২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১০:৫৯:৩১ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশ কাউকে উপেক্ষা করতে পারে না কেন?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০২-২০২৩
বাংলাদেশ কাউকে উপেক্ষা করতে পারে না কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন


ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের বিশাল তালিকার সব দেশ এক নীতিতে চলছে। ওই সূত্রে বর্তমানে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সখ্য। ইউক্রেন, রাশিয়া প্রসঙ্গেও তাদের এক নীতি। রাশিয়া তাদের প্রচণ্ড কষ্ট (গ্যাস, তেল সরবরাহ) দিলেও একচুলও সরছে না। নীতি বদলে ফেলছে না। আবার চীন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর নীতির দিকে তাকালেও স্পষ্ট তারা কোন মেরুতে পা রেখে চলে। এতে করে স্বাভাবিকভাবে এদের একে অপরের দুঃখ-কষ্টে অন্যরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এক নীতি বলে কথা! 

কিন্তু এশিয়ায় এ ঐক্যটা হয়ে উঠছে না। যে কটা দেশ, তারা যে যার নীতিতে। ভারত অন্যতম শক্তিশালী। তারা নিজেদের মত করে স্বার্থ বিবেচনা করে পলিসি ঠিক করে চলে। কিছুটা একলা চলা বা ‘স্বার্থ যেখানে ভারত সেখানে’ এমনটাও হয়। কিন্তু এশিয়ার অন্য শক্তিধর চীন ওগুলোতে নেই। নিজেদের দীর্ঘদিনের যে নীতি সেটাতেই অটল তারা। তার বিপক্ষে কী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকলো না ভারত, না ইইউ ওগুলো থোড়াই কেয়ার। নিজেরাই যে পরাশক্তি।  

কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হওয়ায় সঠিক কোনো নীতি অবলম্বন করে চলতে পারছে না। বাংলাদেশকে যেতে হয়, মার্কিনিদের কাছে। ইইউয়ের কাছে। চীনের কাছে। ভারতের কাছে। ক্ষেত্রবিশেষ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটা বাক্য খুব মেনেও চলা হয়, ‘কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, বন্ধুত্ব সবার সাথে।’ এর অন্য এক ব্যাখ্যা, বাংলাদেশ কারোর সঙ্গেই ঝগড়াঝাটিতে যাবে না। কারো বিপক্ষে নয়, পক্ষেও নয়। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। বা মধ্যমপন্থায় থাকা। 

দুনিয়ার সব নীতির চেয়ে এই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা কঠিনসাধ্য বিষয়। কারণ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা অন্তত বর্তমান বিশ্বে যে রাজনীতি, সেটাতে অসম্ভব। তাছাড়া ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের যে অবস্থান বিশ্ব মানচিত্রে বা দক্ষিণ এশিয়ায় তাতে কৌশলগতভাবেই অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা ভীষণ কষ্টদায়ক। পরাশক্তির প্রাধান্য বিস্তারের যে মহড়া, তাতে বাংলাদেশকে পক্ষ না নিলেও নিতে হচ্ছেই। কিন্তু সে পক্ষটা যে নেয়া অসম্ভব সেটা কীভাবে বোঝাবে বাংলাদেশ অন্যদের এ দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। 

কিছু সময় পর্যন্ত এমন মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা সম্ভবপর। কিন্তু এক সময় যেয়ে আর নিরপেক্ষ, মধ্যমপন্থায় থাকা সম্ভবপর না। সম্ভবত এমন এক কঠিন সময়ে অবতীর্ণ এখন বাংলাদেশের ফরেন পলিসি। ক’দিন আগে পরাশক্তিদের যেভাবে বাংলাদেশে আনাগোনা ও একের পর এক বৈঠক হয়েছে, তাতে দুশ্চিন্তার কালোমেঘ, মধ্যমপন্থায়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সহকারী ডোনাল্ড লু ও তার খানিকটা আগে সে দেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিনিয়র ডিরেক্টর ফর সাউথ এশিয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লোবাচারের বাংলাদেশে সফর করে যাওয়া ও কী বার্তা প্রদান এবং এদের সফরের প্রাক্কালে আফ্রিকা যেতে একটু ভিন্নপথে এসে বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশের ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে যে গভীর রাতে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক। এগুলোকে সাদা চোখে দেখার সুযোগ নেই।

ডোনাল্ড লু যেমনটা বাংলাদেশে আসার আগে দিল্লি হয়ে এসেছেন। তেমনি লোবাচারও বাংলাদেশের পর শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তার নির্ধারিত সফর করে গেছেন। মাঝে মধ্যেই চীনা প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফর ও বার্তা প্রদান। সব মিলিয়ে ডোনাল্ড লু’র যে বার্তা বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক জোনে সেটা ওই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে বসে থাকা হুমকির মুখে।

চীনের সঙ্গে মার্কিন জোটের একটা শীতলতম লড়াই দীর্ঘদিনের। সেটা উত্তপ্ত হচ্ছে ক্রমশ। মার্কিন জোটে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশ। ইইউ তো আছেই। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে গভীর সখ্য বিশেষ করে বাংলাদেশের বেশকিছু মেগা প্রজেক্টের উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতা সরকারের সঙ্গে যে সম্পর্ক সেটা কন্টিনিউ করাও বাঞ্ছনীয়। চীন নীতি বা তাদের বিপক্ষে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার অর্থই বাংলাদেশের অর্থনীতি, সরকারের সাফল্য (মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন) ম্লান হওয়া। সব মিলিয়ে কী করবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ- সে দৃষ্টি এখন সবার। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যতোই মুখে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে তার এমন বহুজাতিক সম্পর্ক বজায় রাখা কষ্টদায়ক, সেটাই প্রকারান্তে জানান দিচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি এ সম্পর্কের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখবে। 

মোমেন বলেন, ‘আমার চ্যালেঞ্জ হলো তিনটি দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন। এগুলো শক্তিশালী দেশ। আমাকে এই তিনটি দেশের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যাতে প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নত হতে পারে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কোনো দেশকে উপেক্ষা করতে পারে না এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া তাদের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেন বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ (বৈশ্বিক) আগ্রহের  কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।’ 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘প্রধান শক্তি’ এবং বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাছাড়া আপনারা জেনে খুশি হবেন যে আমরা ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ‘সোনালি অধ্যায়’ অতিক্রম করছে এবং দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

মোমেন বলেন, সব বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সমানভাবে সুসম্পর্ক রাখা এতো সহজ নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন ‘মহান ও বাস্তববাদী নেতা’ থাকায় বাংলাদেশ এটিকে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিচালনা করতে সৌভাগ্যবান। 

আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রচ-রকম দ্বিধাবিভক্ত। দেশের স্বার্থেও সবাই যেন এক হতে পারে না। কর্তৃত্ববাদ ও স্বার্থ হাসিলের রাজনীতিতে একে অপরের সঙ্গে বৈরিতা এতোটাই বেশি যে এখানে ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমন বিভক্তি রাজনীতিতে, যার জন্য এ সুযোগটা নিচ্ছে এ অঞ্চলে পলিটিক্স করতে আসা ভিনদেশিরা। জাতীয় স্বার্থে ঐক্য থাকলে বাংলাদেশের ‘মধ্যমপন্থা’ নিয়ে থাকা কঠিন নয়। কিন্তু সে অবস্থা নেই। ফলে দেশ পড়ে গেছে একটা আন্তর্জাতিক কঠিন মারপ্যাঁচে।

শেয়ার করুন