অপশাসন, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিষবাষ্পে দূষিত পুঞ্জীভূত ধ্বংসাবশেষ থেকে বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশে কিন্তু সংবিধান চালু আছে। কিন্তু সরকারকে আভিধানিক অর্থে সাংবিধানিক বলা যাবে না। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ১৬ বছরের সরকার বিদায় নিয়েছে। সরকার প্রধানের পদত্যাগের বিষয়টি সুস্পষ্ট হচ্ছে না। জীবনরক্ষার তাগিদে সাবেক সরকারপ্রধান ভারতে অবস্থান নিয়েছেন। দেশে কিন্তু সেনাশাসন জারি করা হয়নি। সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র-জনতার চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আভিধানিক অর্থে সাংবিধানিক বলা যাবে কি না, সেটি বলতে পারেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। আর যদি বর্তমান সরকার চালু থাকা সংবিধানের আলোকে অসংবিধানিক হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
পতিত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, সাংসদ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদ হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, না হয় দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। হতাশ দ্বিধাগ্রস্ত পুলিশ এখনো বিপর্যস্ত। বেসামরিক প্রশাসন অবিন্যস্ত। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম অবিন্যস্ত। দীর্ঘদিনের কুশাসন, অনিয়ম, বৈষ্যমের পর সব পর্যায়ে সুশাসন স্থাপন করার চেষ্টায় দারুণভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ব্যাংক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা আনছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, শিল্পবাণিজ্যে স্থবিরতা আসেনি। শিল্পখাতে অরাজকতা বিরাজ করছে। সংস্কার করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তির পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত অর্জন হবে না।
জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতের কথাই বলি। ঢাকার বাইরে ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ লোডশেডিং চলছে। ঠিক যেমন ২০০৮-২০০৯ পরিস্থিতি ছিল। তখন সংকট ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সঞ্চালন, বিতরণ নেটওয়ার্ক ছিল না। তবে জ্বালানি সংকট ছিল না। জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য আকাশছোঁয়া ছিল না। এখন গ্রিড, নন-গ্রিড মিলে কথিত ক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটের অধিক। সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। অথচ জ্বালানি সরবরাহ সংকট, জ্বালানি আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত, ২০০০-২৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকায় দেশজুড়ে সংকট। জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতের সরকারি সংস্থাগুলো বিপুল দেনার দায়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। কেবল ভারতের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ রফতানিকারকদের কাছে দেনা ১ বিলিয়ন ডলার। বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির মোট দেনা ৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। এ ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অনেক কর্মকর্তাই এখনো বহাল তবিয়তে। আগেই বলেছি, দুর্নীতি এবং কুশাসনের কারণে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নাজুক অবস্থায়। দেশের প্রাথমিক জ্বালানি সম্পদ (গ্যাস, কয়লা) আহরণ, উত্তোলন এবং ব্যবহার উপেক্ষা করে আমদানিকৃত জ্বালানির ঝুঁকি নেওয়ায় মূলত জ্বালানি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ভ্রান্ত পরিকল্পনার কারণে কয়লাসম্পদ মাটির নিচে অনাহরিত রয়ে গেছে। জলে-স্থলে পেট্রোলিয়াম আহরণ, উত্তোলন স্থবির থাকায় প্রমাণিত গ্যাস মজুদ নিঃশেষিত হওয়ার পথে। বিকল্প হিসেবে ২০১০ এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও ভাসমান টার্মিনালের এলএনজি আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালে। ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে একাধিক ভাসমান এবং কয়েকটি ভূমিভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও ২০২৪ পর্যন্ত মাত্র দুটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন সম্ভব হয়েছে। দেশে গ্যাস চাহিদা এখন ১ হাজার ১০০ দৈনিক ৪২০০-৪৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও সরবরাহ সম্ভব সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ১১০০-১৫০০ মিলিয়ন গ্যাস ঘাটতি বিদ্যুৎ, সার উৎপাদন শিল্পকারখানা পরিচালনাসহ সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহারকারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। গত পাঁচ বছর সময়ে জ্বালানি মিশ্রণে আমদানিকৃত জ্বালানির অবদান ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ দাঁড়িয়েছে এবং ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ভূরাজনীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বজ্বালানি বাজার বিক্ষুব্ধ হওয়ায় জ্বালানি আমদানি করতে আর্থিক সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। ক্রমাগত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কয়েকদফা বিদ্যুৎ-জ্বালানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির সমন্বিত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন জাগে, কেন জ্বালানি আহরণ ও সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিসমূহ দায়িত্বে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলো? পেট্রোবাংলার ১৩টি কোম্পানি কোম্পানি অ্যাক্টের অধীনে সৃষ্ট স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে গঠিত পরিচালনা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার কথা। পরিচালনা বোর্ডে মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি থাকায় সংশ্লিষ্ট বোর্ডে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত পেট্রোবাংলায় পরিবর্তিত হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলোর অনেক সিদ্ধান্ত পেট্রোবাংলায় এসে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পেট্রোবাংলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হলো-বাপেক্স, তিতাস গ্যাস এবং জিটিসিএল। এ কোম্পানিগুলো জ্বালানি সেক্টরের হৃৎপিণ্ড। কোম্পানিগুলোর নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদনে পেট্রোবাংলা উদ্দেশোমূলকভাবে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে কোম্পানিসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কোম্পানিসমূহের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বছরের পর বছর ঝুলে থাকলেও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের নিয়মিত পদোন্নতি হওয়ায় পেট্রোবাংলা কর্মকর্তাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন কোম্পানি কর্মকর্তারা। এগুলো পরিষ্কার বৈষম্য। এমনি যখন অবস্থা, তখন পেট্রোবাংলা থেকে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের কোম্পানিসমূহে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বদলি করায় অন্তত দুটি কোম্পানি তিতাস গ্যাস এবং জিটিসিএলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তিতাস গ্যাসের কথিত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করায় তীব্র ক্ষোভ এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
প্রথাগত নিয়ম পরিবর্তন করে জিটিসিএলের গ্যাস ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কে সিস্টেম লস পেট্রোবাংলা থেকে বিতর্কিতভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ায় জিটিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে। দুটি কোম্পানিতে মানব চেইনসহ পেট্রোবাংলাবিরোধী আন্দোলন চলছে। তিতাস গ্যাস এবং জিটিসিএল নিয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অপমানজনক মন্তব্য করায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবি উঠেছে। পত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জ্বালানি সেক্টরের নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সংস্থানগুলোতে কাজের পরিবেশ দারুণভাবে বিঘ্নিত। অভিভাবক হিসেবে পেট্রোবাংলা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সংকটের সৃষ্টি করেছে।
জ্বালানি সেক্টরের মাঠেঘাটে কাজ করে জ্বালানি আহরণ, উত্তোলন, সরবরাহ করে কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলোর কাজে সহায়তা প্রদানের জন্য পেট্রোবাংলা সৃষ্টি হলেও বর্তমান পেট্রোবাংলার কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রেই কার্যক্রমে অনাকাক্সিক্ষত বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী, স্বায়ত্তশাসিত। ইতিমধ্যে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টরের কর্মকাণ্ড রেগুলেশন এবং মনিটরিংয়ের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সৃষ্টি হওয়ার পর পেট্রোবাংলার অবস্থা এখন না ঘরকা, না ঘাটকা। জ্বালানি সেক্টরে পেট্রোবাংলার ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।
বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য গতিময় জ্বালানি সেক্টর অপরিহার্য। সেই সময়ে কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা বৈষম্য সৃষ্টি, সেক্টরের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো সৃষ্টিতে ব্যর্থতা, তদুপরি কোম্পানিসমূহের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য অবিলম্বে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অরাজকতা দীর্ঘস্থায়ী হবে। আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংকট সমাধানে দ্রুত কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।