২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:৫৫:২৮ পূর্বাহ্ন


সিইসি’র মন্তব্যে বেকায়দায় সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৫-২০২৩
সিইসি’র মন্তব্যে বেকায়দায় সরকার নির্বাচন কমিশন ভবন


দেশে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের পাশাপাশি আরো কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্য একিই সাথে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কেনো কি কারণে খোদ সিইসি এসময়ে এধরনের বক্তব্য দিলেন তা নিয়ে রীতিমত তোলপাড় চলছে ক্ষমতাসীন মহলে। সারাদেশে পাচটি সিটি কর্পোরেশেনের নির্বাচনের আয়োজন চলছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত ৩ এপ্রিল পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সিটি কর্পোরেশনগুলো হলো গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট। তফসিল অনুযায়ী, গাজীপুরে ২৫ মে, খুলনা ও বরিশালে ১২ জুন এবং রাশাহী ও সিলেটে ২১ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কি বলছে সিইসি ও তার কর্মকর্তারা..

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা মাত্র কয়েকদিন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের একটি মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পরীক্ষা নিতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। বিএনপির উদ্দেশে ইসি আলমগীর বলেন, সব সময় আমাদের আহ্বান থাকবে-আপনারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন, আমাদের পরীক্ষা নিন। আমরা পরীক্ষা দিতে সব সময় প্রস্তুত। আপনারা তো আমাদের পরীক্ষাই নিচ্ছেন না। পরীক্ষা না নিয়েই আপনারা কীভাবে বুঝলেন যে আমরা অকৃতকার্য হলাম? তার এমন মন্তব্যে অনেকের ধারণা করেছিলো যে দেশে প্রথম আইন দ্বারা গঠিত এই নির্বাচন কমিশন হয়তবা অনেক শক্ত অবস্থানে আছেন-এমন বার্তারই তার বহি:প্রকাশ। 

রাশেদা কি করে এটা বললেন?

এদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে নির্বাচন আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা। আবার এর পাশাপাশি বিএনপি না এলেও নির্বাচন প্রতিদ্বদ্বিতাপূর্ণ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কি বলেন..

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনী আচরণ ভঙ্গকারীদের শাস্তির আওতায় আনার বিষয়ে বলেছেন, ‘লোম বাছতে গিয়ে যদি কম্বল উজাড় করে ফেলি, সেটা খুব বাস্তবসম্মত হবে না।’ তিনি আরো বলেন, সরকারের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে তবে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এককভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন। সিইসি বলেন, আমরাও স্বীকার করেছি এবং আমরাও জোর দিয়ে বলেছি-আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সরকার বিদ্যমান থাকবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা অবশ্যই প্রয়োজন হবে। তাদের সদিচ্ছা ছাড়া অবাধ নির্বাচন কঠিন। আমরা বলেছি নির্বাচন কমিশন এককভাবে কখনোই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না, যদি সংশ্লিষ্ট সবাই প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এবং একই সঙ্গে সরকারের যে প্রশাসন, পুলিশ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা না করে। এতে নির্বাচন কমিশনের যে দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা, তা সীমিত হয়ে পড়তে পারে। এটা আমরা উনাদের বলেছি। এর মাত্র কয়েকদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, গাজীপুরে যে নির্বাচনটা হবে এটার গুরুত্বটা নির্বাচন কমিশনের কাছে অত্যাধিক। কারণ আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এর আগে খুব বড় পরিসরের একটা নির্বাচন জাতীয়ভাবে অনেক গুরুত্ব বহন করবে বলে আমরা মনে করি।

কি বোঝাচ্ছেন সিইসি...

দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ আছে আন্তর্জাতিক মহল থেকেই। অন্যদিকে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধীদল। বিরোধী দলের চাওয়ার থেকেও সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিকে। কারণ সরকারের ভেতরে তার বিভিন্ন ধরনের সহযোগিদের একটা চাপ আছে র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষটি। ২০২১ এর ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সর্বশেষ বাংলাদেশে পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন র‍্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ’ঘাবড়ানোর কিছু নেই’ বলে মন্তব্য করে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এতে কোনো লাভ হয়নি। পর্দার আড়ালে অনেক দেন-দরবার করা হলেও ক্ষমতাসীন সরকার যে খুব একটা লাভ করতে পেরেছে-তা কিন্তু না। সরকারের ভেতরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যেমন একটা চরম অস্বস্তি আছে। তেমনি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারেও তীব্র চাপ অনুভব করছে সরকার। কোনো ভাবেই কাউকে ম্যানেজ করে যে এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো একটি নির্বাচন ক্ষমতাসীনরা করে নিতে পারবে না তা কিন্তু স্পস্ট। সেক্ষেত্রে সারাদেশে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জই ছিলো। তবে এই নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক মাঠে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি না অংশ নেয়াতে সে চ্যালেঞ্জটা সরকার দেশে বিদেশে দেখাতে পারছে না। পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ হলো কি না হলো তা নিয়ে দেশে বিদেশে যে খুব আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বলে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে- বাস্তবে তা-ও না। কারণ এই নির্বাচনে বিএনপি’কে সরকার মাঠে আনতে পারেনি। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল পাশাপাশি আরো কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যে সরকার বেকায়দায় পড়েছে। তাদের মন্তব্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে এই ইসির পক্ষে কি আসলেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব? তারা কি সস্পূর্ণ স্বাধীন নিরপেক্ষ থেকে কাজ করতে পারবেন? কেননা এতোদিন বলা হয় যে এই নির্বাচন কমিশন একটি আইন দ্বারা গঠন করা হয়েছে-যা দেশে এই প্রথম। যদিও বলা হয়ে থাকে আকস্মিকভাবে বর্তমান কমিশনের মেয়াদপূর্তির ২০-২২ দিন আগে মন্ত্রিপরিষদের সভায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২’ শিরোনামে একটি আইনের খসড়া অনুমোদিত হয় এবং অতি দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ইসির মেয়াদপূর্তির ১৮ দিন আগে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হয়েছে। তবে বহুদিন ধরে কমিশনারদের নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করার দাবি করা হচ্ছিল। তারপরেও ধরে নেয়া হয়েছিল এই ইসি অগের চেয়ে অন্যরকম হবে। কিন্তু সম্প্রতি খোদ সিইসি ও তাদের বেশ কয়েকজনের মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণ ছাড়াও আর্ন্তজাতিক মহলে বেশ আলোচনার ঝড় বইছে। কারণ একদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পরীক্ষা নিতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানালেন। আবার আরেকজন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি না এলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রাশেদার বক্তব্যকে অনেকে বলেছেন তিনি চান বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। নাকি আন্তর্জাতিক মহল যে চাচ্ছে বিএনপিসহ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হউক-সেটা এই নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানার পছন্দ না। তবে সবার শেষে সিইসি’র বিস্ফোরক মন্তব্যও আলোচনার ঝড় তুলেছে। তিনি বলেছেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সরকার বিদ্যমান থাকবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা অবশ্যই প্রয়োজন হবে। তাদের সদিচ্ছা ছাড়া অবাধ নির্বাচন কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে সিইসি আসলে কি বোঝাতে চান? সরকার না চাইলে তিনি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন না? আইন দ্বারা গঠন করা হলেও ইসি এখনো পুরোপুরি সক্ষম না একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গিয়ে কি তিনি চাপের মুখে আছেন? নির্বাচন কমিশনের কি হাত পা বাধা? রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন প্রসঙ্গে খোদ সিইসি’র এমন বক্তব্য সরকারকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলবে। সেক্ষেত্রে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক-বিএনপি পক্ষ থেকে এমন দাবির পক্ষেই সিইসি’র মন্তব্য কি-না সেটাও সরকারকে ভাবাচ্ছে।

শেয়ার করুন