২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১১:৫১:৩৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


বৈশ্বিক ভূরাজনীতির চারণভূমি হবে না তো বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৫-২০২৩
বৈশ্বিক ভূরাজনীতির চারণভূমি হবে না তো বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ছিল অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি কৌশলগত সফর।


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য তিন দেশে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফর শেষে ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন। লন্ডনে নতুন ব্রিটিশ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সফরের প্রথম দেশ জাপান সফর ছিল অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি কৌশলগত সফর। স্বাধীনতা শুভ লগ্ন থেকেই জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু দেশ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী এই জাপান। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রভাব কম-বেশি আছে, সেটি অনস্বীকার্য। বিশেষত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বৃহৎ প্রতিবেশীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্ট। তথাপি বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জন দেশের উন্নয়ন মহাযজ্ঞে চীন, ভারত, রাশিয়া, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিভিন্ন মতো এবং পথের দেশগুলোকে সম্পৃক্ত রাখা। একইভাবে বাংলাদেশের বিশাল দৃশ্যমান উন্নয়ন এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। 

তবে বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে, বৈশ্বিক রাজনীতি সুস্পষ্টভাবে দ্বিধাবিভক্ত।  এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল বিশেষত ভারত মহাসাগরীয়  অঞ্চলে চীন-ভারত, চীন-জাপান নানামুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। তদুপরি, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে বিশ্ব এখন দুই পরাশক্তির ছায়াযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন-ইরানসহ কিছু দেশ। বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে ক্রম বর্ধমান চীনা আধিপত্য বিকাশকে খর্ব করতে নিরন্তর প্রয়াসে পশ্চিমা শক্তি। জাপান বা বাংলাদেশ কিন্তু কোনো অক্ষ শক্তির অংশীদার নয়। তথাপি, উভয় দেশের ওপর প্রচণ্ড চাপ আছে চীনবিরোধী শিবিরে যোগদানের।

এদিকে বাংলাদেশে বর্তমান সরকার পরপর তিন বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। দীর্ঘ এ সময়ে দেশে এবং বিদেশে সরকারের শাসনব্যবস্থা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত আছে। ২০২৩ শেষ বা ২০২৪ সূচনায় পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। ঐ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বিগত সময়ের ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নানা কারণে স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক আছে।   

এমনি যখন অবস্থান, তখন জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য, অর্জন নিয়ে বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। জাপান সফরের কথাই ধরুন। সেখানে দুই দেশ নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বলে ঘোষণা করেছে। সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ঘোষণা করেছে। সবার জানা আছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ঘোষণার কূটনৈতিক তাৎপর্য নানাভাবেই বিশ্লেষণ করা যায়। তবে বাংলাদেশ ঘোষণায় আছে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং ব্যবহারে সব দেশ আনক্লস বিধি মেনে চলবে এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী বাংলাদেশ। জানি না, এই অবস্থান বাংলাদেশের ওপর উন্নয়ন সহযোগী চীন কীভাবে নেবে। তবুও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে চীনের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত বলেছেন ঐ (প্যাসিফিক পলিসি) ঘোষণা তাদেরও কিছু কিছু বিষয়ের মতের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন।

তবে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে জাপানের সঙ্গে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রধান বিষয়টি হলো জাপানিজ আর্থিক সহায়তায় মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা। স্মরণীয় যে জাপান বহুদিন থেকে বিগ-বি কৌশলগত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তরপূর্ব ভারতের ৮টি ভূমিবেষ্টিত প্রদেশসহ নেপাল-ভুটানের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল। এটিকে কিছু মানুষ চীনবিরোধী কর্মকাণ্ড বলে প্রচার করছে। 

যখন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে ওঠে সেটি কিন্তু আঞ্চলিক বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর এবং কলম্বো বন্দর ব্যবহার করেছে। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হবে। তবে সেখানে কিছুটা পরিবেশগত এবং চীন-ভারত কাদের দিয়ে নির্মাণ করা হবে সেই দোদুল্য মানতার কারণে হয়নি। জাপান প্রথমে জাইকার মাধ্যমে মাতারবাড়িতে ২য়  ১২০০-২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করে। কয়লা পরিবহনের জন্য মাতারবাড়ি থেকে গভীর সমুদ্র পর্যন্ত একটি ২৫০ মিটার, প্রস্থ  ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৮.৫ মিটার গভীর চ্যানেল খনন করা হয়। এখন এই চ্যানেল ৩৫০ মিটার প্রশস্থ করে দুই পাশে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর। বাংলাদেশ সেখানে জ্বালানি বিদ্যুৎ হাব গড়ে তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি ভূমিবেষ্টিত প্রদেশসহ নেপাল, ভুটান এমনকি চীন, মায়ানমারসহ অন্যান্য দেশের ব্যবহার সুবিধা। 

এই কাজে জাপান বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আমি প্রযুক্তিবিদ। তবে অর্থনীতি বিষয়ে কিছুটা ধারণা আছে। আমি এই কৌশলগত অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিছু দেখি না। মনে রাখতে হবে, জাপান কিন্তু বাংলাদেশের মেট্রোরেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণেও আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে। এই যাত্রাপথে জাপানিজ বিশেষজ্ঞদের ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও ওরা পিছিয়ে যায়নি। আমি কিছু মানুষের স্বভাবগত বিরোধিতা বিষয়ে মন্তব্য করবো না। আমি মনে করি, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর সফল হয়েছে। 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিল মূলত বিশ্বব্যাংকের প্রধানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে যোগদান। সেখানে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ নেতৃত্ব বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার এবং চুক্তি করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অর্থে নির্মিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি রেপ্লিকা বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধির হাতে তুলে দিয়েছেন। স্মরণীয় যে সেতুর বাস্তব কাজ শুরু হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তা প্রদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগে। যেটি পরে কানাডার আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনায় দুটি বৈষয়িক সংস্থার অংশীদারিত্ব শেখ হাসিনা সরকাকরের কূটনৈতিক সাফল্য বলে ধরে নেওয়া যায়। একই সঙ্গে সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের বাংলাদেশের নির্বাচনকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুটি শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানির (এক্সন মোবিল এবং শেভ্রন) শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলাদেশে জলে এবং স্থলে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের বিষয়ে তাদের স্বতঃপ্রণোদিত প্রস্তাব বিষয়ে কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী সাধারণভাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবু দেখতে হবে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণ করার পর্যায়ে যেন প্রতিপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বী না বানিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ যেন ভূরাজনীতির চারণভূমি না হয়ে পড়ে। 

শেয়ার করুন