স্বার্থগোষ্ঠীর চাপে শহরের পরিকল্পনা পরিবর্তন করলে করলে পরিকল্পনা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। শহরের বাসযোগ্যতা ও পরিবেশকে উপেক্ষা করে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর বারংবার পরিবর্তন ঢাকাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে।
পাঁচ বছর পর ড্যাপ আপডেট করার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা অনুসরণ না করে ব্যবসায়ী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের চাপে ২০২২ সালে ড্যাপ অনুমোদনের তিন বছরের মধ্যে দুইবার ড্যাপ সংশোধন করা হল। ঢাকা শহরের জন্য বিষয়টি আত্মঘাতী এবং নগর পরিকল্পনার কার্যকর অনুশীলন এর অন্তরায়। মূলত আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব ও ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ আইএবি’র দাবির কাছে সরকার রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন নির্মাণে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর), জনঘনত্ব ও আবাসন ইউনিট বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সার্বিক বিচারে যা অপরিণামদর্শী এবং ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতাসহ নির্মিত পরিবেশ ও প্রতিবেশ এর জন্য হুমকিস্বরূপ। পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন সামাজিক, পরিবেশবাদী, পেশাজীবি ও নাগরিক সংগঠনের মতামত ও দাবিকে উপেক্ষা করেই সরকার এই সংশোধন এর পথে হাঁটছে। এতে জনবহুল ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা বাড়বে এবং ইতিমধ্যে স্থবির হয়ে যাওয়া শহরে পরিবহন, পরিসেবাসহ সকল ধরনের নাগরিক সেবার উপর অসহনীয় চাপ পড়বে। এই চাপ বহন করবার ক্ষমতা এই শহরের নেই। এই ধরনের উদ্যোগ ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতাকে একেবারে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে। গত ৪ নভেম্বর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে “কার স্বার্থে আবারও পরিবর্তন ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে এসেছে।
পরিবেশকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক, সমাজকর্মী ও গবেষকগণ এর যৌথ উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বাসযোগ্য শহরের পরিকল্পনা প্রণয়নে নাগরিকদের প্রত্যাশা নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে নাগরিক, পেশাজীবী ও অংশীজনদের নিয়ে ‘জাতীয় কনভেনশন’ আয়োজন করবার ঘোষণা দেয়া হয় উক্ত অনুষ্ঠানে। ব্যবসায়িক স্বার্থগোষ্ঠীর অনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ত্রুটিপূর্ণ পরিবর্তন প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করবার দাবী করা হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে ১৭ দফা দাবি ঘোষণ করেন ফিরোজ আহমেদ (লেখক ও সদস্য সংবিধান সংস্কার কমিটি), যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি দাবি হল:
-ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যে কোন সংশোধন নাগরিক, পেশাজীবী, কমিউনিটি ও সামাজিক সংগঠনসমূহকে যথাযথ সম্পৃক্ত করবার মাধ্যমে এবং তাদের মতামতের সাপেক্ষে সার্বিক জনকল্যাণ ও শহরের বাসযোগ্যতাকে মাথায় রেখে করতে হবে।
- ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা বাড়াতে সামাজিক, পরিবেশবাদী, পেশাজীবী, নাগরিক সংগঠন কর্তৃক ড্যাপ ও ইমারত সংক্রান্ত ইতিপূর্বে প্রেরিত ফার, জনঘনত্ব, নির্মিত পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাবনা যথাযথ বিবেচনায় নিতে হবে।
-বিগত সময়ে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিকল্পনায় যেসকল পরিবর্তন করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সঠিক তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
- কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় যে কোন ধরনের উন্নয়ন নিষিদ্ধ করতে হবে। কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় বিদ্যমান সকল ধরনের অবৈধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধে রাজউক, মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবৈধ দখলদার ও অবৈধ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
-পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নে আবাসন ব্যবসায়ীসহ স্বার্থের সংঘাত আছে, এমন কাউকেই অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না।
- নগর পরিকল্পনার সার্বিক বিষয়াদি আমলে নিয়ে জনস্বার্থ ও পরিবেশ-প্রতিবেশ টেকসই করতে পরিকল্পনাবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনৈতিক প্রভাব খাটানো যাবে না।
গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির মত যে সকল এলাকায় আবাসিক প্লটে উচ্চ এফএআর মান দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে কমিয়ে গ্রহণযোগ্য মানে আনতে হবে।
