২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৫:১০:৫৬ পূর্বাহ্ন


নির্লজ্জের লজ্জাবোধ নাকি অহংবোধের আস্ফালন
কামরুজ্জামান ভুঁইয়া
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৪-২০২২
নির্লজ্জের লজ্জাবোধ নাকি অহংবোধের আস্ফালন


দেশে দীর্ঘবিরতি শেষে অনেকদিন পর হরতালের মতন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন হলো। বড় বড় রাজনৈতিক দলের প্রতি আস্থাহীনতা, কর্মে-চিন্তা-চেতনার উদ্দেশ্যহীনতা, নৈতিক দেউলিয়াপনা, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে চলমান জনবিচ্ছিন্নতার একটি স্থবিরকালে ছোট কয়েকটি আদর্শবাদী দলের ডাকা এই হরতাল কর্মসূচি কতটা সফল হলো বা জনমনে কতটা প্রভাব ফেললো, সেটি রাজনৈতিক পর্যবেণে ও বিশ্লেষণের বিষয়। সে বিষয়ে আমার বোধ-জ্ঞান সীমিত। তবে একটি বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত করেই বলতে পারি, তাহলো বিগত কয়েক দশকে সম্ভবত এই প্রথম দেশের বাম দলগুলো জোট বেঁধে শতভাগ গণস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান করতে সম হয়েছে এবং জনমনের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হয়েছে। যেমনটি সচরাচর আমরা ঘটতে দেখি না। সাধারণত যেটা ঘটে, তার মধ্যে জনগণের কথা থাকে না। যেটুকু থাকে বলে মনে হয়, তার অধিকাংশটুকু থাকে দলীয় স্বার্থের মোড়কে ঢাকা কিছু গতবাঁধা বাণী-প্রবচন, যা উদ্দেশ্য গোপন করে চালাকি-নির্ভর গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা মাত্র। সে কারণে হরতালের মতো গণচেতনায় শাণিত গণবান্ধব প্রতিবাদের হাতিয়ারটি বারবার অপপ্রয়োগে একসময় ভোঁতা হয়ে উঠেছিল। মতাসীন শাসকদলের অন্যায়-অবিচার, লুটপাট, সামাজিক বৈষম্যের পীড়নে জনজীবন আজ ওষ্ঠাগত। মানুষ এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির অবসান চাইছে। দেশে নিত্যপণ্যের মূল্যে আকাশছোঁয়া ঊর্ধ্বগতির কারণে খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনে যে নাভিশ্বাস উঠেছে, তার প্রতিবাদে এবার যে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে জনমানসে আস্থার জায়গাটি ফিরিয়ে দিতে সম হবে এবং হয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই আমাদের একজন মাননীয় (?) মন্ত্রী তার নিজ অবয়ব আপন দর্পণে দর্শন করে লজ্জাবোধ করেছেন এবং জনসমে সে লজ্জাবোধের অনুভ‚তি অবহিত করেছেন।  অনেক সময় ঘোলাজল থিতিয়ে গেলে আবর্জনা নিজ থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় বাচালতার মধ্যে দু’একটি সত্য কথা সত্য উপলব্ধি বেরিয়ে আসে। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ভ‚লুণ্ঠিত করে এক ভয়াবহ অস্থিরতা-নৈরাশ্যের মধ্যে গোটা মানব সভ্যতাকে নিপতিত করে শান্তিকামী মনুষ্য সমাজকে অশান্ত করে তুলেছে। অন্যায়, অসত্য, অবিচার ও বৈষম্যের কবলে ফেলে মানুষের জীবনকে পশুর স্তরে নামিয়ে এনেছে। মানুষ সহস্রকাল ধরে তার রক্ত-ঘামে তিলে তিলে গড়া সভ্যতা এবং সহস্র বছরের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মানবিক অর্জনগুলো থেকে এখন কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে। পুঁজির দৌরাত্ম্য আজ এতোটাই প্রবল যে, পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আর নিজের ওপর বা নিজের বিশ্বাস, ভরসার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন আজ এতোটাই ভয়ঙ্কর যে আর কোনো ব্যক্তি-রাষ্ট্র-সমাজ তার নিজের শক্তির ওপর দাঁড়াতে পারছে না। পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ দুয়ের যুগপত মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব বিনাশী কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ সবই বিপন্ন হতে চলেছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। দেশি কালো পুঁজি এবং বহিরাগত বিদেশি দস্যু পুঁজি দুয়ের যৌথ আগ্রাসন ও আক্রমণে আমাদের দেশের মতো অন্যান্য দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেবলই পতন অভিমুখে ধাবমান। সেই বাস্তবতায় এটা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অন্যান্য অনেক দেশের মতন আমাদের দেশের মতাসীন বা মতা অন্বেষণী বড় বড় দলগুলো সেসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আওতামুক্ত নয়। অনেক েেত্র রাষ্ট্রপরিচালনায় এরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে ওইসব দানব শক্তির তল্পীবাহক হয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরা নিজ দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে না এবং জনসাধারণের স্বার্থও রা করে না। 

