২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১১:৪০:০৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


পিটার হাসের সাথে মঈন খানের বৈঠক
কোন পথে হাঁটছে বিএনপি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০২-২০২৪
কোন পথে হাঁটছে বিএনপি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে বিএনপি নেতা ড. মঈন খান


“যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করতে বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গণতন্ত্র তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন প্রত্যেকের মত শোনা হয়। বিরোধী দলের ঊর্ধ্বতন নেতার সাথে আলাপ করে ভালো লাগলো। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যেকের মতামত দিতে পারা এবং যার যার দায়িত্ব পালন করতে পারা গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।”

১২ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) এমন একটা পোস্ট ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়েল ফেসবুকে দেখা যায়। লেখাগুলোর নিচেই হাস্যজ্জোল দুইজনের ছবি। একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, অন্যজন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। এ দুইজনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ আলাপ। কিন্তু বৈঠকের বিষয়বস্তুতে রাজনৈতিক ইস্যুও ছিল বলে জানানো হয়। এর বেশি মুখ খুলেননি কেউই। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর এটাই বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রথম বৈঠক।

কথাগুলোর পরিসমাপ্তি এখানেই শেষ নয়। এই বৈঠক কী বার্তা দিচ্ছে এ আলোচনাই সর্বত্র। বিএনপি কী আবারও যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে আন্দোলন সংগ্রামের গতিবিধি ঠিক করবে। নাকি বিএনপি মার্কিনীদের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব রাখার জন্য যতটুকু ততটাই বজায় রেখে চলবে। 

মার্কিনীদের সঙ্গে আস্থা-অনাস্থায় বিএনপি 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বদ্ধমূল ধারণা ছিল বিএনপি ও তাদের সমার্থিতদের মধ্যে। আর যা হোক, ভারত এবার কিছু করতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বের অন্যসব শক্তিশালীদের সাথে নিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ফাইট করছে সেটাতে আওয়ামী লীগ সরকার এবার আর পেরে উঠবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। আস্থার বিষয় ছিল এটাও যে ২০১৪ এর পর ২০১৮ সনেও মার্কিনীরা তাদের মিত্রদের নিয়ে এতটা সোচ্চার ছিল না বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু ২০২৪ এর নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন তারা। একের পর এক দ্বিপাক্ষীয় বৈঠক সেটা কখনও ঢাকা কখনও ওয়াশিংটনে। সেটা দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার। মার্কিনীরা তাদের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটাতে, তাদের প্রত্যাশিত নির্বাচনের ব্যাতিরেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে- সে নির্বাচনে সহায়তাকারীদের ভিসানীতির আওতায় ফেলে দেয়া হবে। এ নিয়ে বহু কথা। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তফসিল ঘোষণার ঠিক আগের দিন পর্যন্ত ওই লড়াই চালিয়ে যেতে দেখা গেছে। কারণ তিন প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের পররাষ্ট্র সহকারী ডোনাল্ড লু’র চিঠি হস্তান্তর করেছিলেন পিটার হাস। যেখানে নিঃশর্ত সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়। দীর্ঘদিন থেকে যে ভয় ভীতি ছিল, সেটা ছিল যদি মার্কিনীদের প্রত্যাশা অনুসারে নির্বাচনটা অনুষ্ঠান না হয় তাহলে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সে নিষেধাজ্ঞা হতে পারে অনেক ধরনের। যার একটি বা অন্যতম আলোচনা ছিল, দেয়া হতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মত ভয়াবহ কিছু। যাতে সরকার টালমাটাল হয়ে ক্ষমতাচালাতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় এবং একটি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, যাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেন স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরা বেছে নিতে পারেন। 

কিন্তু একে একে এসব সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যেতে থাকে। তফসিল ঘোষণা এবং অনেকটাই এক তরফা একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। যেখানে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী দাড় করিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানো হয়েছে তাও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে। জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছে নির্বাচনে সেটা নিয়েও দলটি থেকে অভিযোগ সেখানে নাকি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল। যদিও এমনটা প্রমাণ না পাওয়া গেলেও জাতীয় পার্টি সেচ্ছায় আসন চেয়ে নিয়েছিল সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে। ফলে বিরোধী দল বলতে ছিলেন না কেউই। এসব কথা বড্ড পুরানো, সবার জানা। কিন্তু মার্কিনীরা যে চুপসে যাবে হঠাৎ করে এটা কেউ ভাবতেও পারেনি।

এ জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর এক ধরনের অনাস্থা এসেছে। অনেকে এখন ভাবছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আওয়ামী লীগ তাদের বিশ্বস্থ বন্ধু ভারতকে দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলেছে। নতুবা আওয়ামী লীগের নেতাগণ যেভাবে বিষোদগার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, তাদের দেশে রাজনীতি থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড ঘিরে- এরপরও তারা কিভাবে চুপসে যায়। এখানে যে বিষয় ফুটে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বার্থের জন্য এসব করেছে। তাদের স্বার্থ হাসিলের পর তারা চুপ হয়ে গেছে- অধিকাংশ বিএনপির নেতা কর্মীরা তো বটে সাধারণ মানুষও এটাই নিজের চিন্তা চেতনায় ঠাঁই দিয়ে রেখেছে। সাধারণ দৃষ্টিতে এটাই দেখছে মানুষ। তবে এর পেছনে অন্য কিছু আছে কি না সেটাই বা কে জানে!