আবাসিক এলাকার ভবনসমূহের মধ্যে ভারসাম্য ও শৃংখলা, পাড়া-মহল্লার সমজাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সাদৃশ্য এবং ভবনের ভেতর পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। মূল প্রবন্ধে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) এর সাম্প্রতিক সংশোধনীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ঢাকার অধিকাংশ এলাকার এফএআর এর মান অনেকাংশেই বাড়ানোর যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কারিগরি ভিত্তি নেই। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনায় পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট কারিগরি জ্ঞানকে উপেক্ষা করেই এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ও আবাসন ইউনিট এর কিছু স্বেচ্ছাচারী ও ফরমায়েশি মান প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ড্যাপ সংশোধনী প্রস্তাবনায়, গুলশান-বানানী ও ধানমণ্ডির মত অভিজাত এলাকার ফার মান কমানোর দাবিকে বারংবার উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে অভিজাত এলাকার সাথে ফার মানের বিদ্যমান বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে। এবং এই বিষয়টিকে সামনে এনে অনেক এলাকার ফার ও জনঘনত্বকে বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। পূর্বাচল এর মত এলাকায়ও ফারকে নিয়ন্ত্রণ করবার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। একইসাথে অতিরিক্ত ফার প্লট মালিকদের অতিরিক্ত অনার্জিত আয় এর সুযোগ করে দিবে, যা নগরে প্লটহীন নাগরিকদের সাথে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে।
এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করবার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উপদেষ্টারা। কিন্তু আবাসিক এলাকার জন্য নগর পরিকল্পনার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলের ব্যাপারে পরিবর্তিত ড্যাপ এ বিষয়টিকে একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে। মূল প্রবন্ধে যানজট, জলজট, বায়ু দূষণ, উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর বিশ্বের অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে অবস্থান করে। ঢাকা শহর যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ। জনবিরোধী ও পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার যে শোচনীয় অবস্থা তাতে এই শহরে মানুষ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড বজায় থাকেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে অর্থনীতির সীমাহীন প্রবৃদ্ধির যে ধারণা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা রাষ্ট্রের নীতিমালা এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এখনো সেই ধারণার বাইরে চিন্তা করতে পারছেন না।
মূল প্রবন্ধে আমিরুল রাজিব, সমন্বয়ক, বাংলাদেশ গাছরক্ষা আন্দোলন বলেন, যানজট, জলজট, বায়ু দূষণ, উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর বিশ্বের অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে অবস্থান করে। ঢাকা শহর যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ। জনবিরোধী ও পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার যে শোচনীয় অবস্থা তাতে এই শহরে মানুষ ও প্রাণিকূলের টিকে থাকার ন্যূনতম কোনো মানদন্ড বজায় থাকেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অর্থনীতির সীমাহীন প্রবৃদ্ধির যে ধারণা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা রাষ্ট্রের নীতিমালা এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এখনো সেই ধারণার বাইরে চিন্তা করতে পারছেন না।
ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ( আইনজীবী ও মানবঅধিকার কর্মী) বলেন, বর্তমানে আবাসন ব্যবসায়ীরাই পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবার কারণে এটা পুরোপুরি অন্যায্য। ইবনুল সাইদ রানা (পরিবেশ কর্মী ও নির্বাহি সদস্য বাংলাদেশ রাস্ট্র সংস্কার আন্দলন) পরিবর্তনের ফলে শহরের যানজট আরও তীব্র হবে। তাই নগর উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা জরুরি।
পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা- অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা সহ সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। বর্তমান পরিকল্পনা জনকল্যাণের জন্য নয়, বরং একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই করা হচ্ছে। রাজধানীর মাটি শুধুই মুনাফার জন্যে নয়। মিজানুর রহমান ( নাগরিক অধিকার কর্মী, জুরাইন) বলেন, একটি মানুষ বসবাস করার জন্য আক্ষরিক অর্থে যা যা প্রয়োজন তার কোন কিছুই নগরের প্রান্তিক এলাকায় নেই। জুরাইন তার বড় উদাহরণ যেখানে জনদূর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। অথচ সরকারের সেগুলো নিয়ে কোন বিকার নেই। ড্যাপের পরিবর্তনে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে। গাউস পিয়ারি ( পরিচালক ডাব্লিউ ভি বি ট্রাস্ট ) বলেন, ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ বসবাস করছে, কিন্তু তাদের চাহিদার কথা কেউ ভাবছে না- সবাই শুধু নিজের স্বার্থের দিকেই নজর দিচ্ছে। এলাকার মানুষ ও দায়িত্বশীলদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি ড্যাপ তৈরির কথা ভাবা হলেও, তা বাস্তবে দেখা যায়নি। তিনি আরও বলেন, সব শ্রেণির মানুষের কথা ভেবে কাজ করা উচিত; কেবল একটি স্বার্থান্বেষী শ্রেণির উন্নয়নকে উন্নয়ন বলা যায় না। আমাদের খোলা জায়গা, ভালো বায়ু ও পানি মান এবং যানজটমুক্ত শহর দরকার- সেখানে ভবনের উচ্চতা বাড়িয়ে নতুন চাপ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। হাউজ বিল্ডিং এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালিত প্রকৌশলী আবু সাদেক বলেন, ড্যাপের পরিবর্তন শহরের বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করব। বাসযোগ্য ঢাকা গড়বার প্রচেষ্টার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হল। অবিলম্বে এই উদ্যোগ বাতিলের আহবান জানান তিনি।