২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৮:৩১:৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়ায় বিব্রত সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২২
সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়ায় বিব্রত সরকার প্রেসক্লাবের সম্মুখে গত ২ জুলাই বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভা/ফাইল ছবি


সংখ্যালঘুদের বিক্ষোভ সমাবেশসহ বক্তৃতা বিবৃতিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার । সংখ্যালঘুদের এমন কর্মসূচি নেয়ার পেছনে দায়ীদের ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতেও অস্বস্থিতে সরকার। তবে সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ কমাতে খুব তাড়াতাড়ি এদের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। কেননা আগামী নির্বাচনে এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কায় তারা। খবর সংশ্লিস্ট সুত্রের।  

গণমাধ্যমে যা এসেছে

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে নিজেই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ও পূজামন্ডপে হামলা এবং ভাঙচুর নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা হয়। তিনি বলেছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ বছর প্রায় ৩৩ হাজার পূজামন্ডপ তৈরি করা হয়েছে।  বলা হয়েছে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, মন্দির ভাঙচুর এবং পূজামন্ডপে  হামলা নিয়ে প্রপাগান্ডা হয় বলে দিল্লিকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। 

দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে ২০ জুন এক বৈঠকে মন্ত্রী মোমেন বলেছেন বলে প্রকাশিত হয় যে, সেই প্রপাগান্ডা নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়। বৈঠকে মন্ত্রী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্ম ও বিশ্বাসের চর্চায় প্রতিবন্ধকতা নেই  সেটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। সেই বৈঠকে মন্ত্রী মোমেন রাজধানীসহ সারা দেশে ৩৩ হাজার পূজামন্ডপ তৈরি হয় জানিয়ে বলেন, এরমধ্যে একটি বা দু’টিতে সমস্যা হতেই পারে। এ ছাড়া ছোট একটি দেশের মধ্যে এত লোক বাস করে এবং সে কারণে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এটাও স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ, এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে কাউকে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলেও বৈঠকে জানান মন্ত্রী। বলেন, এ বিষয়েও অনেকে মিথ্যা প্রচারণা করে এবং বিষয়টি নিয়ে যেন ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে।

প্রতিক্রিয়ায় কে কি বলছেন?

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে রাজপথ প্রকম্পিত করেছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ। সংগঠনের সভাপতি ত্রয় ঊষাতন তালুকদার, অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, মি. নির্মল রোজারিও ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ এবং বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দারের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, এরমধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনেশুনে প্রকৃত সত্যের অপলাপ করেছেন।  বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, গত বছর শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালীন পূর্বাপর সময়ে দেশে ২৬টি জেলায় সংঘটিত পূজামন্ডপে হামলার কথা অস্বীকার করায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সারা দেশে ‘ধিক্কার মিছিল’ হয়েছিল। এরপরও তার এ মিথ্যাচারে দেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিদারুণভাবে ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে পররাষ্টমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ বছর ৩৩ হাজার পূজামন্ডপ তৈরি করা হয়েছে’ এটিও সত্যের অপলাপ। নেতারা বলেন, বাংলাদেশে প্রতিটি পূজামন্ডপ ও পূজার সার্বিক আয়োজন উদ্যোক্তারা নিজস্ব অর্থায়নে করে থাকেন। এ অবস্থায় ঐক্যপরিষদ ও পূজা পরিষদ এহেন নির্জলা মিথ্যাচারের দায় মেনে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছে বলে বলা হয়। 

বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে

এধরনের পরিস্থিতিতে রাজপথে ফুসে উঠেছে সংখ্যালঘুরা। বিক্ষোভ সমাবেশসহ বক্তৃতা বিবৃতিতে তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশেই বক্তব্য দিচ্ছেন। এধরনের ঘটনা সরকারের ভেতরে বাইরে এমনকি বিদেশেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকারের বিদেশে সরকারের পজিটিভ ইমেজে আচড় লেগেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হামলার ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন যখন বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেরকম এক প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের জবাবে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।  কেননা বিবৃতিতে একইসঙ্গে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এর পাশাপাশি তারা ২ জুলাই শনিবার সকালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব চত্ত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল পূর্ব সমাবেশে ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের উপর চলমান সহিংসতা ও নির্যাতন অস্বীকার করে ভারতের নয়াদিল্লীতে যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তাঁর মিথ্যাচারের দায় স্বীকার করে অনতিবিলম্বে তাকে পদত্যাগের পুনঃদাবি জানান।

 সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ বলেছেন, অন্যথায় আগামী সংসদ নির্বাচনে যে কোন দল থেকে তাকে প্রার্থী করা হলে সংখ্যালঘু ভোটাররা তাকে বর্জন করবে। উল্লেখ্য, গত দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালীসহ দেশব্যাপী ২৬টি জেলায় পূজামণ্ডপ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও তাণ্ডবের সময়ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একই রকম মিথ্যাচার করেছিলেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এ কর্মসূচির আয়োজন করে। সমাবেশে সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের উপর নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে বারবার জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন, সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দলীয় নেতা ও কর্মীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনাকে অস্বীকারের প্রবণতা থেকে প্রশ্ন জাগে তিনি প্রকারান্তরে মন্ত্রণালয়ে কার স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার এই ধরনের মিথ্যাচার ও ঘটনাসমূহকে অস্বীকারের প্রবণতা থেকে মনে হয়, তিনি প্রকারন্তরে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর  এধরনের ভূমিকায় দ্বিগুণভাবে উৎসাহিত হয়ে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা শিক্ষক সম্প্রদায়সহ সাধারণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন নিপীড়ন অব্যহত রেখেছে। নেতৃবৃন্দ সকল প্রকার নির্যাতন নিপীড়নের আশু অবসান এবং সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি সাবেক এমপি উষাতন তালুকদার। এতে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক ও মি. নির্মল রোজারিও, প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যডভোবেট. সুব্রত চৌধুরী, মিলন কান্তি দত্ত, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার দেব, এ্যাড. তাপস কুমার পাল, রবীন্দ্রনাথ বসু, রমেন মণ্ডল, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, বাংলাদেশ খ্রিস্টান এ্যাসোসিয়েশন এর মহাসচিব মি. হেমন্ত কোড়াইয়া, শ্রীশ্রী ভোলাগিরি আশ্রম ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক রঘুপতি সেন, অনুভব এর সাধারণ সম্পাদক অতুল চন্দ্র মণ্ডল, সনাতন সংগঠন’র প্রধান সমন্বায়ক বাপ্পাদিত্য বসু প্রমুখ। সমাবেশ পরিচালনা করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ্যামল কুমার রায়। 

এদিকে অন্য একটি ইস্যুতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি সিদ্ধান্ত নেয় ভোট দেবে না, তাহলে জাতীয় সংসদের নির্দিষ্ট ৬২টি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারবে না বলে মনে করেন। আওয়ামী লীগের উদ্দেশে শাহরিয়ার কবির আরো বলেছেন, ‘আপনারা আবার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কী জবাব দেবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে? আপনাদের বলতে হবে, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম রক্ষা করিনি। ৬২টি নির্বাচনী এলাকা (সংসদীয় আসন) আছে, যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নেয় যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেব না-এসব নির্বাচনী এলাকা থেকে আপনারা নির্বাচিত হতে পারবেন না। আপনাদের স্বার্থে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে বলছি, সংখ্যালঘু স্বার্থকে আলাদা করে দেখবেন না।’

শেষ কথা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২৩ সাল বা এর পরের বছরের জানুয়য়িতে। নানান রাজনৈতিক মেরুকরণে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। দেশে বিদেশে আওয়ামী লীগ সরকার নানান প্রশ্নের মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যে জবাবে সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়া খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ যা সরকারের জন্য বড়ই নেতিবাচক দিক। কেননা পদ্মা ব্রীজসহ দেশে জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বন্ধে সরকার দেশে বিদেশে একটি সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। আবার একথাও ঠিক যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হামলার ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগও দেখা গেছে। এধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বিরুদ্ধে এমন কর্মসূচি বা বিবৃতির আচড় কেবল তা গায়েই পড়বে না। এটা সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কেন্দ্রেও আঘাত করবে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন।


শেয়ার করুন