২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০২:১৮:১৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


অশ্বেত ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে শ্বেত সন্ত্রাসীদের তৎপরতা
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৬-২০২২
অশ্বেত ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে শ্বেত সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বাফেলোতে ১৮ বছর বয়সী এক বিবেচনাহীন কিশোর এক গ্রোসারি স্টোরে ১০ কালো লোককে হত্যার ঘটনায় শোকাহত একটি চিত্র/ছবি সংগৃহীত


বাফেলোতে এখন বাংলাদেশিরা ক্রমাগত তাদের বসতি স্থাপন করছেন অধিকতর আগ্রহ-উৎসাহে প্রাণাতিপাত করে। নতুন নতুন যারা আমেরিকায় আসছেন, তাদের অনেকেই সেখানে বসতি গড়ে তুলছেন, অনেকে একাধিক বাড়ি গড়েছেন, অনেকেই বাফেলোকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। এসব দেখলে শুনলে ‘গর্বে আমার ভরে ওঠে বুক।’ কিন্তু ১৪ মে বাফেলোতে ১৮ বছর বয়সী এক বিবেচনাহীন কিশোর এক গ্রোসারি স্টোরে ১০ কালো লোককে হত্যা করেছে। এই গুলিবর্ষণকারী ছোকড়া কুখ্যাত ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিউরিকে’ সমর্থন করে।


এই থিউরির বর্ণবাদী বিশ্লেষণ হচ্ছে শ্বেত আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানরা ক্রমাগতভাবে অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্র্যান্টদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, এজন্য এই গুলি। বিষয়টা শ্বেতাঙ্গদের একশ্রেণির টিভি উপস্থাপক ও অকাট্য বর্ণবাদী যোগীদের মনে ক্ষণিকের জন্য হলেও দাগ কেটেছে। ফক্স টেলিভিশন চ্যানেলটি হচ্ছে ইমিগ্র্যান্টদের জন্য এক সামাজিক মরণফাঁদ। এই টেলিভিশনের দক্ষিণপন্থী মহা এনকর টাকার কার্লসন এই রিপ্লেসমেন্ট থিওরি বা প্রতিস্থাপনের মতবাদ কিংবা অশ্বেতাঙ্গদের দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের মূলোৎপাটেেনর মতবাদ নিয়ে অন্তত চারশ বার তার শোতে কথা বলেছেন এই গুলি চালানোর পূর্বে। গুলি চালানোর পর তিনি আর সে নিয়ে কথা বলেননি। কারণ উস্কানির কারণে তার পাপ গলা পর্যন্ত পূর্ণ হলে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হবে বৈকি? কিন্তু ১৭ মে তিনি তার শোতে বলেন, ‘বিষয়টা কি আমরা এখনো তা জানি না।’


যেখানে হন্তা নিজের নোটে রিপ্লেসমেন্ট থিওরির কথা বলে গেছেন আর টাকার কার্লসন চারশ বারের বেশি তা নিয়ে তার শোতে উল্লেখ করেছেন। ঘটনার তিনদিন পর তা তিনি ধারণা করতে পারছেন না বিষয়টা কি? তারপর সব দোষ নন্দঘোষের মতো করে টাকার কার্লসন চাপিয়ে দেয় ডেমোক্রেটদের ওপর। বলে ডেমোক্রেটরা নাকি ইমিগ্রেশনের কথা বলে নির্বাচনে জেতার জন্য। এর দুদিন পর হাঙ্গেরিতে পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এক টেলিভিশন বক্তৃতায় বলেন, ‘ইউরোপে এক ব্যাপকহারে মানুষ প্রতিস্থাপন চলছে খ্রিস্টান শিশুর কমতির কারণে। অন্য সভ্যতা থেকে আনা হচ্ছে বয়স্ক লোক অর্থাৎ মাইগ্র্যান্টদের। এরপর আমেরিকার রক্ষণশীল রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে বুদাপেস্টে বৈঠক করে আলোচনা করে। সেখানে আমেরিকার সিপ্যাক (ঈচঅঈ) দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই প্রতিস্থানের একটি প্রক্রিয়া হতে পারে গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করা। যদি আপনি প্রতিস্থাপন নিয়ে তত উদ্বিগ্ন হন, তাহলে কেন এই প্রতিস্থাপনের কাজ গর্ভপাত বন্ধ করে সেখানে শুরু করি না?


