২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৬:০১:৪৪ পূর্বাহ্ন


তুমি রবে হৃদয়ে মম..
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৪-২০২৩
তুমি রবে হৃদয়ে মম.. আলহাজ গিয়াস উদ্দিন


গত ১০ এপ্রিল ছিল ব্রঙ্কসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, স্টারলিং বাংলা বাজার বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, বাংলাবাজার জামে মসজিদের সভাপতি আলহাজ গিয়াস উদ্দীনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ঘাতক কোভিড শুরুতেই তার জীবনটা কেড়ে নেয়।

নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাস শুরুর দিকে  সবাই পাগলের মত বাজার করে ঘরে জিনিসপত্র স্টক করছিল। অনেক ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম যে যার মতো বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রঙ্কসে গিয়াস ভাইয়ের ছিল বিরাট ডিসকাউন্ট স্টোর। প্রচুর মালের মজুদ গড়ে তুলে ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম তিনি বাড়াননি। বিশেষ করে ন্যাপকিন, টিস্যু পেপার, হ্যান্ড সেনিটাইজার, মাস্ক, পানির প্রচুর মজুদ করেছিলেন। আমাকে বলতেন সাপ্লাই কমে গেছে। বেশি দাম দিয়ে কিনছি। কিন্তু তারপরও আমি আগের দামেই বিক্রি করছি। লাভ না হয় না হলো, লোকসান তো হচ্ছে না! মানুষের এই বিপদের সময় তাদের ওপর তো জুলুম করতে পারি না!

১৮ মার্চ গিয়াস ভাই আমাকে কল দিলেন। বললেন, হাবিব ভাই তাড়াতাড়ি আসেন। আমার এখানে রিপোর্ট করতে সাংবাদিক এসেছে। নিউইয়র্ক পোস্টের দুই জন সাংবাদিক এসেছিল সেদিন। Georgette Robert এবং Natalie Musumeci- তারা অনেকক্ষণ ছিলেন। দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কথা বললেন। ছবি তুললেন। গিয়াস ভাই তাদের বললেন, আমার গুদামে আরো স্টক আছে। এসব নিত্যপণ্য দ্রব্য আমি ন্যায্য দামে জনগণের কাছে বিক্রি করবো। মুনাফাখোরি করবো না।

২০ মার্চ  নিউইয়র্ক পোস্ট তাদের পত্রিকায় একটা বিশাল রিপোর্ট ছাপে। দোকান ভর্তি নিত্যপণ্য দ্রব্যের ছবিসহ। শিরোনাম ছিল ‘Bronx Shop flush with Toilet paper while big store, wipes clean corona virus out break’। নিউজে ছিল গিয়াস ভাই এর প্রশংসা। পত্রিকাটা হাতে পেয়েই আমাকে ফোন। বললেন- হাবিব ভাই, তাড়াতাড়ি আসেন দেখেন আপনার গিয়াস ভাইকে নিয়ে পত্রিকায় কি লিখেছে!

যাওয়ার পর তার থেকে একটা কপি নিলাম। বললাম, এই সততার স্বীকৃতি আপনার একার নয়। আমাদের পুরো কমিউনিটির। নিউজটা আমি বাংলা পত্রিকায় ছাপবো। পরিস্থিতির কারণে পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ হয়ে যায়। ৩০ মার্চ গিয়াস ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। নিউজটা আমি আর ছাপতে পারিনি।

হাসপাতালে যাবার একদিন আগে আমাকে আবার কল। গেলাম, ইনি নিজের বসার জন্য আলাদা  একটা বিরাট অফিস নিয়েছেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। দেওয়ালে ঝোলানো তার অসংখ্য ক্রেস্ট, অ্যাওয়ার্ড, পত্রিকার রিপোর্ট ইত্যাদি। বললাম, এই অফিসটা আমরা জম্পেশ করে উদ্বাধন করবো। বড় পার্টি দিতে হবে। গিয়াস ভাই হাসলেন। অফিসটা আর উদ্বোধন হয়নি। তার আগেই তিনি নিয়তির ডাকে হারিয়ে গেলেন।