মার্কিনীদের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্বের জন্য বন্ধুত্ব রাখা যথেষ্ট। বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সখ্যতা ভাল। তবে অতি সখ্যতা বা অতি নির্ভরতা কোনোদিনও ভাল নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি চলে বাংলাদেশের স্টাইলে। এখানে স্বৈরাচারী এরশাদকে হঠাতে বিএনপি- আওয়ামী লীগসহ সবাইকে রাস্তায় নেমে দীর্ঘ আন্দোলন করতে হয়েছে। বিএনপিকে নামাতেও দীর্ঘ আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ। সেখানে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অহিংস আন্দোলনের রুপরেখা প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু কতটা কার্যকর সেটা বাস্তবে প্রমাণ। 

যার ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি বড় দল নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাদের ওই লিফলেট কর্মসূচি প্রমাণ করে দলটি গভীর খাদে পড়ে গেছে। এ কথা দিয়ে বিএনপির দৈন্যতা, নেতৃত্বে দুর্বলতার কথা বলতে চেয়েছেন। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আরো অনেক কর্মসূচি নেয়া যেত। সেটা না করে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠান করা নির্বাচনটা বিএনপি যেভাবে বাসায় বসে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে সে উপভোগ করার সিদ্ধান্তটা কী বিএনপি নিজে নিয়েছিল নাকি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকের পরামর্শে করেছিল সে প্রশ্নটাও এখন উঠতে শুরু করেছে। তবে বিএনপির নিজস্ব চিন্তাভাবনাও রয়েছে। হয়তো সে দৃষ্টিকোন থেকে যেটা ভাল, সেটাই করেছেন। কিন্তু ওসব মারপ্যাচ সাধারণ মানুষ বুঝবেন কিভাবে? 

বিএনপির যে জনপ্রিয়তা সেটা তারা ইতিমধ্যে বহুবার দেখিয়ে ফেলেছে। ফলে এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও নির্বাচন কেন্দ্রীক অনেক কিছুই তারা করতে পারতো মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে, সেটা তারা করেনি। বরং নীরব দর্শক হয়ে অনেকটাই আওয়ামী লীগকে একটি ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা দিয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ শতভাগ সফলতা ঘরে তুলেছে। কিন্তু বিএনপি কে পেল। যে নির্বাচন ঘিরে দীর্ঘ অহিংস আন্দোলন করে বেড়িয়েছে তারা। সেখানে তো শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারেনি। ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল ধর্মঘট, অবরোধ না করলো কী। সবই তো করেছে। তাহলে আগে কেন নয়? শেষ মুহূর্তের নির্বাচনটা এভাবে সহজে পাস করানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়ার পেছনে বিএনপি কী কারোর পরামর্শ গ্রহণ করেছিল- সে প্রশ্ন নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে। 

অনেকেই এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কারাগারে ছিলেন। সেটা সত্য। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আড়াইশর উপরে। সেখানে ৭০-৮০ জনের মত নেতাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল, তাহলে বাকিদের ভূমিকা কী। কেন বাকিরা চুপ করে ঘরে বসেছিলেন। বড় প্রশ্ন। হরতাল, অবরোধের মত কঠিন কর্মসূচিতে সাধারণ কর্মীদের রাস্তায় ঠেলে পাঠিয়ে নেতাদের এমন কাচ ঘেরা ঘরে এসির বাতাসে সিক্ত হওয়ার কী অর্থ। নানা প্রশ্নে জর্জরিত সাধারণ নেতাকর্মী। এমন প্রশ্ন খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও। যে বিএনপি কিসের আশায় বসে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কেউ এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে? খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, বিএনপি মনে করছে অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। বিএনপি চোরাগলির পথ খুঁজছে ক্ষমতায় যেতে- এমন অনেক কথা। আওয়ামী লীগ নেতাদের সে কথাই কী তাহলে সত্য? 

সবশেষ

নির্বাচনের ঠিক পরপরই বিএনপি তাদের দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলেছে, হাতুরি পেটা করে তালা ভেঙ্গে। পুলিশ আগ থেকেই বলছিল, বিএনপি কেন তাদের অফিস খুলছে না সেটা তারাই জানেন। অনেকেই এখন মত প্রকাশ করছেন যে বিএনপি চাইলেই নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলতে পারতো। কিন্তু রহস্যজনকভাবে খুলেনি। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকা চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও বাসায় ফেরেন একই সময়ে। 

বিএনপি এখন নতুন করে আবার আন্দোলনের ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত। কিন্তু বড় ভয়, সাধারণ কর্মীদের আস্থা ফিরবে কিনা আন্দোলনের মাঠে। কারণ দীর্ঘ সময় রাস্তায় আন্দলোন সংগ্রাম করবেন তারা, আর পুলিশের মার, মামলা হজম করে নিজেদের ভবিষ্যত নষ্ট করবেন তারা, আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আসল সময় গা ঢাকা দেবেন। তৃণমূলের এমন মনভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বেশ শঙ্কায়ও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে হাস্যজ্জোল ছবি প্রকাশ করার অর্থ, কী বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা ফেরানো- যে মার্কিনীরা বিএনপির সঙ্গেই থাকবে। ভারত কাছে না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব কিছু ম্যানেজ করে দেবে এমনটাই কিনা সেটা কে জানে! 

শেয়ার করুন