০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:৩৭:৫০ অপরাহ্ন


কিছু সুযোগসন্ধানী উপদেষ্টার ভুল পরামর্শে কয়লা উত্তোলন হচ্ছে না
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৪
কিছু সুযোগসন্ধানী উপদেষ্টার ভুল পরামর্শে কয়লা উত্তোলন হচ্ছে না কয়লা উত্তোলনের দৃশ্য


আওয়ামী নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার চতুর্থ ধারাবাহিক টার্মে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। আগের তিন টার্মের এবারো নির্বাচন পূর্ব অঙ্গীকারে দেশের কয়লা সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহারে সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। এবারের টার্মের ৩ মাস অতিবাহিত হলো। কিন্তু কয়লা উত্তোলন বিষয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ধারাবাহিক তিন টার্মসে দেশের প্রধান জ্বালানি সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ নিঃশেষ হয়েছে। সরকারের স্থল ভাগে গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম কোনভাবেই পর্যাপ্ত ছিল না। নানা অজুহাতে সাগরের গ্যাস উত্তোলন থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছে সরকার।

কিছু উপদেষ্টার ভুল পরামর্শে সরকার আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে ধাবিত হয়ে জ্বালানি সরবরাহের বিশাল চ্যালেঞ্জ পড়েছে। ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশে আমদানিকৃত জ্বালানি সরবরাহের অবকাঠামো নির্মাণে জটিলতা আছে। নানা ভূরাজনৈতিক ঘটনার কারণে বিশ্ব জ্বালানি মূল্য আকাশ ছোঁয়া হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ উঁচু মূল্যে জ্বালানি আমদানি করার সক্ষমতা রাখে না। তদুপরি ভূরাজনৈতিক জটিলতার কারণে সাপ্লাই চেন ভেঙ্গে পড়ছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি ক্রয় করে আমদানিকৃত কয়লা এবং তরল জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো ক্ষমতা অনুযায়ী চালানো মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। 

এমনি অবস্থায় নিজস্ব জ্বালানি বিশেষত মাটির স্বল্প গভীরতায় থাকা উঁচু মানের (সীমিত সালফার, সীমিত অ্যাশ, উঁচু হিটিং ভ্যালু) কয়লা মাটির নিচে রাখার বিলাসিতা দেখাতে পারে না বাংলাদেশ। অথচ সরকার জলে স্থলে গ্যাস সম্পদ আহরণে সক্রিয় হলেও বিপুল কয়লা সম্পদ আহরণ বিষয়ে এখনো দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। 

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সমীক্ষা হতে দেখা গাছে সঠিক পদ্ধতিতে ৫টি খনির অন্তত ৪টি (বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী, খালাশপীর, দিঘিপাড়া) থেকে কয়লা আহরণ করা হলে দেশের জ্বালানি চাহিদা অন্তত ৪০-৫০ বছর মেটাতে পারে। একই ধরনের খনি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমনকি আমাদের পাশের জানালার প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। কোথাও মেরুকরণ বা পরিবেশ ধ্বংস হয়নি বলে খবর দেয়নি কেউ। 

অনেক ক্ষেত্রেই মাইনিং শেষে জমি পূরণে উদ্ধার করা হয়েছে, সবুজায়ন হয়েছে। বাংলাদেশের খনিগুলো নিয়েও সমীক্ষা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশসম্মত উপায়ে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে জোরালো সুপারিশ করছে প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাবসায়ী সংগঠনগুলো। জানিনা কোন তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা সরকার প্রধানকে কয়লা উত্তোলন বিষয়ে ইতিবাচক পরামর্শ দিচ্ছেন না। 

ইতিহাস বলে, জাতির জনক নিজস্ব গ্যাস, কয়লা আহরণ এবং উত্তোলন করে স্বনির্ভর অর্থনীতির স্বার্থে বাংলাদেশ গ্যাস, তেল এবং খনিজ সোপর্দ কর্পোরেশন (বিওজিএমসি) গঠন করেছিলেন। পরবর্তীতে স্বল্প সময়ে সেটি ভেঙে বাংলাদেশ খনি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএমডিসি) এবং বাংলাদেশ তেল এবং গ্যাস কর্পোরেশন (বিওজিসি) গঠন করেন। তিনি তার বিশ্বস্ত দু’জন পরামর্শক খ্যাতিমান ভূবিজ্ঞানীকে সচিবের মর্যাদা দিয়ে সংস্থা দুটির প্রধান করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ের মধ্যে তিনি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী থেকে ৫টি গ্যাস ফিল্ড নাম মাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছিলেন। সাগরে তেল উত্তোলনের জন্য উৎপাদন বন্টন চুক্তির অধীনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসাবে ৬টি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইন উন্নয়ন এবং জামালগঞ্জ, বড়পুকরিয়া কয়লা খনি উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেনা শাসকরা পেট্রোবাংলা ক্ষমতা এবং কার্যক্রম সীমিত করে ফেলে। বিএমডিসিকে পেট্রোবাংলার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। একসময় মাইনিং ডিরেক্টর নামে একটি পৃথক ডিরেক্টরেট থাকলেও এখন সেটি বিলুপ্ত। শান্তার ৫৩ বছর পরেও ৫ টি খনির চারটির কয়লা নানা অজুহাতে মাটির নিচে পড়ে আছে। বঙ্গসাগরে সীমানা বিরোধ একযুগ আগে নিষ্পত্তি হলেও সাগর সম্পদ আহরণ করা হয়নি। 

