শবেবরাত জানান দিয়ে গেল, রমজান সন্নিকটে। সম্ভবত মার্চের সূচনালগ্ন থেকেই শুরু আসন্ন পবিত্র মাহে রমজান। বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধনায় মশগুল হন। মহান রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যে এ সিয়াম সাধানা। সারা বছর ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে থাকেন। অনেক দেশেই ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করেন এ রমজান মাসে যারা সিয়াম সাধনা করবেন, তাদের স্বস্তি দানের। নিজে কম লাভ করে ভোক্তাদের অধিক ক্রয়ের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের। কারণ ইবাদতের মধ্যে অন্যতম উত্তম এ সিয়াম বা রমজান মাসের রোজা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে এমনটার প্রচলন রয়েছে। আছে ক্রয়ক্ষমতা যাদের কম, তাদের প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করা। যাতে এ মাসটা স্বস্তিতে সিয়াম সাধনা করতে পারেন।
তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম একটি দেশ। নাম তার ‘বাংলাদেশ।’ এ রমজান মাস ঘিরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শুরু হয় অসাধু সেজে ওঠা। মানুষের ক্রয়ের চাহিদা যে মাসটাতে বেশি, সে মাসে ওইসব সিয়াম সাধনাকারীদের পকেট কীভাবে ফাঁকা করে দেওয়া যায় সে ফন্দিতে মশগুল এরা। মুখে ধর্মের বাণী। কিন্তু কর্মে অধর্মই এদের উদ্দেশ্য। ব্যবসা করতে নিষেধ নেই, কিন্তু রমজান মাসে মানুষকে কষ্ট দেওয়া, বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করার মাধ্যমে তাদের আসল উদ্দেশ্য মহান রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন।
রমজান মাস আসন্ন। কিন্তু বাজারে অনেক জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। সরকার বলছে, কোনো কিছুতে ঘাটতি নেই। স্পেশাল অর্ডারে আমদানি করা হয়েছে রমজান মাস সামনে রেখে। তবুও রমজানের প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ অতিরিক্ত দামে বিক্রি শুরু। এর কবলে শুধু মুসলমানই নন, অন্যরাও বিপাকে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজি ক’মাস ধরেই। বাংলাদেশের বাজারে ৫ লিটারের সয়াবিন তেল নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দোকানিরা জানাচ্ছেন আমাদের দিচ্ছে না ডিস্টিবিউটররা। দাম বাড়বে কি বাড়বে না সেটাও জানি না। দোকানিদের অভিযোগ, আমরা অর্ডার দিয়ে আসছি। বলে মাল এলে পাবেন। এখন বুঝতে পারছি না দাম বাড়বে, নাকি বাড়বে না। বাড়লে বাড়িয়ে দিক, মানুষের তো চলতে হবে। কিন্তু তা-ও দিচ্ছে না। শুধু ৫ লিটার নয়, ১ লিটার, ২ লিটার ঘাঁটাঘাঁটি করলে পাওয়া যায়। কিন্তু তা-ও চাইলেই নয়। দোকানিদের রেগুলার কাস্টমার হলে পাওয়া যাবে নতুবা- স্রেফ নেই। এভাবেই চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ক’দিন পর পর বাণী আওড়াচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন আমদানি ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান খুব বেশি নয়। ৬টির মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ। এরা একটা সিন্ডিকেট। আরো বেশি কোম্পানি থাকলেও বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এ ছয় কোম্পানিই রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার এদের কাছে গেলেই তারা আকাশে চোখ তুলে কথা বলেন। ভাবখানা এমন যে এ বিষয়টি তারা জানেনও না এবং এজন্য তারা ডিলার বা এ জাতীয় যারা, তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে এই করবেন সেই করবেন এক দফা বুঝিয়ে দেন। কিন্তু আসলে সব কারসাজির হোতা এসব প্রতিষ্ঠানই। সরকার এটা বুঝেও না বোঝার ভান করছে এবং মানুষের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের একটা সুযোগ নিচ্ছে।
এমনিতেই মাস তিন-চার থেকে তেলের এমন ক্রাইসিস। এরপর উপায়ন্তর না দেখে ফাঁকা আওয়াজও ছাড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। জানাচ্ছেন, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের কাছে ভোজ্যতেল বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পণ্য নিতে বাধ্য করলে বা কোনোরকম শর্তারোপ করলে প্রতিষ্ঠান ও ডিলারদের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবেÑহুংকার, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
সিয়াম সাধনার মাসকে কেন্দ্র করে ভোজ্যতেলের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। বাজারে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘বাজারে তেল কিনতে গেলে একই সঙ্গে নানা ধরনের অন্যান্য পণ্য কিনতে ভোক্তাদের শর্তারোপ করা হচ্ছে। আমরা বাজারে গিয়ে এসবের প্রমাণ পেয়েছি, কিন্তু পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো তা অস্বীকার করছে। বাজারে কোথাও এ অবস্থা দেখতে পেলে কোম্পানি ও ডিলারদের জরিমানা করা হবে।’
