২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৭:৪৬:২৫ পূর্বাহ্ন


বিএনপি’র ঢিলেঢালা কর্মসূচি রহস্যঘেরা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৯-২০২৩
বিএনপি’র ঢিলেঢালা কর্মসূচি রহস্যঘেরা


২০২২ সালের ৪ আগস্ট। এদিনে ভোলায় হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। আর এজন্য সকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতা কর্মীদের জেলা বিএনপির কার্যালয়ে আসতে দেখা গিয়েছিল। তবে দুপুর না গড়াতেই পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে ভোলায় ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। হরতাল শুরুর ছয় ঘণ্টা পর জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। 

হরতালের আগে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে ভোলা জেলা বিএনপি প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেছিল। জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শেষে আড়াই শতাধিক নেতা-কর্মী বিক্ষোভ মিছিল করতে রাস্তায় নামলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে আবদুর রহিম মাতব্বর নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। ওই সংঘর্ষে আহত ভোলা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মো. নুরে আলম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ নিয়ে ওই সংঘর্যের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়। আবদুর রহিম মাতব্বর নামের স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা মারা যাওয়ার ঘটনানেই নেই হরতাল ডাকা হয়।

অচমকা হরতাল প্রত্যাহারে সেসময় বিএনপি’র বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা হয়। বলা হয় বিএনপি ভয়ে পিছু হটেছে । বলা হয় বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিতে ভয় পাচ্ছে। আর এজন্য পিছু হটে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে।  বিএনপি’র পক্ষ থেকে নেয়া এমন কর্মসূচিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এ্যাকশনে মার খেয়ে বিএনপি হরতাল অবরোধ দেয়নি। ২০২২ সালেই নারায়ণগঞ্জে বিএনপি কর্মীদের সাথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে দলটির যুব সংগঠনের একজন কর্মী নিহত হন। সেসময়ও বিএনপি এধরনের ঘটনায় হত্যার প্রতিবাদে হরতাল অবরোধ না দিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভা সমাবেশ করে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে।

একিই বছরে রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনে বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকায় দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বিএনপি দাবি করেছিল সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে তাদের একজন কর্মী মারা গেছে এবং আহত হয়েছে আরও অনেকে। একই সাথে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীকে দলীয় কার্যালয় থেকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু এরপরেও বিএনপি হরতাল অবরোধ না দিয়ে জনগণকে ডেকে বিশাল বিশাল সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেসময়ও বিএনপি এমন ঢিলে ঢালা কর্মসূচি নিয়ে পত্রপত্রিকায় সমালোচনা ঢেউ বহে যায়। 

কেনো বিএনপি’র ঢিলেঢালা ভাব

রাজনৈতিক অঙ্গনে এতো গ্রেফতার মামলা হামলার পরেও বিএনপি’র পক্ষ থেকে বড়ো ধরনের কর্মসূচি যেমন, ঢাকা অচল করে দেয়া বা পুরো দেশ অচল করে দেয়ার কর্মসূচি না নেওয়াতে কট্টর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। আর এমন সমালোচনায় আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতারাও ঘি ঢেলে দিতো বিভিন্ন ধরনের কটাক্ষ করে। যেমন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সরকার পতন আন্দোলনের ঘোষণা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ‘দেখতে দোখতে ১৩ বছর। বিএনপির আন্দোলন হবে কোন বছর?’ ওবায়দুল কাদের আবারও বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চান তাদের আন্দোলনের নেতা কে? এবছরের শুরুতে বলা হয়েছিল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটানোর ক্ষমতা বিএনপির নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমন মন্তব্য করে বলেন, ৫৪ দলের ৫৪ মতে বিভক্ত। আসল নেতাগুলো হাসপাতালে পাতিনেতারা বলছেন সুনামি নামিয়ে সরকার হটাবে। আন্দোলনের সাগরের উত্তাল ঢেউ তুলে নদীর ঢেউও তুলতে পারলো না, তারা সরকারের পতন ঘটাবে কি ভাবে?। কিন্তু এরপরে দেখা গেছে, বিএনপি রয়ে সয়েই আন্দোলন করে যাচ্ছে। এমনকি আর মাত্র কয়েক মাস পরই সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমন সময়েও বিএনপি সাড়া জাগানো কর্মসূচি না দিয়ে পদযাত্রার মতো কর্মসূচি দিয়ে দেশ চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে সাভারের আমিনবাজারের সমাবেশ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মঞ্চ ভেঙেছেন বলে বিএনপি নেতারা তাদের ভাষায় অভিযোগ করেন। কিন্তু এর বিপরীতে বিএনপি কোনো বড়ো কর্মসূচিও দেয়নি, বরং আগের দেয়া রোড মার্চ কর্মসূচিই পালন করে যাচ্ছে। 

