২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৪:২২:৫২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


সংকট চারদিক থেকে ঘনিয়ে আসছে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৬-২০২৩
সংকট চারদিক থেকে ঘনিয়ে আসছে


বর্তমান সরকার ক্রমান্বয়ে  তিন টার্মে দেশের খোল নলচে পাল্টে দিয়েছে বলতেই হবে। কিন্তু উন্নয়ন কতটা টেকসই হয়েছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হচ্ছে এখন। আর্থিক সংকটে সরকার অত্যাবশ্যকীয় খাতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আমদানি করার অর্থ নেই এলএনজি, কয়লা, জ্বালানি তেলের। বকেয়া পড়েছে তেল কেনার জোগানে বিপিসির, কয়লা আমদানি বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট, আইপিপিগুলোর বিপিডিবির দেনা বাড়ছে। চলমান গ্রীষ্মকালে পিক চাহিদার সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছে, গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখানাসমূহ উৎপাদন চালু রাখার সংকটে। সরকারের চলতি টার্মে শেষ বাজেট ঘোষণা করেছে ঠিকই, কিন্তু এখানে একটু চোখ বুলালেই দেখা যাবে যে, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। এরই মধ্যে নির্বাচন অর্থবহ, নিরপেক্ষ আর গ্রহণযোগ্য করা নিয়ে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ভিসা-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ মোড়কে নিষেধাজ্ঞার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে। ২০২৬ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ডেটলাইন। শুরু হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদসহ বিপুল ঋত পরিশোধের দায়।

সব মিলিয়ে ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে সংকট চারদিক থেকে  

আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বা এমন বিদ্বেষ ছড়ানোরও কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতাকে স্বীকার না করে উপায় কি? দীর্ঘদিন ধরেই বলছি, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ভ্রান্ত বাস্তবায়ন কৌশলের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নাজুক হয়ে পড়বে। এমনিতেই সরকার অনেক প্রচেষ্টায় সমস্যাসংকুল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নিয়েও করোনা অতিমারি অনেক দেশের থেকেও ভালো সামাল দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু ভুল পরিকল্পনায় নিজেদের প্রাথমিক জ্বালানি অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন অবহেলা করে ক্রমাগত আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে ধাবমান হয়ে এখন ডলার সংকটে গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি তেল আমদানি করতে সংকটে পড়েছে। গ্রীষ্মের তীব্র দহনের সময় অসহনীয় লোডশেডিং জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়ার উপক্রম। 

ভুল পরিকল্পনা বলছি এই কারণে যে, বিপুল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যখন সরকার চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করতে পারছে না, তখন অনেক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট অলস বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে গ্রামগুলোকে বঞ্চিত রেখে শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এখন কিন্তু ঢাকাসহ মহানগরগুলোতেও নিয়মিত লোডশেডিং। ২০০৯ সূচনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শুরু করে যে সংকট উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল বর্তমান সরকার, এখন ২০২৩ জুন মাসে ২৩ দশমিক ৩৭০ মেগাওয়াট গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও সংকট খুব একটা ভিন্নতর নয়। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের সংখ্যা ১৫৩। সোমবার ২৯ মে জ্বালানির অভাবে এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎপাদনে ছিল না ৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। উৎপাদনে না থাকলেও অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ  করতে হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারকে পরিষদ করতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।  বাজেটে বিপুল ভর্তুকি দেওয়ার পরও বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে নিজেদের ব্যর্থতার দায় সরকার চাপিয়ে দিচ্ছে ভোক্তাদের ওপর। 

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২৪-২৯ মে ২০২৩ আনুমানিক ৪ হাজার ২৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অলস থেকেছে জ্বালানির অভাবে, যা উৎপাদন ক্ষমতার ১৮ শতাংশ। এর পাশাপাশি ২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার প্ল্যান্টসমূহ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণে আছে। অবশিষ্ট ১৭ হাজর মেগাওয়াট ক্ষমতা দিয়ে দিয়ে দিনে উৎপাদিত হয়েছে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আর রাতে ১৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। 

দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মোট উৎপাদনের ৪৭ শতাংশ-১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। পেট্রোবাংলা কয়েকদিন যাবৎ ১১০০-১২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করেছে। তার পরেও বিপিডিবি ৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। 

ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেল-ভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু জ্বালানি তেল আমদানি সংকটজনিত কারণ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মূলত পিক সময়ে চালনার কথা থাকায় উৎপাদন করেছে ৩ হাজার ৮০৬ মেগাওয়াট। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। উৎপাদন করা হচ্ছে ২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট।

ডলার সংকটে কয়লা কিনতে সমস্যায় পড়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়েরা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইতিমধ্যেই ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি বর্তমান অবস্থায় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। 

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান দৈনিক লোডশেডিং ২ হাজার  মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। গ্রীষ্ম যত উষ্ণ হবে লোডশেডিং তত বাড়বে। যদি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ ২০২০ নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে জোগান দেওয়া যেত, তাহলেও কিছুটা সহায় হতো। সেখানেও বাস্তবায়ন কৌশলের অভাবে ব্যর্থতা। 

বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশে বাছবিচার না করে আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে দ্রুত ঝুঁকে পড়া বিলাসিতা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির চাপ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আঞ্চলিক, বৈষয়িক ভূরাজনীতির কারণে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক পরিণতি। 

স্মরণে রাখতে হবে, তরল জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০১০ সালে অধিকাংশ ৩/৫ বছরের ভাড়াভিত্তিক আনা হয়েছিল। এগুলো অধিকাংশ এখনো আছে অধিকাংশ অলস থেকেও ক্যাপাসিটি চার্জ পাচ্ছে।  অধিকাংশ সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মহলের। সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ অ্যাক্টের (ইডিএমনিটি অ্যাক্ট) আওতায় জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে টেন্ডার ছাড়াই অস্বচ্ছভাবে অনেক চুক্তি করেছে। সীমিত সময়ের কথা বলে অ্যাক্টটি করা হলেও এখনো চালু আছে। 

বছর শেষে নির্বাচন। রাজপথে সরকারি দল বিরোধীদল মুখোমুখি। জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের চলতি এবং আসন্ন সংকট সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে দারুণভাবে। আর এজন্য দায়ী আমলানির্ভর সরকারের ভ্রান্ত জ্বালানি কৌশল এবং দুর্নীতি। সরকার বাকি সময় ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট, অপচয়, চুরি বন্ধ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। যতটা সম্ভব প্রণোদনা দিয়ে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তারপরও কতটা স্বস্তি আসবে সন্দেহ আছে।

শেয়ার করুন