এবারের এই হরতালে কয়েকটি বিষয় লণীয় এবং একইসঙ্গে কিছু বিষয় বিশ্লেষণপূর্বক আলোচ্য। এক. হরতালের দাবি-দাওয়াগুলোর প্রায় সবটাই জনজীবন ও গণস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। দুই. এ হরতালে তথাকথিত দু’একটি বড় দলের কৌশলগত সমর্থন থাকলেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না বা ফায়দা তোলার সুযোগ ছিল না। তিন. হরতাল পিকেটিংয়ে নিষ্পেষিত ও ভুক্তভোগী আন্দোলনকারীদের মধ্যে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জনদুর্ভোগে  তীব্র ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও মারমুখী অবস্থান বা আচরণ ছিল না। চার. আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর পায়ে পা দিয়ে চিরায়ত অভ্যাসগত তত্পরতার বিরুদ্ধেও কোনো উশৃঙ্খল বা হঠকারী কার্যক্রম বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা জনগণের সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংসের কোনো প্রকার আলামত হরতালকারীদের দিক থেকে পরিলতি হয়নি। পাঁচ. যে দাবি নিয়ে হরতাল ডাকা হয়েছে, সম্ভবত সে দাবির বিপে দেশের সচেতন কোনো লোক পাওয়া যায়নি। এমনকি খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মুখে যা-ই বলুক, শাসকদলের দলীয় শৃঙ্খলে বাঁধা অপোকৃত রাজনীতি সচেতন বিশাল অংশের মানুষেরও এ দাবির প্রতি নীরব ও নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তার কারণ সাধারণত শাসকদলেও সুবিধাপ্রাপ্ত মোটাতাজা সমর্থকের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিত রুগ্ণ সমর্থকের সংখ্যাই বেশি। সবাই ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদপুষ্ট হলেও সকলেই বরপুত্র হতে পারে না। কারো রাতারাতি ভাগ্য বদল হয়, কারো শুধুই জুতার তলা য়। গণিতের সূত্রের মতো এটি একটি চিরন্তন সত্য, অসাধু ও অন্যায্য সুবিধা বিলিয়ে কখনোই দলের সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না। সবার মন রা করা যায় না।

আমরা সবাই লজ্জাপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয়কে জানি ও চিনি। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত বারো মাসে সকালে ঘুম থেকে উঠেই যেমন আমরা কাকের কা কা শব্দের সাথে পরিচিত হই, বিরক্ত হই। তেমন মাসের ত্রিশদিনই আমরা সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকায় বা টেলিভিশনে চোখ রাখলে এই মান্যবর মহোদয়ের অযাচিত বাণী-বচন শুনতে পাই, দেখতে পাই। নিন্দুকেরা কখনো তাকে অতিশয় বাচাল, কখনো হাইব্রিড বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করে না, অত্যুক্তি মনে করে না। তবু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে সংবরণ করতে তাগিদ অনুভব করেন না। যে কর্মে তাকে লজ্জায় মাথা নত করা উচিত, সে কর্মে যেন তার উত্সাহের সীমা নাই। আর যে কাজে প্রশংসা করা বা গর্ববোধ করা উচিত সে কাজে যেন তার আগ্রহই নেই। তোষামোদ নামে বাংলায় একটি নেতিবাচক শব্দ আছে, আমাদের দুর্ভাগ্য ওই শব্দটি আজ সকল সীমা অতিক্রম করে নতুন সংজ্ঞা বা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার অপোয় রয়েছে। দলকানা-তেলবাজ, হাইব্রিড নানা বিশেষণে এর আসল রূপ-পরিচয়টি বিলোপ হতে বসেছে। এর ব্যবহারকারী ও লাভধারীদের কদর্য-কুতসিত চেহারা এতোটাই গোলামী ও দাসত্বের নীচ মাত্রায় দৃশ্যমান হয় যে, দেখে বুঝতে ভুল হয় এরা মনুষ্য স্তরে অবস্থান করছে কিনা, এমনকি মেরুদণ্ড জাত প্রাণি কিনা তাতেও সন্দেহ জাগে। 

