১৫ অক্টোবর ২০১২, মঙ্গলবার, ০৯:২৮:২৮ অপরাহ্ন


জ্বালানি সেক্টরে বিপর্যয় ও অস্থিরতার নেপথ্যে
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৯-২০২৪
জ্বালানি সেক্টরে বিপর্যয় ও অস্থিরতার নেপথ্যে বিদ্যুৎলাইন


জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কাজ করা কিছু আমলা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জ্বালানিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতির কারণে সম্ভাবনাময় জ্বালানি সেক্টরে এখন মহাসংকট। মাটির নিচে পড়ে রয়েছে মূল্যবান কয়লা সম্পদ, নিয়মিত গ্যাস-তেল অনুসন্ধান উপেক্ষা করে সিন্ডিকেটের পরামর্শে জ্বালানি আমদানির দিকে ধাবিত হয়ে তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়েছে দেশ।

 ৩০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও নিয়মিত ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ৪২০০-৪৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ ক্ষমতা ১১০০ এমএমসিএফডি আমদানিকৃত এলএনজিসহ ৩১০০ এমএমসিএফডি। ১১০০-১৪০০ এমএমসিএফডি ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত, সার কারখানাগুলো গ্যাস পাচ্ছে না। শিল্পকারখানাগুলোতে তীব্র গ্যাস সংকট। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আগামী দুই-তিন বছরে সংকট মেটানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। 

প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে জ্বালানি সেক্টরে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবের আর্থিক কেলেঙ্কারির নানা কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে। জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ধ্বংস করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ডক্টর তওফিক ই এলাহী চৌধুরী। সেই ১৯৯৭ থেকেই নানাভাবে তিনি জ্বালানি সেক্টরে জড়িত। তার সম্পৃক্ততার কারণে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার কারণে বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। দেশে নাইকো রিসোর্সেসের আগমন ঘটেছে তার হাত ধরে। এ বিতর্কিত সর্বজ্ঞানীর কারণে জিটিসিএলের অন্যতম মুচাই কম্প্রেশার স্টেশন নির্মাণকাজ অবৈধভাবে শেভরনকে দেওয়া হয়েছে। এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রেও এককভাবে সামিট গ্রুপ প্রাধান্য পেয়েছে।

এই বিশেষ ব্যাক্তির কারণে কয়লা সম্পদ মাটির নিচে পড়ে আছে। তার কারণেই বঙ্গোপসাগরে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে কাজ বিলম্বিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে যতগুলো শিল্পকারখানাকে গ্যাসসংযোগ দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সর্বোপরি তিনি পেট্রোবাংলার পেশাদারিত্ব ধ্বংস করে অদক্ষ আমলাদের পদায়ন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

জ্বালানি ক্ষেত্রে অবাধ দুর্নীতির নেপথ্যে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাপেক্সসহ গ্যাস কোম্পানিগুলোর সরঞ্জাম এবং সেবা ক্রয় কমিশন বাণিজ্য, গ্যাস চুরির সিন্ডিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা করে অঢেল অর্থ সম্পদ লোপাট করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে গ্যাস সেক্টরের শীর্ষ দুর্নীতিবাজরা তার ছত্রছায়ায় অবাধে দুর্নীতি করেছে। ২০১০-২০২৪ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানরা হয় নীরব দর্শক থেকেছে অথবা নিজেরাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। আজ যে জ্বালানি সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানিতে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। এজন্য জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, বিভিন্ন সময় কাজ করা জ্বালানি সচিব, পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানরা পৃথক বা যৌথভাবে দায়ী।

জানি বর্তমান সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে সংস্কার চাইছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে জ্বালানি সচিব বা পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান এমনকি কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপক পদে যোগ্য কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। সৎ, নিবেদিত কর্মকর্তারা বৈষম্যের শিকার হয়ে কোণঠাসা হয়ে আছেন। বেতন বৈষম্যের কারণে মেধাবী তরুণরা গ্যাস সেক্টরে কাজ করতে নিরুৎসাহী। গ্যাস সেক্টরে গতিময়তা ফিরিয়ে আনার কাজে প্রমাণিত অতীত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সৎ গ্যাস সেক্টর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ আছে। তবে প্রথম প্রয়োজন গ্যাস সেক্টরে সম্পাদিত দুর্নীতিকারীদের আইনের আওতায় আনা, কেন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোতে লক্ষ লক্ষ অবৈধ সংযোগ, কেন বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাপেক্সকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করা গেল না? কেন গ্যাসসম্পদ ফুরিয়ে আসছে জেনেও গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিকে বিপুল খরুচে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধ্য করে পঙ্গু বানানো হয়েছে? কেন সাগরে গ্যাস আরোহন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে? কেন গ্যাস সরবরাহ চেইনে সিস্টেম লস নির্ধারণে অস্বচ্ছতা? ওপরের প্রশ্নগুলো মীমাংসা করা ছাড়া জ্বালানি সেক্টরে স্বস্তি আসবে না।

পেট্রোবাংলার বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রাক্তন সৎ-নিবেদিত কর্মকর্তাদের এ মুহূর্তে সোচ্চার হওয়া অবশ্যক। কেননা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ জড়িত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের চোর, অর্থলিপসুগুলো বসে সম্পদ বিনষ্ট করবে জাতীর ক্ষতি করবে, এটি মেনে নেওয়া যায় না। 

কর্মজীবনে নিজের গভীর সম্পৃক্ততা এবং বাংলাদেশকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসার কারণে অন্যায়ভাবে জ্বালানি সেক্টর থেকে চাকরি হারানোর পরেও নানাভাবে গত ২০ বছর জ্বালানি সেক্টরের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। নিয়মিত লিখেছি নানা সুপারিশমূলক প্রতিবেদনপত্র পত্রিকায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে কথা বলেছি, দেশে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে আধুনিক টেকনোলজি বিষয়ে মতবিনিময় করেছি, বিদেশে প্রশিক্ষণকালে বাংলাদেশের জ্বালানি-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মকর্তাদের নানাভাবে সহায়তা করেছি। এই আলোকে মনে করছি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের। এতে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সঠিকভাবে এগুলে আবার সুখময় হয়ে উঠবে এনার্জি সেক্টর, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শেয়ার করুন