বাংলাদেশিদের গড় আয়ু পেরিয়ে বেশ কয়েক বছর বোনাস পেয়ে বেঁচে আছি প্রবাস জীবনে অস্ট্রেলিয়ায়। অবসর জীবনে ভালোই সময় কাটছে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করে। বসবাসের জন্য দুনিয়ার অন্যতম সেরা দেশে থেকেও মন পড়ে থাকে মায়ের দেশ বাংলাদেশে।
প্রবীণদের যেমন হয় ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ সবকিছুই আছে। কয়েকবার করোনা আক্রান্ত হয়েছি। চারবার করোনা ভ্যাকসিন, নিয়মিত ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় প্রবীণদের বিশ্ব সেরা স্বাস্থ্যসেবার কল্যাণে অনেকটাই নিরাপদে আছি। জানি না, কঠিন উইকেটে দুসরা, রিভার্স সুইং মোকাবিলা করে কতদিন নট আউট থাকবো। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা সব সময় সহায়তার জন্য।
জন্ম হয়েছে ঝালকাঠিতে। শৈশব, কৈশোর কেটেছে ছায়া সুনিবিড় ফরিদপুর শহরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে, পরে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি খুলনা শহরে। ফরিদপুর জিলাস্কুল, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ শেষে পড়েছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিশোর বয়স থেকেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি, খেলা নিয়ে লিখেছি, খেলা দেখেছি নিয়মিত ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের ক্রীড়া সমাজের সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। এখনো ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত এবং সুযোগ পেলে মাঠে ক্রিকেট দেখি, ক্রিকেট নিয়ে লিখি নিয়মিত।
বুয়েট থেকে কেমি কৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে শিল্প ব্যাংক, তিতাস গ্যাস, বিজিএসএল, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস, জালালাবাদ গ্যাস এবং জিটিসিএল কাজ করেছি ১৯৭৭-২০০৫ পর্যন্ত। দক্ষতা আছে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন থেকে শুরু করে গ্যাস সঞ্চালন, বিতরণ অর্থাৎ সম্পূর্ণ গ্যাস সাপ্লাই চেইনে নিবিড়ভাবে কাজ করার। কাজের সূত্রে ঢাকা ছাড়াও কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশকে দেখেছি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নিবিড়ভাবে। ২০০৫ কায়েমি স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্রে পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বাঁচার তাগিদে চাকরি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। সেই থেকে ২০ বছর থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান, কাতার এমনকি তানজানিয়ায় কাজ করেছি। অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে বাংলাদেশ, ভারত সফর করেছে নানা প্রশিক্ষণের কাজে। চাকরি জীবনে প্রশিক্ষণের জন্য এবং অন্যান্য কাজে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমার, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যঠহু, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, দুবাই, আবুধাবি সফর করার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশে চাকরিকালীন বেশ কিছু কঠিন কাজে জড়িত ছিলাম। টঙ্গী থেকে সাভার এলাকায় গ্যাস সরবরাহ, হবিগঞ্জ থেকে আশুগঞ্জ গ্যাস পাইপলাইন, কুমিল্লার বাখরাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ পাইপলাইন, বিয়ানীবাজার-কৈলাশটিলা গ্যাস পাইপলাইন, রশিদপুর-আশুগঞ্জ লুপ লাইন নির্মাণকাজে সম্পৃক্ত ছিলাম। জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়ন, এমনকি বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা ছিল। সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নেও ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিল। ৎিরঢ় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকায় ভোলার শাহাবাজপুর থেকে খুলনার দিঘলিয়া পুরো অঞ্চল চষে বেড়িয়েছি। মায়মানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারত পর্যন্ত প্রস্তাবিত তিন জাতি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রস্তাব নিয়েও বাংলাদেশের হয়ে মুক্ষ আলোচক ছিলাম। বিজিএসেল এবং জিটিসিএলের ভোরের পাখি ছিলাম। যমুনা পেরিয়ে পশ্চিম অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছি। ফৌজদারহাট, ডেমরা, আশুগঞ্জ, বাঘাবাড়ি