তবে এই হরতালকে কেন্দ্র করে তার এহেন উক্তি ও মন্তব্যে আমার অবচেতন মনে আরো একটি বিষয় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাহলো তিনি হয়তো ইতিপূর্বে প্রচলিত তদীয় হরতালের গতানুগতিক আকৃতি-প্রকৃতির বাইরে শতভাগ জনস্বার্থে ডাকা হরতালের তাত্পর্যটি বুঝতে সম হননি বা তেমন যোগ্যতাও ধারণ করেন না। তাই অবোধ-অবুঝের মতন অকারণ লজ্জায় লজ্জাবোধ করেছেন অথবা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এমনটিও হতে পারে, তিনি হরতালে মিছিল পিকেটিং থেকে বাস ট্যাক্সি ল করে বোমা-ককটেল অগ্নিনিেেপর মতন জনবিধ্বংসী অপকর্ম প্রত্য করেননি। কিংবা রোগী অ্যাম্বুলেন্স চাকরিজীবী নারী-শিশু-বৃদ্ধদের জিম্মি করে জোর জবরদখল কায়দায় হরতাল কর্মসূচি সফল করতে দেখেননি। শুধুমাত্র দরিদ্র অসহায় মানুষের কষ্ট লাঘবে এবং জনস্বার্থ বিবেচনায় রেখে শান্তিপ্রিয় হরতাল আহ্বানকারী ছাত্র-জনতার প্রতি অকারণ বিদ্বেষপ্রসূত উস্কানিমূলক পুলিশি আক্রমণ ও গ্রেফতার নির্যাতন সত্তে¡ও মিছিল-পিকেটিং থেকে কোনো প্রকার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বা পাল্টা আক্রমণ প্রত্য করেননি। তেমন কিছু ঘটলে বা ঘটাতে পারলে, যা দিয়ে বা যা নিয়ে তিনি বা তারা ফলদায়ক কোনো নাটক তৈরি করতে পারতেন। আদর্শিক রাজনীতির শিায় দীতি এই সকল মেধাবী ও ধৈর্র্যধারী দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুবকদের সর্বজন সমর্থিত ও সর্বস্বার্থ রতি আন্দোলন থেকে উসিলা তৈরির কোনো ফসল ঘরে তুলতে না পারার ব্যর্থতাও হয়তো তাকে আশাহত করেছে, লজ্জিত করেছে।

তবে মহাভারতে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদতুল্য বাক্য রয়েছে। ‘তোমারে বধিবে যে গোক‚লে বাড়িছে সে’ -যা আমরা আমাদের সমাজ জীবনে নানা ঘটনাসাপে প্রায়শ ব্যবহার করে থাকি। অর্থাত যে কোনো অহংকারী, অবিবেচক বা অর্বাচীনের সীমা লঙ্ঘনকারী যে কোনো অতিরিক্ত বা অতিরঞ্জিত কর্মটি বিনা মাশুলে নিষ্পত্তি হয় না। প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক নিয়মেই নির্মমভাবে তা আদায় করে নেয়। মান্যবরের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের পর দুটি দিনও যায়নি। তারই অগ্রজ নেতৃত্ব, যাঁদের কাছ থেকে তিনি রাজনীতি শিখেছেন, যাঁদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছেন। যাঁদের সামান্য সুনজরে পড়ার জন্য বা যাঁদের পছন্দের তালিকায় উঠতে হেন অপকর্ম সাধন করেননি, যা তিনি লজ্জিত না হলেও গোটা দেশ, গোটা জাতি লজ্জিত না হয়ে পারেনি। ভাগ্যের এমনি নির্মম পরিহাস, তেমনই কেউ একজন তার অতিমাত্রায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ কৃতকর্মে বিরক্ত হয়ে জনসভায় প্রকাশ্যে জনসমে ঘোষণা করে দিলেন, ‘ এই মানুষটি স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ বেয়াদব’। আমি জানি না, আমার মতো দেশবাসীও হয়তো জানেন না, এহেন লজ্জাজনক বাক্যবাণে তিনি লজ্জাবোধ করেছেন কিনা, লজ্জিত হয়েছেন কিনা। 

লেখক: কবি এবং সাহিত্যিক 

শেয়ার করুন