বিশ্বব্যাপী গর্ভপাতের পক্ষে-বিপক্ষে কথা রয়েছে, সেটা না ভেবেও বলা যায় কোথা থেকে গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট বা প্রতিস্থাপন থিওরি এসেছে আর তা কীভাবে এতো ব্যাপক প্রচার পেলো? এই ধারণা নতুন কিছু নয়। বরং এই ‘প্রতিস্থাপন থিওরি’ এক উন্নত চিন্তাধারার সৃষ্ট এক সহজাত উদ্বেগের বিষয়। যেসব ব্যক্তি গণহত্যাকারী ও খ্যতিমান রাজনীতিকরা তা প্রচার করেন। ইউ গভ. পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ ট্রাম্প সমর্থকও ৫৩ শতাংশ ফক্স নিউজ ভিউয়ার বিশ্বাস করে যে, বিষয়টা সত্যি।


প্রতিস্থাপন থিওর অনেক মতবাদের মধ্যে এক জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে। যেমন বাফেলোর গুলিবর্ষণকারী কিশোর বলে গেছেন, সে কট্টর হয়েছে অনলাইন মেসেজ বোর্ড রেড্ডিট, (জঊউউওঞ) ৪ ঈঐঅঘ  ও ৮ ঈঐঅঘ দেখে। পেনডেমিকের সময় বা কোভিড মহামারীর সময় সে প্রতিনিয়ত সেসব ব্রাউজ করে পড়তো। এই মেসেজসমূহ শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের জন্য প্রধান সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ইশতেহার সে ছেড়েছে, তাতে ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ডে ৫১ জন লোককে হত্যাকারী অস্ট্রেলিয়ান শুটারের ইশতেহার থেকে অনেক কিছু ধার করেছে। সেই ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ বা ‘মহাপ্রতিস্থাপন’। সেটা ছিল পুরোটাই বর্ণবাদী। শ্বেত জাতীয়তাবাদী ও ইমিগ্র্যান্ট-বিরোধী সেন্টিমেন্টে ভরা। তারা মনে করে শ্বেত জন্মনিয়ন্ত্রণ মানে ‘শ্বেত গণহত্যা’। আর ইমিগ্রেশন নীতি হচ্ছে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত লোকজনের জন্য ক্ষতিকারক। এই প্রতিস্থাপন থিওরি ২০১১ সালে নরওয়ের ইউটোয়া, পেনসিলভানিয়ার পিটসবুর্গে ২০১৮ সালে ট্রি অব লাইক সিনাগগের হত্যাকাণ্ডে, ২০১৯ সালে টেক্সাসের এলপাসোতে হত্যাকাণ্ডে, গুলিচালকরা তা ব্যবহার করেছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রুপকে টার্গেট করেছে।


যেমন বাফেলো গুলিচালক শুধুমাত্র কালো আমেরিকানদের, নিউজিল্যান্ডে শুক্রবারে জুমার নামাজের পর মুসলিমদের এলপাসোতে ল্যাটিনোদের, ইউটোয়াতে বিশেষ করে সামার ক্যাম্পের নরওয়ের লোকদের টার্গেট করেছে। পেনসিলভানিয়ার ইহুদিদের আক্রমণ করা হয়েছে এবং সে জন্য নট ফর প্রোফিট একটি সংগঠনে যারা ইহুদিদের সাহায্যার্থে কাজ করে, তাদের দোষারোপ করা হয়েছে। অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্র্যান্ট দিয়ে শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যার ঘাটতি মেটানোর ইমিগ্রেশন পলিসি আমেরিকায় শতবর্ষের পুরোনো পলিসি। আর এ জন্য বর্ণবাদী ভীতি সঞ্চালকরা সবসময় চিৎকার করে আসছে। আর কালক্রমে গোত্র ও বর্ণবাদী গ্রুপের এ জন্য দায়ী হওয়ার ঘটনাও পরিবর্তন হয়েছে। ১৮৭০ সালে প্রথম চীনারা ইমিগ্র্যান্ট হয় এ দেশে। তখন প্রথম ইমগ্রেশন আইনের খসড়া হয়। ১৯১০ সালে আসে জাপানি ইমিগ্র্যান্ট। 


