১০ মে ২০১২, শুক্রবার, ০৭:০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৭-২০২২
কথার কথকতা


আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করে, আপনি কোনো জিনিস ডলার দিয়ে কিনলে সাথে সাথে তা টাকার সাথে তুলনা করেন কেন?  করে কি লাভ? তাছাড়া এই কারণে আপনার সম্পর্কে মানুষের একটা হীন ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। কেউ আবার আপনাকে ছোটলোকও বলে ফেলতে পারে। তখন তো আপনি মনে খুব কষ্ট পাবেন।

সত্য কথা বলতে কি, আমি আমার এই কাজের মধ্যে তো কোনো ভুল বা আপত্তি করার মতো কিছু দেখি না। একটা জিনিস কেনার পর আমি যখন তা টাকার মানে হিসাব করি, তখন আমি বুঝতে পারি বাংলাদেশে আমি কেমন ছিলাম। আমার আজকের লেখাটাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, শুধুমাত্র জিনিসপত্র কেনার সময়কার মূল্যকে দুই মুদ্রায় হিসাব করে আমি বুঝতে চাই যে, আমি কি এখন ভালো আছি, না কি বাংলাদেশে বেশি ভালো ছিলাম। তো বিষয়টা যখন আপনাদের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, তখন এটা না পড়লেও চলবে। আর যাঁরা মনে করেন, আমি একেবারেই ফেলে দেয়ার মতো কিছু বলবো না তাঁরা পড়ে ফেলতে পারেন। খেজুরে আলাপের মতো হলেও পড়ার পর আপনি ঝরঝরে অনুভব করবেন, কোনো বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের দুশ্চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে যাওয়া বা ব্যথা করার মতো ঘটনা ঘটবে না। চিনির মধ্যে সেদ্ধ করা না হলেও খেজুরে আলাপের মধ্যেও সাধারণ খেজুরের মতো একটা হালকা মিষ্টি স্বাদ থাকে। বেদরকারি হলেও কথাগুলো খেজুরে আলাপ তো বটে!

এবার চলে আসি ডলার এবং টাকার মধ্যকার তুলনায়। ও হ্যাঁ, এই খেজুরে আলাপের মধ্যেই একটা খেজুরের বিচির মতো সলিড সত্য জেনে নিন যে, আন্তর্জাতিক বাজারের মুদ্রা মানের নিরিখে কুড়ি বছর পর সেদিন ডলার এবং পাউন্ডের মান অর্থাৎ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মুদ্রার দাম সমান হয়েছে অর্থাৎ এক ডলার সমান এক পাউন্ড। ও হ্যাঁ, ডলার আর টাকার বিনিময় হার আজ কত হলো চলুন তো দেখে আসি। প্রিয় পাঠক, একটু অপেক্ষা করুন, আমি ইন্টারনেটে আজকের মুদ্রা মানটা দেখে আসি।

ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, আজ এক ডলার সমান সমান চুরানব্বই টাকা প্রায়। কয়েকদিন আগে নিরানব্বই টাকা নিরানব্বই পয়সা হয়েছিলো এক ডলার। আমরা আমাদের আজকের বেদরকারি খেজুরে আলাপটি চালিয়ে নেয়ার সুবিধার্থে এক ডলার সমান সমান একশো টাকা ধরে নিচ্ছি, তাতে আলাপের সুবিধা হবে। কথাগুলো গতি পাবে, সহজ হবে। 

নিউইয়র্কের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা যেসব এলাকায় বেশি বাস করেন সেসব এলাকায় এককাপ চায়ের দাম এক ডলার। তার মানে একশো টাকা। অবশ্য জ্যাকসন হাইট এলাকায় দোকানিরা চায়ের দাম বাড়িয়ে দেড় ডলার করেছে। আমরা আমাদের লেখার মাধ্যমে তাদেরকে এর আগের দাম বহাল রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। ওরা তা শোনেনি। এক বন্ধু বললো, রাখো মিয়া, ওরা তোমার লেখা পড়েছে নাকি, পত্রিকা পড়ার সময় আছে নাকি ওদের! চিন্তা করে দেখলাম, পত্রিকা পড়ার সময় তো ওদের থাকার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, এরই মধ্যে ঘটনা কিন্তু ঘটে গেছে। কি ঘটনা ঘটেছে, জানতে চান? যা ঘটেছে তা শুনলে আপনাদের মনে হবে, আজকের খেজুরে আলাপ চিনির পানিতে সেদ্ধ করা মধ্যপ্রাচ্য খেজুরের মতোই মিষ্টি।

