০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৫০:৩৮ অপরাহ্ন


বুড়িগঙ্গা-তুরাগের দখল উচ্ছেদের জায়গা এখন কাদের দখলে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৮-২০২৫
বুড়িগঙ্গা-তুরাগের দখল উচ্ছেদের জায়গা এখন কাদের দখলে আর্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীরা


বিষয়- তুরাগ বাঁচাও, জীবন বাঁচাও স্লোগানে ‘রংতুলিতে নদী ও জীবন’ শীর্ষক আর্ট। আয়োজক নদী ও প্রাণ প্রকৃতি নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙর ট্রাস্ট।

যাত্রা শুরু...

স্বনামধন্য ৩৫ জন চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তুরাগ তীরে এক আর্ট ক্যাম্প আশুলিয়া ল্যান্ড স্টেশনে আয়োজন করা হয় গত ৬ আগস্ট। বিআইডব্লিউটিআইয়ের একটি জাহাজে চড়ে রওনা দেওয়া হলো সকাল দশটার দিকে ঐতিহ্যবাহী সোয়ারিঘাট থেকে। সঙ্গে চললেন নদী ও নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, বুড়িগঙ্গা মঞ্চের আহ্বায়ক রাশেদ আলী, গ্রীন সেভার্স এর প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি, নদী গবেষক আইরিন সুলতানা, নোঙর ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য ইব্রাহিম রিপন, শিল্পী-কিউরেটর সোহাগ পারভেজসহ আরও অনেকে। নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমান শামস পুরো টিমের দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন...নদীপথে দখল দূষণের ভয়াবহ চিত্র জাহাজে আসা সকলকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন...

চলতে চলতে নদীপথে যা শোনা ও দেখা গেলো...

বুড়িগঙ্গা রক্ষায় বিভিন্ন ধরণের কাজ শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে। সেই হিসেবে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর তীরে হাঁটার পথ(?) তৈরি করার একটি প্রকল্প, যার অংশ হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরেও ওয়াকওয়ে তৈরি করা হচ্ছে, যা দৃশ্যত এখনো চলমান। প্রকল্পের আওতায় নদীর তীরবর্তী এলাকা দখলমুক্ত করা, ওয়াকওয়ে ও জেটি নির্মাণ এবং নদীর সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে।  দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে এবং ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল বলে শোনা যায়। ওয়াকওয়ে নির্মাণ ছাড়াও নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়ে যা এখনো চলামান বলে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে নদী তীরে হাঁটার পথগুলো মনে হচ্ছিল অনেক সরু। একটু আরাম করে দ্ড়াানো ফুরসৎ নেই। এসব কাজ কতটা জনবান্ধব এগুলো করা হয়েছে তা নিয়ে জনগণের নানান ধরণের অভিযোগ শোনা গেলো যাত্রা পথে। তবে কারো কারো মতে, এগুলোকে আবার জনবান্ধব করতে কতো হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাবে তা কে জানে..

প্রশ্ন কাদের উচ্ছেদ করা হলো? উচ্ছেদের জায়গা দখল কাদের...

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে, ২০১৯ ও ২০২০ সাল টানা দুই বছরের অবৈধ দখলমুক্ত করা ও নদী রক্ষার শক্তিশালী অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রায় ১১ হাজার অবৈধ স্থাপনা। উদ্ধার হয়েছে নদীর দখল করা প্রায় সাড়ে ৩০০ একর জায়গা। বলা হয় যে, নদী রক্ষার এই কাজের টেকসই বন্দোবস্ত করতে চলছে প্রায় ১,১৮১ কোটি ১০ লাখ টাকার তীর রক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের মধ্যে কীওয়াল বাখাড়াপাড় করা হচ্ছে ১০ কিলোমিটার। ওয়াক অন পাইল বা পিলার আকৃতির করা হচ্ছে প্রায় ১৮ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু নদী পথে চলতে গিয়ে এই যাত্রায় সবার মুখে প্রশ্ন দখলমুক্ত করা ও নদী রক্ষার শক্তিশালী অভিযানে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ১১ হাজার অবৈধ স্থাপনা সেখানে কাদের হোটেল মোটেল বহুতল ভবন, কারপার্কিং করতে দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যেনতেন মনগড়া উচ্ছেদের নাটক মঞ্চস্থ করে ওই সময় খালি জায়গা থেকে কোটি কোটি টাকার মাটিই বিক্রি করে সবাই মিলে মিশে নিয়ে গেছেন। জানা গেছে ওই সময় উচ্ছেদ নাটক করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক আস্থাভাজনদের নামমাত্র মূল্যে দিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা এখন নদীর পাড়ের মানুষের মুখে মুখে।  

সুমন শামস যা বললেন..