প্রশ্ন হচ্ছে কেনো? কি আছে বিএনপি’র অন্তরের গভীরে

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বিএনপি’র লাখ লাখ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। দলের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া একপ্রকার কারাগারে। সেই বিএনপি এখন মাঠেও আছে, কিন্তু খুবই ঢিলে ঢালা কর্মসূচি নিয়ে। এর কারণ কি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশ বিএনপি’র বেশ কয়েকজন প্রভাশালী বিচক্ষণ বলা যায় থিংক ট্যাং সারির নেতা ও বিশ্লেষকদের সাথে কথা হয়। তারা বলেন, সম্ভবত বিএনপি অনেক আগেই টের পেয়েছিল ক্ষমতাসীন সরকারকে ধীরে ধীরে পশ্চিমারা ঘিরে ফেলবে। অপরদিকে বিএনপির যদি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতকে দূরে রাখতে পারে তাহলে প্রতিবেশী দেশটি বিএনপি’কে আস্তে আস্তে আস্থায়  নেবে। আর সেভাবেই বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে তবে সেগুলি জ্বালাও পোড়াও ঢংয়ে না। বরং শান্তিপূর্ণ অংহিস আন্দোলন। এই অহিংস আন্দোলন বিএনপিক এখন দেশে বিদেশে গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনে অন্যরকম ইমেজ দিয়েছে। বেশ কয়েকমাস আগে বিএনপি’র একজন শীর্ষ নেতাকে এরকান্তে আলাপকালে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা কেনো কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই সরকারের পতন ঘটাতে বড়ো কর্মসূচি দেয়া লাগবে না। এমনিতই পতন ঘটবে। তার এমন বক্তব্য শুনে এই প্রতিবেদক মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। তখন বিএনপি’র ওই নেতা বলেন, এখন শুনে হাসি পাচ্ছে? তবে সম্প্রতি সেই বিএনপি’র নেতার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি প্রতিবেদকের দিকে মন্তব্য ছুড়ে দেন.. কি এখন কেমন মনে হয়? লাগবে বিএনপি’র বড়ো ধরনের কর্মসূচি? তিনি এরপর বলেন, বিএনপি এভাবে জেনে বুঝে নিজ দলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্মসূচি দিয়েছে। কারণ দলটির কাছে খবরই ছিল বিএনপি’র ধাক্কা ছাড়াই সরকারের অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। তিনি সম্প্রতি সর্বশেষ ঘটনাটি তুলে ধরেন। বলেন, মাত্র চারমাস আগে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র-এমন খবর বেরিয়েছিল। আর এখন ভিসা নীতি ঘোষণার চার মাসের মাথায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দিল যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ণে বাংলাদেশের নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী না হওয়ার আশঙ্কার কথা উঠে আসায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব উদাহরণ টেনে বিএনপি নেতা এই প্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘বিএনপি বুঝে শুনেই ঢিলে ঢালা কর্মসূচি দিচ্ছে। নিজের ঘরের খবর অন্য কি সহজে বোঝে? 

তাহলে সামনে কি?

এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি’র প্রভাশালী সেই নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাব পাশের ধাক্কা সামলাতে দিন। এরপর পরের টা আরো পরে।’ তবে তিনি আভাস দেন অক্টোবরে একটি শক্ত মার্কিন প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে..তখন তারা আবার কি বলে, কি পদক্ষেপ নেন তা-র দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেন তিনি। বলেন, ‘এগুলি দেখতে থাকেন..তারপরে বলবেন,..বিএনপি কেনো ঢিলে ঢালা কর্মসূচি দিলো.. কোনোই অহিংস আন্দোলনে দলটি..।’

উল্লেখ্য বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে এটি পরিচালনা করবে। ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল এবং তাদের সহায়তাকারীরা আগামী ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সফর করবেন।  প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি’র কি পশ্চিমাদের গতি প্রকৃতি দেখেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? পশ্চিমারা যে এসব নিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তালগোল পাকিয়ে দেবে- তা কি বিএনপি জানতো? কেনোই বা বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, ’যারা রাতের আঁধারে গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের ছবি তুলে রাখবেন। আশেপাশের সবাইকে, প্রতিবেশীদের বলবেন।’ আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপি’র সাথে যুগপৎ আন্দোলনে আসা নেতাকর্মীদের ঘরোয়া সভায় তিনি একেবারে নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘আপনারা নিশ্চিত থাকুন বিজয়ী বিএনপি হবেই, এদিক সেদিক যারা উঁকিঝুকি মারছেন চলে আসে আন্দোলনে..।’ আবার তিনিই শুরু থেকে বলেছেন, ‘বিএনপি ভদ্রলোকের দল। এখনও সুশৃঙ্খলভাবে, অহিংসভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। আমরা প্রতিবাদ করছি-। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে অহিংস আন্দোলনের নামে কেনো ঢিলে ঢালা কর্মসূচিতে বিএনপি? তা না হলে আর অন্য কি রহস্য আছে বিএনপি’র ঢিলে ঢালা কর্মসূচির পেছনে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল তাই বাঁকা চোখেই বলেন, বিএনপি’র ঢিলে ঢালা কর্মসূচি বড়োই রহস্যঘেরা।

শেয়ার করুন