জ্যাকসন হাইট এলাকায় বাস করেন এবং মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত আমাদের এক বন্ধু বললো, ওরা চায়ের দাম বাড়িয়েছে আর আমরা তা মোকাবিলার জন্য কিছুই করবো না, তা কি হয়! কাস্টমারের সাথে ইয়ার্কি-ফাজলামি করে পার পেতে দেয়া তো যায় না, তাই আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে এক চমৎকার অ্যাকশনে গেলাম। তাতে আমরা সফল হয়েছি। আমি কথাটা শুনে চমৎকৃত হলাম এবং কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা জানতে চাইলাম। বন্ধুটি বললো, ব্যবস্থাটি খুবই সিম্পল এবং পরীক্ষা করে সাফল্য লাভ করা গেছে। চায়ের দাম বাড়ানোর পরদিন থেকেই আমরা নতুন পলিসি চালু করলাম। আগে আমরা এক কাপ চা দুই বন্ধু ভাগ করে খেতাম, এখন আমরা এক কাপ চা তিনজনে ভাগ করে খাই। এক কাপ চা এক ডলার থেকে দেড় ডলার হলো অর্থাৎ একশো টাকা থেকে দেড়শো টাকা হলো। আগে দু’জন খেলে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা লাগতো এখন তিনভাগ করাতে পঞ্চাশ টাকাই রইলো। কাস্টমারের সাথে ফাজলামি! আমরা বন্ধুদের কার্যকর পদক্ষেপে অবশ্যই চমৎকৃত হয়েছি।

ওইদিন কাঁচাবাজার করতে গিয়ে পেঁপের দামের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো।

কাঁচা ও পাকা দু’রকমের পেঁপেই কিনলাম। দুটোই মধ্যম সাইজের পেঁপে, কাঁচাটার দাম পড়েছে দুই ডলার তেতাল্লিশ সেন্ট আর পাকাটার দাম পড়েছে পাঁচ ডলার চৌত্রিশ সেন্ট অর্থাৎ দুশো তেতাল্লিশ টাকা এবং পাঁচশো চৌত্রিশ টাকা! আমার তো মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থা। বাংলাদেশে এই দুটো পেঁপের দাম কতো হতে পারে? আমার বিশ্বাস, এর চারভাগের একভাগ হতে পারে। তাহলে কথাটা কি দাঁড়ালো? হ্যাঁ, এ পর্যায়ে কোনো কোনো পাঠক হয়তো আমাকে প্রশ্ন করবেন, ‘আপনি কি বলতে চান?’ আমি বুঝতে পারছি না, কি বলা উচিত, আমার কি বলা উচিত আপনিই বলে দিন। পেঁপের ওপর তো আমাদের বন্ধু কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘চা কৌশল’ প্রয়োগ করা যাবে না। না কি করা যাবে?

আজকের লেখাটা এখানেই শেষ করে দিতে পারলে ভালো হতো। কারণ এটি লিখতে গিয়ে আমার বাম হাত ব্যথা হয়ে গেছে মোবাইল ফোন ধারণ করতে করতে, ডান হাতের আঙুল ব্যথা হয়েছে টাইপ করতে করতে, মাথা ব্যথা করছে ভাবতে ভাবতে, চোখ টাটাচ্ছে ছানির কারণে এবং শরীর ও মনে আরো অনেক কিছু হচ্ছে! আমি বুঝতে পারছি না এই কষ্টগুলোর মূল্যায়ন ডলারে করবো না কি টাকায় করবো! বিষয়গুলো নিয়ে কার সাথে আলাপ করবো? একজন মুরুব্বি আছেন, উনি ডিউটিতে গেছেন। একজন আত্মীয় ছিলেন, তিনি বাংলাদেশে গেছেন, এক প্রতিবেশী আছেন, যিনি আমার কথা শুনবেন বলে মনে হয় না। কারণ উনি সদা ছুটে চলেন। এক জুনিয়র ফ্রেন্ড আছে যে, আমি কিছু বললে মনোযোগ দিয়ে শোনে, কিন্তু ওর কাছে যেতে ও আসতে আমার সাড়ে পাঁচ ডলার অর্থাৎ পাঁচশো পঞ্চাশ টাকা খরচ হবে। এটা কে দেবে?

