখানে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু চীন ও ভারতের মধ্যে কিছুটা বৈরিতা সম্পর্ক থাকায় ভারতের পছন্দ না যে চায়নারা বাংলাদেশে অতিমাত্রায় ঝুকে যাক। স্বাভাবিকভাবেই এটা তাদের পছন্দ নাই হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তত ২০ কোটি মানুষের চলা ও ভরণপোষণেরও ব্যাপার আছে। ফলে বাংলাদেশ এখন এসবের বেলায় উদার। চীনের অর্থ ও সমার্থ ব্যাপক। সে তুলনায় ভারত অনেক পেছনে। ড. ইউনূস তার উদারনীতি গ্রহণ করে চীনকে এসব ব্যাপারে উদাত্ত আহ্বান জানাবেন এটাই স্বাভাবিক। 

স্টারলিংক সংযোগে বাংলাদেশ 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যতম সহযোগী ইলন মাক্সের ইন্টারনেট প্রভাইডার স্টারলিংকের সংযোগ লাভের সব কাজই প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। সহসাই এ লিংকে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। গত ২৪ মার্চ ট্রায়ালভিত্তিক সে সংযোগও পর্যবেক্ষণ হয়েছে। চীন সফরের আগে স্টারলিংকের এ সংযোগ নিশ্চিত হওয়ায় এ সেক্টরেও চীনের বিনিয়োগ আসার পথ সুগোম হচ্ছে। শুধু চীনই নয় অন্য যে কোনো দেশও বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তি কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। 

তিস্তা প্রকল্প 

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। বাংলাদেশ তাদের ন্যায্যা হিস্যা লাভে ব্যর্থ। ভারত এক তরফাভাবে বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে আসছে, তাদের স্বার্থেই। এ নিয়ে বহু দেনদরবার হলেও সুরাহা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে ভারতের পছন্দের আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগও এ ব্যাপারে বহু দেনদরবার করলেও ভারত টু শব্দও করেনি। এরপরই চীন তিস্তায় বিকল্প ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় ও এর সম্ভাবনা যাচাইও করে। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন এ ব্যাপারে বহুদূর অগ্রসর হয়, তখন হঠাৎ ওই প্রকল্প ভারত করে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে চীনের অগ্রাধিকার লোপ পায়। শেখ হাসিনাও তার মতের পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর চীন আবারও তাদের আগ্রহ নতুনভাবে দেখালে বাংলাদেশও এক্ষেত্রে এখন অগ্রসর হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ সফরে এ তিস্তার ব্যাপারেও পজিটিভ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব লাভের পরই ড. ইউনূসকে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করেছিল ভারতীয় মিডিয়া। ড. ইউনূস তখনই বলেছিলেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে অস্থিতীশীল করার চেষ্টা করে, তাহলে ভারতও স্বস্তি পাবে না। ড. ইউনূসের এমন দৃঢ় বক্তব্য বাংলাদেশে ব্যাপক প্রশংসা পেলে ভারত এটা মোটেও স্বাভাবিক নেয়নি। নানা কারণেই এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের শীতল ভাব পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। 

সবশেষ

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ যেমন চীনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়াতে বাধ্য হচ্ছে, চীনও তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী। এখানে ভূরাজনীতিরও একটা বিষয় থেকে যায়। কূটনৈতিক অঙ্গন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ইউনূসের চীন সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যতটা উদ্বেগ থাকবে, ভারতের উদ্বেগ থাকবে তার চেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে চীনের প্রভাব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, চীনের প্রভাব ঠেকানো। সেজন্য চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখছে। ড. ইউনূসের সরকার সবদিক ভারসাম্য রক্ষা করে এ সফরকে কীভাবে ব্যবহার করে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।

শেয়ার করুন