২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৫:৩৪:৩৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


দেশকে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
লেখকের ক্ষমতার পেছনে দৌড়ানো উচিত নয়
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০২-২০২৪
লেখকের ক্ষমতার পেছনে দৌড়ানো উচিত নয় মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান


মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। কিংবদন্তি গীতিকবি। স্বাধীনতার আগেই পরিচিতি পেয়েছিলেন শ্রোতাদের কাছে। ১৯৬৫ সাল থেকে বাংলাদেশে বেতারে গীতিকার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন। তার প্রকাশিত গানের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার গল্প এবং বর্তমান পরিকল্পনা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: লম্বা ক্যারিয়ার পেছনে ফেলে এসেছেন। এখন আপনার পরিকল্পনা কি?

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: আসলে লেখালেখির বাইরে খুব একটা পরিকল্পনা নেই। এখন যা করছি বা যা নিজের মধ্যে আসছে লিখছি। তবে এখনও অনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু করা যায় না। যেমন, একসময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সেটিও করা হলো না ঠিকঠাক। অথচ আমার সঙ্গে বা পরে রাজনীতি করে এমপি-মন্ত্রীও হয়েছেন। বামপন্থি রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে, জেলে ছিলাম। তখন আমার বাচ্চা হয়েছিল। সেই মেয়েকে পরে জেলে নিয়ে গেছে আমাকে দেখানোর জন্য। এও তো জীবনে ঘটেছে। 

প্রশ্ন: এখন যারা গান লিখছেন তাদের কেমন মনে হয়। নতুন গীতিকবিদের জন্য কি আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: যে কোনো পেশাতে নিজের সৎ থাকাটা খুব জরুরি। নতুন যারা তাদের বলবো যে আপনারা সত্য বলুন, সত্য লিখুন। লেখকদের উদ্দেশে আমার যে কথা, সেটা হচ্ছে আপনার উদ্দেশ্য যেন সৎ এবং সত্যি হয়। অসৎ যেন না হয়। ক্ষমতার পেছনে দৌঁড়াবেন না। কোনও লেখকের ক্ষমতার পেছনে দৌড়ানো উচিত নয়। যদিও আমাদের দেশের অনেকেই ক্ষমতার পেছনে দৌড়াচ্ছেন। ক্ষমতার সুবিধা নিয়েছেন।

প্রশ্ন: ছোট বেলা থেকেই আপনার কবিতা, নাটক, ছবি আঁকা শুরু হলো। কিন্তু খ্যাতিটা বেশি পেলেন গানে। এই গানের শুরুটা কিভাবে?

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: গানের দিকে ঝুঁকি এইট নাইনে যখন পড়ি তখন। আমার কিছু বন্ধু গান করতো, স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য শিখতো-গাইতো। তাদের মধ্যে দু’জন-হীরা ও লাট্টু। হীরার ভালো নাম শাহ মোহাম্মদ মোরশেদ। ও আমার পেছনে লেগে গেলো! বলতে লাগলো, ‘তুই এত সুন্দর পদ্য লিখিস, গানও লিখ’। কিন্তু গান আমি কী করে লিখবো? গান তো আমি লিখিনি কখনও। হীরা-লাট্টুর চাপাচাপিতে রেডিওতে গান শুনে শুনে বুঝতে চাইলাম, লেখার ধরন কেমন। দেখলাম, গানে একটা মুখ থাকে, অন্তরা থাকে, একটা সঞ্চারি থাকে, আরেকটা আভোগ। মাঝখানে সঞ্চারির চল উঠে গেলো। থাকলো মুখ আর দুই অন্তরা। এগুলোর নাম অনেক পরে বুঝেছি, তবে এই ভাগগুলো আমি বের করলাম গান শুনে শুনে খাতায় লিখে। এরপর কিছু গানের প্যারোডি করলাম। মানে সুর ঠিক রেখে ঠিক পুরনো কথার বদলে একই ছন্দে নতুন কথা লিখলাম। প্যারোডি করার পর দেখলাম, বাহ্ বেশ তো হাতে এসে গেছে! তারপর নকল বাদ দিয়ে, নিজের চিন্তায় একটা গান লিখলাম।

প্রশ্ন: কিন্তু এর মধ্যে গানের সঙ্গে সংযোগ হয়নি!

