২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ৬:৪৬:১৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


উত্তাল মার্চ
গণহত্যার নীল নকশার আঁধার
ফকির ইলিয়াস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৩-২০২৩
গণহত্যার নীল নকশার আঁধার


একদিকে আলোচনা, অন্যদিকে বাংলাদেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করার দিকেই এগোয় পশ্চিমা শাসকরা। আলোচনা প্রায় ভ-ুল করেই পাকিস্তানি শাসকরা পালিয়ে যান রাতের আঁধারে। একটি কালো অধ্যায়ের দিকেই ধাবিত হয় বাঙালি জাতি। সেই সময়ের দিনপঞ্জিগুলো ছিল এরকম-

২২ মার্চ, ১৯৭১

ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। নিউজের প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়, শেষ মুহূর্তে যদি অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে, তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। ২৩ মার্চ প্রকাশিত নিউজের ভাষায়, ‘এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টো আলোচনার অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। চারি দফা পূর্বশর্ত পূরণ করা না হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়া এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো উভয়েই উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সম্ভবত সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তেই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালেই গতকাল প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে, তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহৃত এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে।’

এদিকে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ডাক বঙ্গবন্ধুর। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত।

পত্রিকায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত বাংলাদেশের পতাকার মাপ ও বিবরণ প্রকাশ।

২৩ মার্চ, ১৯৭১

দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে, বাড়িতে, গাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় থাকা বিমানবন্দর ভবন, প্রেসিডেন্ট ভবন ও লাটভবন ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।

২৪ মার্চ, ১৯৭১

শেখ মুজিবের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের বৈঠক। কোনও প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।

সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০নং সেক্টরে একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়েছে। বোমা হামলা করা হয়েছে। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে অগুন দেওয়া হয়েছে। শামীম আখতার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও তাকে ছেড়ে দিতে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পুলিশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিরপুরে অবস্থানরত অবাঙালিরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন।

 আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগের বক্তব্য শেষ। অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার দাবি। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা চলে না।

সামরিক প্রহরায় পশ্চিম পাকিস্তানি ছোট দলগুলোর নেতৃবৃন্দ ঢাকা ত্যাগ করেছেন।

ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেছেন।

সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ, রংপুরে কারফিউ।

নিজ বাসভবনের সামনে জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তৃতা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান।

নির্বিচারে গণহত্যার প্রতিবাদে কবি মোজাম্মেল হকের সামরিক সরকার প্রদত্ত ‘সিতারায়ে খেদমত’ খেতাব বর্জন।

২৫ মার্চ, ১৯৭১

এদিন রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে বাঙালির জাতীয়তাবাদী, স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র হামলার দ্বারা দমন করতে চেয়েছিল নরপশুরা।

এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত ‘অপারেশন ব্লিটজ’-এর পরবর্তী সামরিক আক্রমণ।

২৫শে মার্চের পাকিস্তানি সামরিক অপারেশনের আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশ তথা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

কিন্তু অকুতোভয় বাঙালিরা পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে এবং সূচনা ঘটায় স্বাধীনতা যুদ্ধের। ২৫শে মার্চের গণহত্যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদমুখর করে তোলে। আপামর বাঙালি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙালিরা দখলদারি পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।

২৫শে মার্চে গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে নিরস্ত্র মানুষের উপর সামরিক আক্রমণের জন্য কুখ্যাত এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার জ্বলন্ত সাক্ষী। ২৫শে মার্চের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা-ের মধ্যেও ফিনিক্স পাখির মতো বাঙালি জাতির উত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হানাদারদের পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ও ঐতিহাসিক গৌরবের।

শেয়ার করুন