নেপালের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মার পতনের পাঁচটি কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ স্প্রিং’-এর আদলে গড়ে ওঠা কেপি শর্মাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আন্দোলন ছিল ভারতপন্থী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে নেপালের আন্দোলন ছিল চীনপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে। সিপিএম (ইউএমএল) কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট) নেতা কেপি শর্মার এটা ছিল চতুর্থবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনা। ইতোপূর্বে তিনবার তার ক্ষমতা বদল হয়। চীনপন্থী এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আতুড়ঘর হচ্ছে দুর্নীতি। নেপালের সর্বত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। বলা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা ও ধনী পরিবারদের সঙ্গে নেপালের যুবক, গরিব, মেহনতি মানুষের দূরত্ব হয়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া। কেপি শর্মা নিজে যে দুর্নীতিবাজ ছিল তা নয়। আসলে তার শাসন প্রতিষ্ঠাই ছিল যাকে বলে ‘গোড়ায় গলদ’। বাংলাদেশে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে। নেপালে সে আন্দোলন গড়ে উঠে সরকারের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান্ড করা নিয়ে। এ আদেশ প্রত্যাহার করলেও আন্দোলনের তীব্রতা সরকারের পতন ঘটায়। যেমন কোটার আদেশ কোর্ট রহিত করলেও বাংলাদেশে আন্দোলনের তীব্রতা এমন ছিল যে, শেখ হাসিনাকে লোটা-কম্বল নিয়ে ভারতে পালাতে হয়। কেপি শর্মা অবশ্য নেপালেই আছেন বলে খবর এসেছে।
নেপালে যদিও আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে সেপ্টম্বরের ৮ তারিখে। আসলে এ আন্দোলন গড়ে উঠে গত মার্চ মাসে যখন তিনজন বিক্ষোভকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
নেপালের আন্দোলনে সর্বশেষ বলা হচ্ছে ৫১টি তাজা প্রাণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। শত শত আহত হয়েছে। ওলির পদত্যাগের আগে কয়েক মন্ত্রী গদি ছেড়েছে। ছাত্ররা নেপালের সর্বত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। কেউ যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেপালের বিক্ষোভকারীরা নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাওডেল ও কেপি শর্মা ওলির ব্যক্তিগত বাসভবন তছনছ করে।
নেপালে বর্তমানে সুশীলা কার্কের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে তার রয়েছে গভীর ভারত কানেকশান। তবে সরাসরি তাকে ভারতপন্থী না বলে ভারসাম্যযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। অনেক বিলম্বে অবশ্য চীনও অভিনন্দন জানায়।
নেপালে ব্যাপক প্রতিবাদের ছয় কারণ:
১. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি
কাঠমান্ডু পোস্ট রিপোর্ট করেছে, গত সেপ্টম্বরের ৪ তারিখ ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া ফ্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার মধ্যে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে সময়ের পূর্বে দেশের কমিউনিকেশন ও ইনফরমেশান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেজিস্ট্রার করতে পারেনি। নেপালের ৩ কোটি লোকের মধ্যে ৯০ শতাংশ লোক ইন্টারন্টে ব্যবহার করে। কয়েকদিনের মধ্যে নেপোকিডস, নেপোবেবী এবং পলিটিসিয়াম নেপোবেবী-নেপাল, নেপালের রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের মধ্যে দুর্নীতির ও তাদের পরিবারদের অধিক ভোগ ব্যবস্থার নিন্দা করতে থাকে। প্রতিবাদকারীরা নেপালের রাজনৈতিক মহলেলর ছেলে-ছোকড়াদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও সাধারণ নেপালিদের কর্মহীন অবস্থা ও দৈনিক কঠোর ব্যবস্থার বর্ণনা দিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে থাকে।
তারা সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির মামলা নিয়ে প্রচার চালায়। এরপর ভারতের দি হিন্দু পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক স্টেট এয়ারলাইনের জন্য এয়ারবাস কেনা নিয়ে দুর্নীতির বিচারের কথাও উল্লেখ করা হয়। সব নেপালি সরকারের দুর্নীতির জন্য হতাশা ছিল, বহু যুবক দেশত্যাগ করা শুরু করেছিল। তাই তারা তাদের যুবকদের প্রটেস্ট করার উদ্যোগ নেন। আর দেশের অর্থনীতি দুর্নীতিমুক্ত করার শপথ নেন।
২. মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা
কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া উল্লেখ করে যে, ফেসবুক থেকে ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম ও এক্স গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই হিমালয়ের দেশে। সরকার ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেয়। যার ফলে এ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যুবসমাজকে যারা কমিউনিকেশনে বিশ্বাস করে। প্রতিবাদের কারণে বহু সিদ্ধান্ত পাল্টানো হলেও তাতে অনেক বিলম্ব হয়ে যায়।
