২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১১:৪৩:০১ পূর্বাহ্ন


জ্বালানি সেক্টরের একাল-সেকাল
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৮-২০২৩
জ্বালানি সেক্টরের একাল-সেকাল


বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম জানে কীভাবে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বনির্ভর দর্শনে স্থাপিত বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে পেট্রোবাংলাকে আগ্রাসী আমলাতন্ত্র সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্বল, অকার্যকর করে ফেলেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর তাবেদাররা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু জ্বালানি দর্শনের উল্টোপথে চলেছে জ্বালানি সেক্টর। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মূল্যবান কয়লা সম্পদ মাটির নিচে পড়ে আছে, স্থলভাবে ২/৩ অংশ এবং বিশাল সমুদ্র প্রায় পুরোটায় সম্ভাব্য গ্যাস তেল সম্পদ অনুসদ্ধান হয়নি। তীব্র জ্বালানি সংকটে দেশ হাবুডুবু খাচ্ছে। ২০২৩ জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবসের (৯ আগস্ট) প্রাক্কালে এসে আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে কেন পেট্রোবাংলা পেট্রোনাস বা পের্টামিনা হতে পারলো না?  

স্বাধীনতার মহান স্থপতি তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টি থেকেই দেশের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট, নিজেদের জ্বালানি সম্পদের ওপর আপামর জনসাধারণের মালিকানা নিশ্চিত করেছিলেন। নিজেদের জ্বালানি সম্পদ অনুসদ্ধান, আহরণ এবং ব্যবহার করে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শিল্পনির্ভর করার পটভূমি রচনা করেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন বাংলাদেশ অয়েল, গ্যাস মিনারেল করপোরেশন (বিওজিএমসি, বাংলাদেশ মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএমডিসি)। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। নিজের ব্যাপক হোমওয়ার্কের ভিত্তিতে দেশ বরেণ্য বিশেষজ্ঞদের সংস্থাসমূহের প্রধান করে সংস্থাসমূহকে প্রধান শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানের কারণেই ১৯৭২-১৯৭৫ স্বল্পসময়ে সম্ভব হয়েছিল অন্যতম বিশ্বসেরা জ্বালানি কোম্পানি শেল বিভি থেকে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন মূল্যে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা আবিষ্কৃত গ্যাসফিল্ড কিনে নেয়া। শুরু হয়েছিল কয়লা এবং খনিজ পাথর অনুসন্ধান কাজ। স্বল্পতম সময়ে ইন্দোনেশিয়ার মডেল অনুসরণ করে প্রণীত হয়েছিল মডেল উৎপাদন বণ্টন চুক্তি। উপমহাদেশে বাংলাদেশ প্রথম সাগরে তেল অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক পুঁজি করে বিপুলসংখক মেধাবী বাংলাদেশির উচ্চ কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের জন্য পূর্ব ইউরোপ, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া পাঠিয়েছিলেন। অনেকেই দেশে ফিরে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর স্বল্প সময়ে পেট্রোবাংলা এবং বিএমডিসির স্ট্যাটাস খর্ব করা হলো। সামরিক, বেসামরিক আমলাদের উল্লম্ফনে খাঁটি পেশাদার ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়লো। তবুও ৭০, ৮০, ৯০ দশকে পেট্রোবাংলা জ্বালানি নিরাপত্তায় বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯৬-২০০১ সময়টা ছিল জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের স্বর্ণযুগ। দেশের গ্যাস সেক্টর বিদ্যুৎ সেক্টর সমন্বিতভাবে কাজ করে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিল। যদিও এরই মধ্যে সাইপেম সিনড্রোম, সিমিটার কেলেঙ্কারি, মাগুরছড়া বিস্ফোরণ ঘটানোর পরেও মার্কিন কোম্পানিকে অযাচিত ছাড় দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। 

২০০১-২০০২ আমলা, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পুনর্বাসন শুরু হয়েছিল প্রচণ্ডভাবে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে। এই সময় সুযোগ ছিল কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বনির্ভর জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়ার, তেল গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর। কিন্তু ঐ সময়ে দুর্নীতির মহীরুহ শুধু দেশটিকেই সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত করেনি, একই সঙ্গে জ্বালানি বিদ্যুৎ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত করেছে। 

২০০৮-২০২৩ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও আমলাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে জ্বালানি উন্নয়নে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বিপুলভাবে ধ্বংস হওয়ায় দেশজুড়ে এখন জ্বালানি সংকট। ২৫ হাজার মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ১৪০০০-১৫০০০ মেগাওয়াট চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এক সময়ের ৯০ শতাংশ নিজস্ব জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ খাত এখন ৬০ শতাংশ আমদানি জ্বালানি নির্ভর। ডলার সংকটে কয়লা, তেল, এলএনজি আমদানি ব্যাহত। পেট্রোবাংলা, পিডিবি, বিপিসি দেউলিয়া হবার মুখে।  

বঙ্গবন্ধুর স্বনির্ভর জ্বালানি দর্শনের একমাত্র অর্জন শতকরা শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা, সেখানেও কিন্তু ঢাকার বাইরের মানুষ নিয়মিত লোডশেডিংয়ে ভুগছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সোনার মানুষগুলো আর জ্বালানি সেক্টরে সম্পৃক্ত নেই।

শেয়ার করুন