২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৭:১৫:০৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


সংলাপ সমঝোতা নির্বাচনে বিএনপি’র না
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৩-২০২৩
সংলাপ সমঝোতা নির্বাচনে বিএনপি’র না


আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে কোনো ধরনের সংলাপে অংশ নেবে না দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। একই সাথে তাদের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে, কোনো ধরনের সমঝোতায়ও যাবে না বিএনপি। এর পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কারো অধীনে নির্বাচনেও অংশ নেবে না দেশের প্রধান বিরোধী দল। এসব ব্যাপারে বিএনপি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। বিএনপি’র প্রভাবশালী নেতাদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। 


জানা গেছে, সরকারের সাথে বিএনপি’র একটি গোপন চ্যানেলে দফায় দফায় আলোচনায় হয়েছিলো গত বছরের শেষের দিকে। এই আলোচনা চলছিল আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এতে বলা হয়েছিল, বিএনপি যেনো এবারো ২০১৮ সালের মতো একটি নির্বাচন করিয়ে নিতে সরকারের পাশে থাকে। এবং এটাই সরকার শেষ সুযোগ বলে একধরনের আলোচনা চালায়। এতে গ্যারান্টি দেয়া হয়, যে এ ব্যাপারে বিএনপি সরকারের পাশে থাকলে অতীতের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য আচরণ করা হবে দলটির’র সাথে। এমনটাই আশ্বাস দেয়া হয়।

এবং আলোচনাও চলে দীর্ঘদিন। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন সরকার ধরে নেয় যে, এবারো তারা ২০১৮ মতো একটি নির্বাচন করে ফেলবে। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে এখন বলা হচ্ছে সে সময়ে বিএনপি গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে অংশ নেয়। এবং এর বিনিময়ে অন্ততপক্ষে ৫০টি আসন দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথা শোনায় যায়। 


মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সব ভেস্তে যায়..

সরকারের হাই কমান্ড ধরেই নিয়েছিল, যে বিএনপি এবারো আরো কয়েকটা আসন নিয়ে চুপচাপ থেকে যাবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আরেকটি টার্ম ক্ষমতায় থাকাকে গোপনে সহায়তা করবে। তবে পরিস্থিতি এখন সরকারের প্রতিকূলে। বিশেষ করে ২০২১ সালে শেষের দিকের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। র‌্যাবের নিয়েধাজ্ঞা বিএনপি’র আন্দোলনে মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সে সময়ের সাবেক ও বর্তমান ৭ জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপরেও আওয়ামী লীগ সরকার ভেবেছিলো এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় আসলে দেশের রাজনীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু দেখা গেছে, ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতিতে একটি বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। তা হলো, সভা সমাবেশে সরকার আগের মতো কঠোর হচ্ছে না বা হতে পারছে না। বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর আরো অনেক আন্তর্জাতিক ঘটনা ঘটেছে এই মানবাধিকার ইস্যুতে। বয়ে গেছে অনেক ঝড় ঝাপটা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কোনো আশানুরূপ ফল পায়নি। ফলে বিএনপি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজনেতিক মাঠ বেশ চাঙ্গা করে ফেলেছে। ফলে বিএনপি’র একটি অংশ যেভাবে আরো একটি পাতানো নির্বাচন করে সরকারকে ছাড়পত্র দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা হোচট খায়। 

খালেদা জিয়ার না..

একটি বিএনপি ২০১৮ মতো আরেকটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে যেনো কোনো সুযোগ দিতে না পারে সেজন্য দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও বেকে বসেন। গত বছরে বিএনপি’র একটি প্রতিনিধি দল ঈদের পর খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি সরকারের সাথে কোনো ধরনের সমঝাতার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি করে দেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমানকে দেখা করতে গেলে তাদেরকে এসরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে অহিংস আন্দোলনের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। তিনি সেসময়ে প্রয়োজনে জামায়াতকে ত্যাগের পরামর্শ দিয়ে উদার বাম গণতান্ত্রিক বিশেষ করে আর্ন্তজাতিক পরিসরে যাদের রাজনৈতিক ইমেজ অসাম্প্রদায়িক তাদের নিয়ে বড়ো জোট করার নির্দেশ দেন।

জানা গেছে, সেভাবেই এখন দল চলছে এবং এর পাশাপাশি আন্দোলন হচ্ছে। সেজন্য অনেকে মনে করেন যে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে খালেদা না শুনতে পাওয়াটাও একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছে দলের ভেতর বাইরে। এবং বলা চলে বিএনপি এখন সরকারের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতায় না-তেই আছে। এর পাশাপাশি সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। এবং বিএনপি’র সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের পরও শুণ্য আসনে দলের কেউ অংশ নেননি। গত বছরে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে আয়োজিত বিএনপির সমাবেশ থেকে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপির ৭ সংসদ সদস্য (এমপি)। ৭ এমপি হলেন, বগুড়া-৬ আসনের এমপি গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, বগুড়া-৪ আসনের এমপি মোশারফ হোসেন, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের এমপি জাহিদুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের এমপি আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের এমপি হারুনুর রশীদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের এমপি আবদুস সাত্তার ভূঞা এবং সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি রুমিন ফারহানা।

সংলাপ ও নির্বাচনে না..