ভোজ্যতেলের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে টেকসই সমাধান হিসেবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন এবং সরবরাহের তথ্য উন্মুক্ত করতে মিল মালিকদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিমাণ তেল পরিশোধন করা হচ্ছে তা দ্বিগুণ করতে হব। সেইসঙ্গে প্রতিদিন তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ কত কোম্পানিগুলোকে তা দৈনিক ভোক্তা অধিদফতরকে জানাতে হবে।’
এ সময় কোম্পানি বা মিলমালিক ও ডিলারদের সঙ্গে দৈনিক উৎপাদিত, পরিশোধিত, মজুদ ও সরবরাহকৃত তেলের তথ্য আদান-প্রদান সহজতর করতে একটি সফটওয়্যার তৈরির ব্যাপারে তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
সভায় উপস্থিত বক্তাদের কেউ কেউ ডিলারদের বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ করলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ছয়টি তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানে তেল পরিশোধন হওয়া সত্ত্বেও বিগত তিন-চার মাস ধরে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কারণ নির্ধারিত তারিখে পণ্য দেওয়া হয় না। ভবিষ্যতে এ রকম করলে আমরা এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো।’
আলোচনার এক পর্যায়ে অধিদফতরের পরিচালক ফকির মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাজধানীর ৪টি বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে খুচরা দোকানে তেল কম। কারণ ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তেলের সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন পণ্য কেনার শর্তজুড়ে দেওয়ার বিষয়টির ও সত্যতা পাওয়া গেছে। পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে তারা কোনো রশিদ দেখাতে পারছে না। আবার দেখা গেছে খোলা তেলের দাম বোতলজাত তেলের চেয়ে বেশি।’
সভায় উপস্থিত নিউমার্কেটের দোকানি বলেন, ‘বাজারে ৫ লিটারের তেল নেই, বর্তমানে বাজারে কোন কোম্পানির তেল নেই। আমরা ৫ কার্টন চাইলে আমাদের এক কার্টন দেওয়া হয়। তেল চাইলে সঙ্গে পোলাও চাল, আটা, লবণ, চা-পাতাসহ অন্যান্য পণ্য কেনার শর্তজুড়ে দেয় তারা। তেলের অর্ডার নিয়েও তারা এসব পণ্য দিচ্ছে।’
অন্যদিকে টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার বাজারে সরবরাহ কম থাকার বিষয়ে বলেন, ‘বিদেশ থেকে সয়াবিন আসতে ৫০-৬০ দিন ও পাম তেল ১০-১২ দিন সময় লাগে। রমজান উপলক্ষে দুটি কোম্পানি দ্বিগুণ এলসি করেছে কিন্তু সেপ্টেম্বরের এলসি অক্টোবরের শেষদিকে করা হয়েছে এবং পণ্য ডিসেম্বরে আসার কথা থাকলেও ব্রাজিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জাহাজ চলাচল ১৫ দিন বন্ধ থাকায় এই দেরি হয়েছে। আগামী ২৪ তারিখে বড় ধরনের চালান আসবে, আশা করি ২৬ ফেব্রুয়ারির পর তেলের সংকট হবে না।’
সভায় অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, ভোজ্যতেল মিলমালিক, বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারস অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ, খুচরা ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী, কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতর সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আমদানির চিত্রে যা আছে
ভোজ্যতেল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সময়ে ৬৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে হয়েছে ১৫ কোটি ৮৩ লাখ, অক্টোবরে ২২ কোটি ৭২ লাখ এবং নভেম্বরে ২৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল। ২০২৩ সালে একই সময়ে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) ৬৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি হয়। যার মধ্যে সেপ্টেম্বরে ১৯ কোটি ৪২ লাখ এবং অক্টোবর ও নভেম্বরে যথাক্রমে ২২ কোটি ২৫ লাখ ও ২৪ কোটি ১৯ লাখ ডলারের ভোজ্যতেল রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অনেক বেশি আমদানি
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৩ লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। বাকি ২১ লাখ টনের চাহিদা পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। এ হিসাবে দেশে ভোজ্যতেলের মাসিক চাহিদা ১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। ভোজ্যতেল আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৫ মাসে চাহিদার চেয়ে আমদানি হয়েছে বেশি। প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ২ লাখ ৮৬ হাজার ৫১ টন।
সবশেষ
বিগত কোনো সময়েই এভাবে ‘মার্কেট আউট’ ভোজ্যতেলের ক্রাইসিস ঘটেনি। কিন্তু এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমনটা হওয়া এ সিন্ডিকেটের কারসাজি বলেই সাধারন মানুষ প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দাম বাড়ালে বাড়াক। কিন্তু তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বসে থেকে আমাদের জিম্মি করার কী অর্থ হতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাজারে বেশ কিছু ব্রান্ডের তেল বাজারজাত হচ্ছে। এগুলো হলো- তীর, ফ্রেশ, বসুন্ধরা, রূপচাঁদা, সেনা, পুষ্টি, এস আলম অন্যতম।