১৯২০ সালের দিকে আসে ইউরোপ থেকে ইহুদি রিফিউজিরা। তখন তারা মধ্যও দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আসে। নতুন ইমিগ্র্যান্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে একই ধরনের ভর্তি জন্ম নিতে থাকে। তখন থেকে শুরু হয় নন হোয়াইট ইমিগ্র্যান্ট আসা মানে এক ধরনের আক্রমণ। তারা সঙ্গে নিয়ে আসে রোগ, তারা শ্বেত আমেরিকানদের উচ্ছেদ করবে। তারা বিভিন্ন স্থানের সংস্কৃতি পরিবর্তন করবে। তবে এ কথা সত্যি যে, অধিকাংশ সময় ইউরোপীয়রা যারা সাদা জাতের তারাই প্রতিস্থাপন করেছে। প্রতিপক্ষের যুক্তিতে দেখা যায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড আফ্রিকা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে যারা প্রতিপালিত হয়েছে তারা উপনিবেশবাদী সেটলারদের দ্বারা হয়েছে। আমেরিকায় জনসংখ্যায় ৩ শতাংশের কম হচ্ছে নেটিভ-আমেরিকান। তারপরও এই গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরিকে ধন্যবাদ দিতে হয় এ কারণে যে, একসময় বিশ্বে যারা জোর করে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তারা নিজেদের নির্যাতিত ভাবছে। 


বিংশ শতাব্দীতে ইতালীয়দেরও সত্যিকার শ্বেতাঙ্গ বলা হতো না। অথচ ইতালিয়ান কলম্বাসই আমেরিকার আবিষ্কারক। একসময় ইউজেনিক্স বা সুপ্রজননবিদরা  (শ্বেত ও শ্বেত মিলনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের মতবাদে বিশ্বাসী) ‘শ্বেত’, ‘মধ্য’, ‘ভূ-মধ্যসাগরীয়’ ও ‘নরডিক’ নিয়ে ভাগাভাগি করে বর্ণবাদের বিভক্তি দেখাতো। বলা হতো, আফ্রিকান আমেরিকানদের দমিয়ে রাখো। সুপ্রজননবিদদের পণ্ডিত ছিল মেডিসন গ্র্যান্ট। তিনি বর্ণের পৃথকীকরণে বিশ্বাস করতেন। হিটলার তাকে অনুসরণ করতেন। এখন মনে করা হচ্ছে, কালোদের অগ্রগতি আমেরিকায় সাদাদের থামিয়ে দেবে। এরপর ১৯২৪ সালে ইমিগ্রেশন আইন এমনভাবে করা হলো যেখানে আফ্রিকা বা এশিয়া থেকে লোক আনা বন্ধ করে শ্বেতাঙ্গ বিস্তারে উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে লোক আনার কায়দা করা হয়েছিল। বলতে গেলে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে লোক আনা একেবারেই বন্ধ করা হয়।


হিটলার এই আইনকে বাইবেল মনে করতো। আর তা থার্ড রাইখের মডেল হিসেবে দেখতো। আর ইহুদিবিরোধী তৎপরতায় কাজে লাগাতো। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৬৫ সালে প্রণীত ইমিগ্রেশন ও ন্যাশনালিটি আইন অনেকটা পথ সহজ করে। এই আইনের পর বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, মেক্সিকো ও চীন থেকে চেইন মাইগ্রেশনের সুযোগ হয়। ভাই-বোনদের, মা-বাবাদের আনার সুযোগ হয়। তবে তা করা হয়েছিল ইউরোপবাসীদের জন্য। কারণ এতোদিন তো আফ্রিকা-এশিয়া থেকে ইমিগ্রেশন বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত।


