২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৫:৫৭:৫২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


অপরিকল্পিত প্রকল্পে জনজীবন বিপন্ন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০১-২০২৩
অপরিকল্পিত প্রকল্পে জনজীবন বিপন্ন বাপার সম্মেলনে অতিথিবৃন্দ


প্রায়ই শোনা যায় যে, আগে উন্নয়ন এরপর পরিবেশ। কিন্তু যে উন্নয়ন পরিবেশ রক্ষা করে না, তা টেকসই হবে না। তাই দেশের পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে সংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে। এজন্য পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে আরো তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কেননা অপরিকল্পিতভাবে নেয়া বড় বড় প্রকল্প মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের (বেন) উদ্যোগে পরিবেশবিষয়ক জাতীয় সম্মেলনে দেশের পরিবেশবাদীদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে।  

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)-এর যৌথ উদ্যোগে গত ১৩ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর পরের  দিন ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ‘বাংলাদেশের হাওর, নদী ও বিল : সমস্যা ও প্রতিকার’ বিষয়ক এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। 

সমাবেশে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা পরিবেশ ধ্বংস করছে। তারা দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদীদখল, বন ধ্বংস ও পরিবেশকে বিপন্ন করছে। তাই পরিবেশবাদীদের তাদের নিজেদের দাবি তোলার জন্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের কথা বলতে হবে।

অন্যদিকে এই সমাবেশ অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের যেখানেই আমরা যাই, স্থানীয় মানুষেরা তাদের সমস্যা হিসেবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলছে। দেশের কয়েকটি গাছ, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে পরিবেশের সব উপাদানকে রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয়। আমরা শুনি দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন মানে বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। এসব প্রকল্প মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, দেশে পরিবেশ রক্ষা করতে হলে ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। ওই ক্ষমতার প্রথম স্তরে রয়েছে দেশের কিছু ক্ষমতাধর কোম্পানি। যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। এর দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সরকার, যারা বড় বড় প্রকল্পের নামে দেশের পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে ওইসব কোম্পানি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। আর তৃতীয় স্তরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা জমিদারের মতো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁরা বন ধ্বংস, নদীদখল থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাচ্ছেন।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, দেশে তিন ধরনের মানুষের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। একধরনের মানুষ হচ্ছে লোভী; দ্বিতীয়ত. নীতিহীন এবং তৃতীয়ত. রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। 

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা প্রায়ই শুনি আগে উন্নয়ন, তারপর পরিবেশ। কিন্তু যে উন্নয়ন পরিবেশ রক্ষা করে হবে না, তা টেকসই হবে না। 

বাপার সভাপতি সুলতানা দেশের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে আরও তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

প্রথমদিনের এই সমাবেশে বেনের প্রতিষ্ঠাতা ও বাপার সহ-সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, বাপার সহ-সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর আতিউর রহমান, বাপার নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক খালেকুজ্জামন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বক্তব্য দেন।

অন্যদিকে পরের দিন বাংলাদেশের হাওড়, নদী ও বিল : সমস্যা ও প্রতিকার পরিবেশ সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও বাপা সহ-সভাপতি, অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব ও বাপা যুগ্ম সম্পাদক, অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুচনা বক্তব্য প্রদান করেন বাপা এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বেনের নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। 

এতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পরিবেশ ধ্বংস করে এমন উন্নয়ন প্রকল্প করবে না সরকার। সরকার পরিবেশসম্মত ও পরিকল্পিত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যে কারণে হাওরে এখন থেকে আর কোনো মাটির বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। সেখানকার ভূমিরূপ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে সরকার উড়াল সড়ক নির্মাণ করছে। এখানে আরেকটি উড়াল সড়কও নির্মাণ করা হবে। দেশের হাওর ও উপকূলে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা বাড়ছে অনুষ্ঠানে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের এমন বক্তব্যের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সরকার পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প করবে না। সরকার টেকসই উন্নয়নে বিশ্বাসী।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘দেশের নদ-নদীগুলোর দখলদারদের চিহ্নিত করে নদীরক্ষা কমিশন তালিকা প্রকাশ করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ওই তালিকা অনুযায়ী দখলদারদের উচ্ছেদ করা। যাতে নদীগুলো তাদের স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে পারে।’

বাপার সহ-সভাপতি ও বেনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় একসময় অষ্টমাসী বাঁধব্যবস্থাা প্রচলিত ছিল। মাসের আট মাস বাঁধ দিয়ে ফসল করা হতো, বাকি সময় তা কেটে দিয়ে পানি প্রবেশ করতে দেয়া হতো। কিন্তু বিদেশি পরামর্শকদের বুদ্ধিতে সরকার উপকূলজুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছে। যার ফলাফল হিসেবে আজকে দেশের উপকূলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে যেসব খাল রয়েছে, তা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আরো সরু করা হয়েছে। তার চারপাশে দখলদারদের বৈধতা দেয়া হয়েছে। হাওরের দখল ও দূষণ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের রাজধানীসহ বড় শহরগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।’ 

অনুষ্ঠানের শেষদিনের দ্বিতীয় পর্বে সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। 

সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে পরিবেশের পরিবেশবাদীদের কাছে একটি গণশুনানি আয়োজনের বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। এই সময়ে তিনি বলেন, কোনো নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদেরকে সংবিধানের ১৮ক ধারার চশমা দিয়ে দেখতে হবে। প্রাকৃতিক হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই এই সম্পদকে কাজে লাগানো ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একদিকে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনা করতে হবে, অপরদিকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, এর আগে দেশে এতো বড় পরিবেশ সমাবেশ আর কখনো হয়নি। আমরা চাই আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে যেন পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে স্থান পায়।

কারিগরী উপ-কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম. শহীদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের হাওর, বিল ও জলাশয়গুলো অপরিকল্পিতি মানবিক কর্মকা-ের কারণে যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে আগামীতে বাংলাদেশের ভূমিরূপ ও নদীর গতিপ্রবাহে ব্যাপক রতবদল হতে পারে, যা থেকে পরিবেশ বিপর্যয়ও হতে পারে।

এই সম্মেলনে প্রায় ৫০টির মতো প্রবন্ধ বিভিন্ন সম্মিলিত এবং সমান্তরাল বিশেষজ্ঞ অধিবেশনে উপস্থাপিত হয়। এসব প্রবন্ধে হাওর, নদী ও বিল বিষয় নিয়ে তথ্য-উপাত্ত এবং গবেষণাভিত্তিক অনুসিদ্ধান্ত উপস্থিত করা হয়। এছাড়া এই সম্মেলনে একাধিক সমান্তরাল সাধারণ অধিবেশনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বাপার নেতা ও কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার হাওর, নদী, বিল ও উপকূলীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

শেয়ার করুন