এদিকে যাত্রা পথে বক্তব্য রাখতে গিয়ে নোঙর ট্রাস্টির চেয়ারম্যান সুমন শামসের বক্তব্যেও এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে।  সুমন শামস অভিযোগ করেন তুরাগ নদী জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করার পরে নদীর দুইদিকে সীমানা পিলার স্থাপন করে আসলে নদীর প্লাবান ভুমি মেরে ফেলা হয়েছে। তুরাগ নদীকে সংকুচিত করা হয়েছে। আবার তুরাগের প্লাবনভূমি ভরাট করে রাতারাতি আবাসিক প্লট বাণিজ্য জমে উঠেছে যা তুরাগ নদীর জন্য বিপদজনক। তিনি আরো বলেন, তুরাগ নদীতে অধিকাংশ অবৈধ দখল হয়েছে-অন্তত ১,৩৯৮ একর জমি দখলে পরিণত হয়েছে, যেখানে নদীর পাড়ে পার্ক, কারখানা, বালু ডিপো, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

গাজীপুর অংশে প্রায় ৪৮৯টি অবৈধ দখল রয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি পাকা, ৪১২টি আধাপাকা-টিনসেড এবং ১৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে পাওয়ার প্ল্যান্ট, মেডিকেল কলেজ, গার্মেন্টস, ডেইরি ফার্ম ইত্যাদি।

এজন্য সুমন শামস প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তাদের ইশতেহারে পরিবেশগত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, হজরতপুর ধলেশ্বরী নদী থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর উৎসের ১৬ কিলোমিটার নদী দখল করে গড়ে ওঠা মধুমতি মডলে টাউন নদীকে হত্যা করেছে।

অন্যদিকে নোঙরের উদ্যোগে যাত্রাপথে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ যোগ দিয়ে বলেন,এ সময় মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকা শহরে, যেহেতু শহরের চারপাশে নদীর সাথে সাতটি খাল সংযুক্ত, তাই ড্রেনের পানি খালে যাওয়া উচিত নয়। মোহাম্মদ এজাজ বলেন, শহরটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছিল কারণ বৃষ্টির পানি নদীতে যেতে পারে না, যার ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে, শহরের কিছু নিচু জমি জলাবদ্ধতার শিকার হয়। তিনি আরও বলেন, শহরের জলাশয়গুলিকে আবাসন এবং শিল্পের জন্য ভরাট থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। আরও বলেন যে পরিবেশ রক্ষার জন্য শহরের প্রতিটি অংশীদারের ঐকমত্য প্রয়োজনাজন কারণ পরিবেশ অপরিবর্তনীয়। তিনি আর্ট ক্যাম্পের শুভ উদ্বোধন করেন। 

এদিকে নদী ও নৌ পরিবহন গবেষক তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে শিল্পীরা অনেক প্রভাব ফেলতে পারেন এবং তিনি আশা করেন যে একটি শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে শিল্পকর্ম বৃদ্ধি পাবে।নদীর শৈশবে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে - বনভূমির ব্যাপক হারানো, নদীর গভীরতা সংকুচিত এবং বালু উত্তোলন–সব মিলিয়ে একটি “মৃতপ্রায় নদী”র ছবি তৈরি হয়েছে। গত ২৫-৩০ বছরে তুরাগ নদীর দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে নদীতে অবৈধ ডাম্পিং পয়েন্ট, ৩৮টি স্লুইসগেট ও ৬২টি সেবা খাল রয়েছে, যা দূষণে অবদান রাখছে। ২০০৯ সাল থেকে পরিবেশ অধিদফতর তুরাগকে “পরিবেশগত সংবেদনশীল”অঞ্চল ঘোষণা করেছে।

কিউরেটর সোহাগ পারভেজ বলেন, শহরের পরিবেশ ভালো না হলে কেউ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে না। “বাংলাদেশের বৈচিত্রময়, প্রকৃতি আমাদের শিল্প ও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এখন শহরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যার কারণে নদীটি একটি বড় ড্রেনে পরিণত হচ্ছে এবং বায়ুরর মান অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে।” অনুষ্ঠানের অতিথি এবং চিত্র শিল্পীদের নিয়ে সোয়ারীঘাট বুড়িগঙ্গা মঞ্চ থেকে যাত্রা শুরু করে বিআইডব্লিউটিএর জরিপকারী জাহাজ বালু’ বছিলা হয়ে আশুলিয়া বন্ধরে নোঙর করে। শিল্পী চন্দ্র শেখর রায়, প্রীতি কোনা দেব, জাহিদ খান, সোনিয়া বিনতে হাসান এবং মানসী বণিক প্রমুখ ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের শিল্পকর্ম শীঘ্রই প্রদর্শিত হবে।

শেয়ার করুন