ইউরোপের লোকেরা এখানে এখন ভাই-বোনদের আনার চেষ্টা করে না। এই সুযোগে আফ্রিকা ও এশিয়ার লোকেরা ব্যবহার করেন। এই সুযোগকে এখন বলা হচ্ছে ‘চেইন মাইগ্রেশন’। তা বন্ধ করার জন্য ইমিগ্র্যান্ট-বিরোধীরা চেষ্টা করছে। ২০১১ সালের দিকে এই ষড়যন্ত্রের টার্গেট হয় মুসলমানরা। এ সময় রিনাউড ক্যামুস প্রথম মুসলিমবিরোধী, ইমিগ্রেশন-বিরোধী থিওরি প্রকাশ করে। এই থিওরি ফ্রান্সের দুই প্রতিস্থাপনকারী লেখকের বর্ণিত মতবাদের অনুসারি। এরা ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে তা প্রকাশ করে। বর্তমান বর্ণবাদীরা সেখান থেকেই প্রতিস্থাপন থিওরির নাম নিয়েছে। ক্যামুস সবসময় ইউরোপ-বহির্ভূত ইমিগ্র্যান্টদের ‘উপনিবেশকারী’ হিসেবে বর্ণনা করেন। 


আধুনিক নাজী নেতা ডেভিড লেইন বিষয়টাকে শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা বলে বর্ণনা করেন। সাউদার্ন প্রবার্টি ল’ সেন্টার এই শ্বেতাঙ্গদের হেইট গ্রুপ বা ঘৃণাপূর্ণ গ্রুপ বলে বর্ণনা করে থাকে। এই হেইট গ্রুপের সঙ্গে কাজ করে ট্রাম্পের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল জ্যাক সেশন ও কট্টরপন্থী স্টিফেন মিলার (যিনি নিজে একজন ইহুদি) ট্রাম্প প্রশাসনে কাজ করেন। ট্রাম্প তাই এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগতদের বলতো ‘ইমিগ্র্যান্ট ফ্রম শিটহোল’ কান্ট্রি। একইসঙ্গে সে মুসলিম দেশ থেকে লোক আনা বন্ধ করে দেয়। 


২০২০ সালের মে মাসে তারপরও দেখা যায় শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা কমে ২০১০ সালের ৭২.৪ শতাংশ থেকে ৬১.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪০ সালে তা ছিল ৯০ শতাংশ। 

টাকার কার্লসনরা চিৎকার করে তা নিয়ে। সে বলে তৃতীয় বিশ্বের ভোটাররা আমেরিকায় উত্তরাধিকারের জন্য ভয়ের কারণ। ২০১৯ সালে বিশ্ব জনসংখ্যায় ৩-৫ শতাংশ বা ২৭ কোটি ২০ লাখ আন্তর্জাতিক মাইগ্র্যান্ট। এজন্য বর্ণবাদীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এ কার্যকলাপের শিকার বাংলাদেশিরাও। ৯/১১-এর পর বাংলাদেশি অনেকেই এখানে নিহত হয়েছে হেইট আইনে। অনেকেই আহত হয়েছে। অনেকে আমেরিকা ছেড়েছেন। বাংলাদেশিরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। একশ্রেণির অবোধ ছাড়া সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পরচর্চা, পরনিন্দার চেয়ে সময়কে বেছে নিয়ে পথচলা অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্যান্য ইমিগ্র্যান্টদের মতো বাংলাদেশিদেরও প্রতিস্থাপন থিওরি নিয়ে বুঝতে হবে। আমাদের পথ রচনা করতে হবে। যেন প্রতিস্থানের বালখিল্য যন্ত্রণা থেকে নিজেদের বাঁচানো যায়।


শেয়ার করুন