১৯৯০ দশকে বিএনপি সরকারের আমলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মাইনিং কোম্পানি বিএইচপি মিনারেল কোম্পানির সঙ্গে ফুলবাড়ীতে কয়লা অনুসন্ধানের চুক্তি করা হলে তারা বিপুল পরিমাণ কয়লা সম্পদ আবিষ্কার করে। কিন্তু কয়লা অনুসন্ধান বিষয়ে বিএনপি সরকার টাল বাহানা করে সময় নষ্ট করতে থাকলে বিএইচপি চুক্তি এশিয়া এনার্জির কাছে হস্তান্তর করে দেশ ছাড়ে। ইতিমধ্যে নির্বাচনে জিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২৬ বছর পর দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসীন হয়। আওয়ামী লীগ সরকার এশিয়া এনার্জির সঙ্গে কয়লা অনুসন্ধান এবং উত্তোলন চুক্তি সম্পাদন করে। এশিয়া এনার্জি চুক্তি অনুযায়ী বিস্তারিত কারিগরি অনুসন্ধান চালিয়ে মাইনিং করার করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করে ২০০৫ সালে। সরকার আবারো পরিবর্তিত হয়ে তখন জামায়াত-বিএনপি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। একটি অশুভ মহল কয়লা উত্তোলন কাজ থেকে অশুভ সুবিধা অর্জনের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই সময় ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী টাটা বাংলাদেশে ঈশ্বরদীতে ইস্পাত কারখানা, বিদ্যুৎ প্লান্ট এবং চট্টগ্রামে সার কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। টাটা বাংলাদেশের কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই সময় একটি চীনা কোম্পানি একটি চুক্তির বড়পুকুরিয়ায় আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করছিল। এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দিয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। কাকতলীয়ভাবে এই সময় একটি অশুভ মহলের ষড়যন্ত্রে ফুলবাড়ী এলাকায় স্থানীয় জনগণকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিক্ষুব্ধ করা হয়। অনেকটা বিনা প্ররোচনায় গুলি করে কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।

এই সময় তথাকথিত ভারত বিরোধী বুয়েট থেকে ডিগ্রিধারী হাওয়া ভবন আশীর্বাদপুষ্ট একজন প্রকৌশলী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ছিল। টাটার সঙ্গে তার দহরম মহরম সবাই দেখেছে। এশিয়া এনার্জির মাইনিং প্রস্তাব মূলত নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করার জন্য একজন বুয়েট শিক্ষকের নেতৃত্বে এশিয়ার এনার্জির স্কিম অফ ডেভেলপমেন্টের কারিগরী দিক বিবেচনার জন্য নিয়োগ করা হয়। কমিটি তাদের কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে অযাচিত সুপারিশ করে। সেই থেকে (২০০৫-২০২৪) দুই দশক বিএনপি সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তিন টার্মসের আওয়ামী লীগ সরকার ফুলবাড়ী মাইন থেকে কয়লা উত্তোলন প্রস্তাব অনুমোদন বা বাতিল করেনি। খালাশপীর, দিঘিপাড়া এমনকি জামালপুর খনির কয়লা উত্তোলন নিয়ে সমীক্ষা করা আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনডিপি একটি সমীক্ষা করেছে। দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় খনি বিশেষজ্ঞ ডক্টর অজয় রয় বাংলাদেশের কয়লা উত্তোলন বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছেন। এতশত সমীক্ষা প্রতিবেদন থাকা সত্ত্বেও তীব্র জ্বালানি সংকট সময়েও পেট্রোবাংলা অথবা জ্বালানি মন্ত্রনালয় কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব কাছে সরকার প্রধানের কাছে উপস্থাপন করেনি। 

সরকার প্রধান নিজেও ২০০৫ ফুলবাড়ী এলাকায় আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক বিরোধিতার কৌশলের স্থানীয় জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন তার সরকার ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে না। সেটি ছিল নিতান্তই রাজনৈতিক বক্তব্য। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেশের সরাতে কয়লা উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তার কাছে পেশ করা হলে অনুমোদন করার মোট সৎ সাহস আছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অনেক ঝুঁকি নিয়েও পদ্মা বহুমুখী সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি হাব, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণ করছে মূলত প্রধানমন্ত্রীর সাহসের কারণে।

বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এখন দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিজস্ব কয়লা উত্তোলন এবং ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। এই সরকার আমলে প্রাক্তন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন চেয়ারম্যান খ্যাতিমান খনি প্রকৌশুলি মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি মাইনিং বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করলেও সরকার আমলে নেয়নি। বরং জ্বালানি উপদেষ্টা বিভ্রান্তকর কথা বলে ধু¤্রজাল সৃষ্টি করেছেন। 

বাংলাদেশের কয়লা সম্পদ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর জেলায় মাটির নিচে ১৫০-১০০০ মিটার গভীরতায় রয়েছে। বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির সময়ে পরিবেশ সম্মত উপায়ে খনন প্রযুক্তি আছে। উন্নত পানি ব্যাবস্থাপনা, কৃষি জমি পুনরায় উদ্ধার, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন নিশ্চিত করে খনি উন্নয়ন অনতি বিলম্বে শুরু করা উচিত। ইতিমধ্যে পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী এবং বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রমাণ করেছে আধুনিক প্রযুক্তি অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব কয়লা ব্যবহারের উপযোগী। ২০২৪ শেষ নাগাদ অন্তত বড়পুকরিয়া উত্তর এবং ফুলবাড়ী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে ২০৩০ নাগাদ নিজেদের কয়লা ব্যবহার করে ৬০০০-১০০০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যৎ উৎপাদন সম্ভব। 

প্রমাণ হয়েছে কিছু সুযোগ সন্ধানী উপদেষ্টার ভুল পরামর্শে দেশের জ্বালানি আহরণ উপেক্ষা করে আমদানিকৃত জ্বালানি নির্ভরতার কারণে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

শেয়ার করুন