৩. অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ও বেকারত্ব
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য অসন্তোষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় (বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন না হওয়া আর নেপালে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হওয়া)। তার মধ্যে দুর্নীতি, ধীরগতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ হিমালয়ের দেশকে অস্থির করে তোলে।
দেশের ৪৩ শতাংশ লোক ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী, বেকারত্বে ১০ শতাংশ লোক হাবুডুবু খাচ্ছে এবং মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৪৪৭ ডলার (বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট) অধিকন্তু দেশের ইকনমি বিদেশে অবস্থানরত নেপালিদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল। নেপালের জিডিপির ৩৩.১ শতাংশের উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এ প্রতিবাদের মূলশক্তি যুব সম্প্রদায়। যাদের সরকারের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। তারা মনে করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মন্তব্য।
৪. রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা
২০০৮ সালে নেপালে ২৩৯ বছরের পুরোনো রাজতন্ত্রের অবস্থান ঘটে রক্তাক্ত জনযুদ্ধের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র। তখন থেকে শুরু হয় অস্থিতিশীলতা। এরপর প্রায় ডজনখানেক সরকার প্ররিবর্তন হয়। ২০৮৮ সাল থেকে প্রায় ১৪টি সরকার আসে। কেউই পাঁচ বছরের টার্ম পূরণ করতে পারেনি। অনেক লোক মনে করেন, দুর্নীতি চলেছে অবৈধভাবে। ওলি সরকার তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক না কমিশন খাওয়া, না ঘুষ খাওয়া, কোনো কিছুই বন্ধ করতে পারেনি। কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারেনি।
৫. পুলিশি সন্ত্রাস ও সরকারি অব্যবস্থা
নেপাল গত সপ্তাহের সোমবার সবচেয়ে কালো দিবস অতিক্রান্ত করে। তারা যুবক প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালায়। ওইদিনই ১৯ জন নিহত হয়। তখন নিহতদের সংখ্যা ৫১তে দাঁড়িয়েছে। অনেক আহত মৃত্যুবরণ করেছেন। অধিকাংশ ভিকটিম স্কুল ও কলেজপড়ুয়া। তাদের মাথায় অথবা বুকে গুলি করা হয়। একেবারে বাংলাদেশের স্টাইলে। এই জেনারেল জি (জেনজি) গ্রুপের হতাশা, সামাজিক বৈকল্যতা আরো অনেক শান্তিপ্রিয়ভাবে সমাধান করা যেত। কিন্তু তা হয়নি।
তার পরিবর্তে ওলি সরকার মৃত্যুবান নিক্ষেপ করে। তারা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। সরকারি টিভিতে বলা হয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বাতিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভে গুলি ছোড়া হয়।
৬. ভারতের বিরুদ্ধে ওলির অবস্থান
গত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির এক বছরে একবারও ভারত সফর করেনি। ১৬ সেপ্টেম্বর তার ভারত সফরের কথা ছিল। ওলি একজন কমিউনিস্ট নেতা এবং তাকে চীনাপন্থী হিসেবে দেখা হয়।
কাঠমান্ডু পোস্টে এক নিবন্ধে বলা হয়, ওলি বিভিন্ন সংবেদনশীল ডিপ্লোমেটিক ইস্যুতে ভারতবিরোধী বক্তব্য দেখা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারেনি। এই রিপোর্টে বলা হয়, ওলি ও তার দল সিপিএন-ইউএসএলের রাজনৈতিক পরিচয় ভারত বিরোধিতা ও পরিশ্চমাদের বিরোধিতা করা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন ভারত ও চীণ লিপুলেখ পাস ব্যবস্থা করার জন্য চালু করতে সম্মত হয়, তখন নেপাল ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে তার প্রতিবাদ করতে পারতো। তা না করে ওলির চেলারা তা রাজনৈতিকভাবে জনসমক্ষে প্রচার করে। এ কাহিনি ওলি পাঁচ বছর পূর্বে শুরু করেছে। সন্তুষ্ট না হয়ে ওলি বিষয়টি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের কাছে উত্থাপন করে। শি বলেন, বিষয়টি নেপাল ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়।
বলা যায় না বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি না? মনে হয় তা সুদূর পরাহত। তবে ভারতের এই পরিবর্তনে হাত থাক আর না-ই থাক, বাংলাদেশ হাতছাড়া হওয়ার পর নেপাল নিয়ে ভারত অনেকটা সন্তুষ্ট।
ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওলি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলে। এ প্রচারণায় মূল কারণ ওলির বিরোধিতা ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন জায়দায় দখল নিয়ে চলছিল বিরোধ। আর ওলি সরকার তার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিল না একমাত্র নিজেকে চীনপন্থী বলে জানিয়ে যায়। তাছাড়া এখনকি নেপাল আবার সুশীলা কার্কের হাত ধরে ভারতের কোলে আশ্রয় নেবে। তবে নেপালকে ভারত কেন ব্রিটিশরাও কোনো সময় ঔপনিবেশ বানাতে পারেনি।