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: তখনই সংযোগটা হচ্ছিল। ঘটনাটি বলছি। ১৯৬৫ সালে আমার প্রথম গান রেকর্ড হয় ঢাকা রেডিওতে। যশোর থেকে আমি খাতা পাঠিয়েছিলাম। তখন ২৫টি গান পাঠাতে হতো এনলিস্টেড হওয়ার জন্য। অনেকটা পরীক্ষার মতো। কিন্তু খাতা পাঠানোর পরে বড় ভাইকে জানাইনি। সেটা দরকারও মনে করিনি। চাইনি বড় ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে সুবিধা নিতে। যাহোক, ওরা আমার ২৫টি গানই কিনে নিলো, এনলিস্টেড করলো না। না করার কারণে মনটা খুব খারাপ, তখন আমি যশোরে। হঠাৎ ওর মধ্য থেকে একটি গান, ‘এ মাসের গান’ হিসেবে মিউজিক ডিরেক্টর আজাদ রহমান সাহেব তৈরি করেন। এর কিছুদিন পর আমি এনলিস্টেড হলাম। 

প্রশ্ন: কাজের স্বীকৃতি হিসাবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এই পুরস্কারের বিরোধীতাও আপনি করেন। এর কারণ কি? 

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: এটা ৯৫ সালের কথা। তখন আমার পেনশন কেসটা ঝুলছিল। বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। আমার বন্ধু তরিকুল ইসলাম তথ্যমন্ত্রী ছিল। তারপরও আমার পেনশন হচ্ছিল না। ওই হয়, হয় না। ঘুরতে থাকলাম। একদিন পেনশনের খোঁজ নিতে গেছি মন্ত্রণালয়ে। যাওয়ার পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দৌড়ে এসে বললো, ‘আরে রফিক ভাই, আপনার তো দারুণ সুখবর আছে’। আমি বললাম, আমার পেনশনের ফাইল সই হয়েছে? সে বললো, ‘আরে না না, আসেন’। একেবারে টেনে নিয়ে গেছে ভেতরে। দেখালো, ফিল্ম জুরি বোর্ড তিন বছরের পুরস্কার একসঙ্গে দিচ্ছে। গান আর চিত্রনাট্য মিলিয়ে আমি একসঙ্গে সাতটা পুরস্কার পাচ্ছি! জুরি বোর্ড থেকেই এই রায় এসেছে। তারপর যখন পত্রিকায় চূড়ান্ত তালিকা দেখলাম, কোথাও নেই আমি! একটি পদকও পাইনি। তখন আমি বুঝলাম কীভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়। একবার তো নায়ক ফারুক জুরি বোর্ড থেকে ফিরে এফডিসিতে আমাকে দেখেই ক্ষেপে গেছেন। সে আমাকে বললো, ‘এই যে শুনেন তো রফিক ভাই, আপনাকে ভাই বলবো না কি বলবো বুঝতে পারছি না। আপনারা কেন এসব কাজ করতে আসেন। গানে পুরস্কার দিতে যাই, বলে না এটা ফিক্সড করা আছে আরেকজনের জন্য। স্ক্রিপ্টে দিতে যাই, বলে না এটা দেওয়া যাবে না। অমুককে দিতে হবে। যেটা বলি সেটাই অন্যকে দিতে হবে, তখন আমি রেগে বের হয়ে চলে এসেছি।’ এসব ঘটনার পরেই আমি ঘোষণা দিয়েছি, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনও পুরস্কার বা পদক আমি পেলেও গ্রহণ করবো না। কখনোই না। সেটা যে সরকারই হোক, যে কারণেই হোক। এসব অনেক কিছু হয়, অনেক কিছুই ঘটে জীবনে। এগুলো নিয়ে আমার কিন্তু কোনও ক্ষোভ নেই।

শেষবার ২০০৮ সালে যখন পুরস্কার নিয়ে বের হই আমাকে কয়েকজন সাংবাদিক বললেন, ‘রফিক ভাই আপনার অনুভূতি বলেন’। বললাম, ভাই গরিব মানুষ আমি। টাকা পয়সার খুব অভাব। এক লাখ টাকা পেয়েছি, খুব কাজে লাগবে। এটার জন্য ধন্যবাদ। ওরা বললো, ‘আর ট্রফি?’ তখন আমি এগিয়ে দিয়ে বললাম, নিয়ে যান এটা। আমার কোনও দরকার নেই।

প্রশ্ন: কিন্তু একজন যোগ্য শিল্পীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য পুরস্কারের তো দরকার আছে!

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান: আছে। ওই যে বললাম, সবকিছু নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিষয়টা দেশের সবাই এত বিশৃঙ্খল করে ফেললো! মুশকিলটা কোথায়- যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দিচ্ছে তারাও সংস্কৃতি সচেতন নয়। আবার যিনি নিচ্ছেন- তিনিও নিজের কর্মের চেয়ে যেভাবেই হোক পুরস্কারকে করায়ত্ত করতে উদগ্রীব।

শেয়ার করুন