প্রিয় পাঠক, আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আমার এই লেখার গতি ও প্রকৃতি এর লজিক হারাচ্ছে? তাহলে আপনিই বলে দিন আমার করণীয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে যে, এই সাড়ে পাঁচ ডলার মূল্যমানের সংকটে আমি প্রায় প্রত্যেক দিনই পতিত হই এবং এ অবস্থাটি গত সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মোকাবিলা করছি। কেউ আমাকে কখনোই জিজ্ঞেস করেনি, এ সংকট কীভাবে সমাধান করা হয় অথবা এ অর্থটি কোত্থেকে আসে। একটু-আধটু ইঙ্গিত করে যাকেই বলার চেষ্টা করেছি প্রত্যেকে আমাকে এমন পরামর্শ দিয়েছে, যা আমার আঠারো থেকে পঁচিশ বছর বয়সের কালে দেয়া উচিত ছিলো।

আমার সবসময়ই মনে হয়, মানুষ তাকিয়ে কথা বলে ঠিকই, তবে সঠিকভাবে কিছু দেখতে পায় না অথবা বর্তমান না দেখে অতীত দেখে। না হলে সত্তর বছর বয়সী মানুষকে আঠারো বছর বয়সী উপদেশ দেয় কি করে! তবে হ্যাঁ, আমেরিকার মতো জায়গায় ফি ছাড়া উপদেশ দেয়াও যে একটা দান এটা আমি ভুলি না। কারণ এখানে নাথিং ইজ ফ্রি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট হলো এই যে, ‘চা কৌশল’ কিন্তু এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়। তবে হ্যাঁ, ওই কৌশল সিঙ্গাড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। জ্যাকসন হাইটে সিঙ্গাড়া এক ডলার থেকে দেড় ডলার হবার পর দুই বন্ধুকে একটা সিঙ্গাড়া ভাগ করে খেতে দেখেছি। তবে একজনের খেতে সমস্যা হয়েছে। সিঙ্গাড়ার দাম বাড়ানোর পর এটার আকৃতি কিঞ্চিৎ বড় করা হয়েছে, তাতে এর জোড়ার দিকটাতে আটা-ময়দা বেড়ে গেছে আর ভাজি তার তুলনায় অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। চায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু আকার-প্রকারে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কি বললেন? আরো সংকট আছে? অন্য অনেক বিষয়ে? আমাকে বলতে চান? তাহলে তো আপনাদের ওখানে আমাকে আসতে হবে! তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু যাতায়াতে যে সাড়ে পাঁচ ডলার অর্থাৎ সাড়ে পাঁচশো টাকা লাগবে তা আমার কাছে নেই। কেউ কি তা আমাকে দেবে? কেন দেবে? ব্যাপারটা কি এরকম যে, সাড়ে পাঁচশো টাকা চাইলে দেবে না, কিন্তু সাড়ে পাঁচ ডলার চাইলে দেবে? এটা মূল্যমান বা মূল্যবোধের বিষয় নয়, এটা হচ্ছে বাস্তবতা, কঠিন বাস্তবতা। সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তা মোকাবিলা করছি! এভাবে কি চলবে? কি বললেন? এক কাপ চা তিনজনে ভাগ করে খেতে যতোদিন রাজি থাকবো, ততোদিন কোনো সমস্যা হবে না? দেখা যাক।


শেয়ার করুন