এদিকে বিএনপি সরকারের সাথে কেনো ধরনের সংলাপের ব্যাপারেও না’তেই আছে। এর পাশাপাশি কোনো ধরনের নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না বলেই কঠোর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বক্তব্যে এমন কঠোরতা এর আগে দলটির পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপি’র বুঝে ফেলেছে তারা আন্দোলন না করলেও বৈশ্বিক কারণে সরকারের অবস্থা এখন অনেক দুর্বল। অন্যদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থা এবারের নির্বাচন নিয়ে কঠোর অবস্থান থাকার কথা বলেছে। এমনকি সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত দুই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হবার অভিযোগ তুলে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে আসছে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চায় ২৭ দেশের এই জোট। ১৬ ফেব্রুয়ারি সেই ইচ্ছার কথা চিঠি লিখে জানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে। ঐদিনই ঢাকার ইইউ প্রধানসহ জোটের অন্যান্য রাষ্ট্রদূতরা বৈঠক করে আওয়ামী লীগের সাথে। এর আগে জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকে, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও কারিগরি সহযোগিতার কথা জানায় ইইউ। আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক, এটাই চান তারা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার বিএনপির সাথে বৈঠক করেছিল ইইউ। গত ১২ মার্চ ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধানের বাসায় হওয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জোটের অন্যান্য রাষ্ট্রদূত। যেখানে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলেন ধরেন ইইউ প্রধান। শোনেন বিএনপির কথাও। তাদের মুখে সব শুনে অপ্রত্যাশিতভাবে এসময় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না জানিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাই বিএনপি মনে করে তারা সব দলমতকে নিয়ে অংহিস অবস্থায় থাকলে সরকার চাইলেই আগের মতো কিছু করতে পারবে না। কেননা বিএনপি মনে করে এবার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এটা বোঝাতে পেরেছে বিএনপি’র সাথে এখন আর জামায়াতের মতো কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি নেই। কেননা এর আগে দেশে বিভিন্ন ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপি’র বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতকে নিয়ে অগ্নি সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু এবার এধরনের অভিযোগ আনা সম্ভব হচ্ছে না বিএনপি’র বিরুদ্ধে। 

এদিকে ১৬ মার্চ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার বাসায় নৈশভোজে অংশ নিয়ে তার সাথে বৈঠক করেন দলটির ৫ নেতা। তারা হলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ। বৈঠকের একটি সূত্র জানায় বিএনপি’র সাথে ভারতীয় হাই কমিশনের সাথে বৈঠকে জামায়াতের সাথে বিএনপি’র সর্ম্পকের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে বলে শোনা যায়। বলা যায় বিএনপি’কে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে জামায়াতের সাথে সর্ম্পকের বিষয়টি। তাই গোপনেও জামায়াতের সাথে এখন আর সর্ম্পক নেই বলেও বারবার বিএনপি’র পক্ষ থেকে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে বলতে হয়েছে। বরং সরকারের সাথেই জামায়াতের মতো শক্তি আছে বলে তাদের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। জানানো হয় অতীতে জামায়াত নিয়েই আওয়ামী নির্বাচন করেছিল। 

শেষ কথা..

বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে কোনো ভোটে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপি অটলের সর্বশেষ উদারহরণ হচ্ছে আসছে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে। এব্যাপারে কিছু ভাবছে না দলটি। শুধু তাই নয়, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে অতীতের চেয়ে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা। বলা হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কোনো নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করলে দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সে সময় অন্তত ৫০ থেকে ৭০টি আসন দেয়া হবে। এ গ্যারান্টি এসেছিল সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি একেবারে খালি হাতেই এসেছে। এরপরও এ সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয় তারা। কিন্তু নির্বাচনে নানা অভিযোগ ও অনিয়ম এনে ২০২১ সালের মার্চ থেকে এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিনই বলে যাচ্ছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি আর কোনো ছাড় দেবে না। এ দেশের মানুষের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা এই সরকারের পতন চায়। তাই আন্দোলনের মাধ্যমেই এদের বিদায় করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিএনপি’র এধরনের বক্তব্য আগের চেয়ে ভিন্ন ঠেকছে তাদের কাছে। তাদের মতে, বিএনপি এবার দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কারণেও বেশ ইতিবাচক অবস্থানে আছে। তাছাড়া অতীতের মতো সরকারের সাথে যেকোনো ধরনের সমঝাতায় গেলে বা অবস্থান নিলে বিএনপি’র নিশ্চিন্ন হওয়ারও শঙ্কা আছে। এর পাশাপাশি দলে ব্যাপক ভাঙ্গনে দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে মাত্র কয়টি আসনের জন্য সমঝোতায় গিয়ে দলটির কোনো ধরনের বিপযয়ই ঠেকাতে পারবে না।  আর সেকারণে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে কোনো ধরনের সংলাপ, সমঝোতা কিংবা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে বলে দলের নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা যায়।

শেয়ার করুন