আসার সময় গিয়াস ভাই আমাকে ডেকে বললেন- হাবিব ভাই, আমার একটা ছোট্ট উপকার করে দিতে হবে। জানতে চাইলাম কি উপকার। তিনি তার অফিসের ড্রয়ার থেকে একটি ক্রেস্ট এবং একটি  সাইটেশন বের করে আমার হাতে দিলেন। ক্রেস্টটি টাইম টিভির আর সাইটেশনটি কাউন্সিল মেম্বার রাফায়েলের দেওয়া। দুটিতেই তার নামের বানানে একটা অক্ষর ভুল আছে। আমি বললাম, ভাববেন না। আমি ঠিক করে এনে দিব। গিয়াস ভাই নেই। ক্রেস্টটি ঠিক করে এনেছিলাম। কিন্তু এটি আর তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তার আগেই অজানার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি আমাদের থেকে দূরে সরে গেলেন।

গিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে  আমার সর্বশেষ ছবিটি তোলা হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নবীর শহর মদিনায়। এক প্রকার জোর করেই তিনি এই ছবিটি তোলেন। আমার সঙ্গে এই ছবিতে ছিলেন খলিল বিরিয়ানি হাউজের স্বত্বাধিকারী শেফ খলিলুর রহমান, টাইম টিভির সৈয়দ ইলিয়াস খসরু, এ আজিজুল হক। গিয়াস ভাই বললেন, নবীর শহরে আমরা সবাই আর কোনোদিন এক সঙ্গে হবে কি না নিশ্চয়তা নেই। আসুন, স্মৃতিটুকু ধরে রাখি। সেদিন জানতাম না এই ছবিটা একদিন স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে।

সেদিন আমার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন গিয়াস ভাই। বারবার বলেছিলেন তার স্বপ্নের কথা। কীভাবে তার মসজিদটি ৬ তলা করবেন তার কথা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অনেকগুলো বাড়ি কোনো কিছুই তার কম ছিল না। শেষ সময়ে তার একটাই চিন্তা ছিল কীভাবে মসজিদটি তিনি একটি সুরম্য ভবনে পরিণত করবেন। তার এই স্বপ্ন পুরণে কিছু লোক বাধা সৃষ্টি করেছিল এটাই ছিল তার মনের এক গোপন কষ্ট। সেদিন মনের আগল খুলে, মন উজাড় করে মসজিদ নিয়ে তার মর্ম বেদনার কথা বলেছিলেন আমাকে।

করোনাকে দূরে সরিয়ে কমিউনিটিকে নিরাপদ রাখার জন্য আলহাজ গিয়াস উদ্দীন  নির্ভয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজান দিতেন। ঘরে আবদ্ধ না থেকে ঘুরে ঘুরে সবার খোঁজখবর নিতেন। করোনা যুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন সম্মুখসারির সেনাপতি। দুর্ভাগ্য সর্বগ্রাসী করোনা ছিনিয়ে নিলো আমাদের সেনাপতিকেই। গিয়াস ভাই এতো তাড়াতাড়ি তো আপনার যাওয়ার কথা ছিল না! এতো স্বপ্ন আপনি বুকে লালন করেছিলেন এগুলো আপনি বাস্তবায়ন না করেই কেন চলে গেলেন। আপনার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে আমাকে সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলেন। আমিও কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু কেন আপনি হারিয়ে গেলেন এমনি অবেলা আর অসময়ে যখন বিদায়বেলায় আপনার মুখটাও একবার দেখার সুযোগ আমাদের ছিল না। এ কেমন চলে যাওয়া গিয়াস ভাই?

কমিউনিটির প্রিয় মুখ আলহাজ গিয়াস উদ্দীনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ওপারে ভালো থাকবেন গিয়াস ভাই।

শেয়ার করুন