গ্যাস স্টেশনগুলো উন্নয়নে কাজ করেছি। ২০ বছর পেরিয়েও আমার কর্মস্থলের স্মৃতিগুলো অম্লান। চোখ বুজলেই কত স্মৃতি মনে পরে। এখনো দেশে গেলে সুযোগ পেলেই কাজের দেখতে যাই। আমার লাগানো ফল গাছে ফল ধরেছে, ফুল গাছ গুলো এখনো আছে। সিলেট ৭ কূপে তেল পাওয়ার পর প্রথম বছর আমি ব্যাবস্থাপক উৎপাদন হিসাবে কর্মরত ছিলাম। অগ্রজ সহকর্মী প্রয়াত কাজী শাহিদুর রহমানকে দেখেছিলাম আরো চারটি তেল কূপখননের প্রস্তাব পেশ করতে। জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে কাজ করার সময় ছাতক, সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহে মাধ্যমে গ্যাস বিতরণ কার্যক্রম সমন্বিত করেছিলাম। গ্যাস সরবরাহ চেইন জানা থাকায় জিটিসিএলের পরিচালক অপারেশন হিসেবে কাজ করতে সুবিধা হয়েছিল।
সম্পৃক্ত থাকার জন্য কায়েমি স্বার্থবাদীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ, বিয়ানীবাজার-কৈলাশটিলা এবং রশিদপুর-আশুগঞ্জ লুপ লাইনের হবিগঞ্জ আশুগঞ্জ পাইপলাইন সঠিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে সঠিক মূল্যে সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল। ইন্টিগ্রেটেড গ্যাস সঞ্চালন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালনার জন্য স্কাডা সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। সরকার, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড আমার দক্ষতা বিষয়ে অবগত ছিল। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের হয়ে আমাকে কিনোট প্রেজেন্টেশন করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সৃষ্টির প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা সফরে উচ্চ ক্ষমতার দলে আমি অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। পেট্রোনাস সফর এবং মায়ানমার থেকে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রস্তাব বিবেচনায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছি।
২০০০ সালে জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন কাজে ইউনোকোল এবং দেশীয় ঠিকাদার ম্যাক্সওয়েল গ্রুপের মধ্যে বিবাদ আরবিট্রেশনে রূপ নিলে সরকার আমাকে সিঙ্গাপুর আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষী দেয়ার নির্দেশ দেয়। ম্যাক্সওয়েল গ্রুপ পাইপলাইন নির্মাণ করে, পাইপলাইন কমিশনের পর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। এমতা অবস্থায় ইউনোকোল চুক্তি বাতিল করে এবং ঠিকাদারের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জব্দ করে। আমি লিখিতভাবে অরিত্রটিও কোর্টকে জানিয়েছিলাম ফিডিক ফর্ম অব কন্টাক্ট অনুযায়ী ঠিকাদারের প্রতি অন্যায় হয়েছে। আমাকে আদালতে উপস্থিত হতে দেওয়া হয়নি। আমার সরকারি আদেশ অনুযায়ী, যাবতীয় খরচ ঠিকাদার বহন করার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৫ এসে কোনো অজুহাত না দেখিয়ে আমাকে জিটিসিএলের পরিচালক অপারেশন চুক্তি বাতিল করা হয়, তখন বিএনপি-জামায়াত সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
আমরা চাকরিরত অবস্থায় গ্যাস সরবরাহ সংকট ছিল না। কায়েমি স্বার্থবাদী মহল এনার্জি সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে সবে লুটপাট শুরু করেছিল। ২০০৫-২০২৫ কোথায় এখন গ্যাস সেক্টর এনার্জি সেক্টর সবাই জানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করলেও নিয়মিত এনার্জি পাওয়ার পত্রিকায় লিখেছি এখনো লিখছি। নিজের লব্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশে গেলে প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। বাংলাদেশের গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সেক্টরের কারিগরি জনশক্তির প্রশিক্ষণ কাজে জড়িত থেকেছি।
প্রতিদিন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবি। দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি পরিবেশ সম্মত উপায়ে কয়লা উত্তোলন করতে, গ্যাস তেল আহরণ এবং উত্তোলনকাজ জোরদার করতে, পেট্রোবাংলা কোম্পানিগুলোতে কারিগরি পেশাদারদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে।
৭২ থেকে আর কত বিস্তৃত হবে ইনিংস জানি না। ২০২৬ নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ যাবো। যদি দেশের হয়ে কিছু করার থাকে করবো। সবাই আমার জন্য আমাদের জন্য দোয়া করবেন।