২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৪:১৩:৩৫ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৯-২০২২
কথার কথকতা


‘না’-সূচকতাকে বাংলায় নেতিবাচক বলা হয় আর ‘হ্যাঁ’-সূচকতাকে বলা হয় ইতিবাচক। এ দুটো শব্দ একসময় আমিও ব্যবহার করতাম, কিন্তু বড় হবার পর যখন ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলাম, তখন ‘ইতিবাচক’ শব্দটার ব্যাপারে আমার মধ্যে আপত্তি দেখা দিলো। ইতি মানে হলো শেষ, তাহলে এটা পজিটিভ শব্দের বাংলা অর্থ হিসেবে ব্যবহারের কি যুক্তি থাকতে পারে?

এ সমস্যাটি বুঝবার পর থেকে আমি আর ইতিবাচক কথাটি ব্যবহার না করে এর বদলে ‘হ্যাঁ’-সূচক কথাটি ব্যবহার শুরু করি। এর মধ্যে আবার হাইফেন ব্যবহার এড়িয়ে যাবার একটা গণপ্রবণতা দেখা দিলে আমিও প্রভাবিত হই এবং শব্দটিকে ‘হ্যাঁ সূচক’ লিখতে শুরু করি। আজ কলাম লিখতে বসলে প্রথমেই শব্দ দুটো সামনে এসে উপস্থিত হয়।


এই কলামের বিগত দুটো বা ততোধিক লেখায় ‘না সূচকতা’ সম্পন্ন অর্থাৎ নেতিবাচক বিষয়াবলি লিপিবদ্ধ হয়েছে। চেনাজানা মানুষের না বলা কথাগুলো লিখবো বলে কথা দেয়ার পর নেতিবাচক বিষয়াবলিই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এর কারণ হলো, মানুষের বলতে না পারা কথাগুলো সাধারণত কষ্ট বিষয়কই হয়। লেখা থেকে কষ্ট এড়িয়ে চলতে হলে শতভাগ আনন্দে পরিপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখতে হয়।

মানুষের জীবনে আনন্দের জোয়ার খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং কষ্টের কাহিনিই থাকে বেশি আর তাই লিখবার জন্য চমৎকার বিষয় পাওয়া খুবই কঠিন। তারপরও কষ্টকর বিষয় কিছুদিনের জন্য এড়িয়ে যাবো এরকম কথা যখন দিয়েছি, তখন তা রক্ষা করার চেষ্টা তো করতেই হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজকের লেখা লিখবো এমন বিষয় নিয়ে যাতে দুঃখ-কষ্ট থাকবে না বা কম থাকবে।

আজ যে বন্ধুটির জীবন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে লিখবো সে ছেলেবেলা থেকেই বেশ লাজুক প্রকৃতির মানুষ। মেয়েদের ব্যাপারে কখনো স্পষ্ট হতে পারে না, সঙ্কোচ বোধ করে। ছেলেবেলা থেকে পারিবারিক কড়াকড়ির মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে রোমান্টিক অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া বা চাষাবাদ করার সাহস খুবই কম। শিশু বয়স থেকে কৈশোরে প্রবেশের এই জটিল সময়ে একবার মেয়েলি একটা বিষয়ে মায়ের বকা খেয়েছিলো। এক চাচাতো বোন নতুন কানের দুল পরে বিকেলের রোদে উঠোনে বসে অন্যদের সাথে গল্প করছিলো। রোদ পড়ে কানের দুলগুলো কানের মালিকের নড়াচড়ার সাথে সাথে চমক দিচ্ছিলো।


এটা দেখে এই সরল ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে কাজিন সিস্টারের কানের দুলটি ধরে উলটে-পালটে দেখতে থাকলো আর মায়ের দৃষ্টিতে পড়ে গেলো। করছে কি ছেলেটি! আসলে সহজ-সরল শিশুটির ঔৎসুক্যের কদর কেউই কখনো করেনি। মা তার বাচ্চাটাকে ঘরে নিয়ে খুব বকা দিলেন। বলে দিলেন- খবরদার, কখনো মেয়েদের কাছেও ঘেঁষবি না। তার মা তখন ছেলেকে এই বকা দেবার ভালো দিকটি ভেবেছেন, খারাপ দিকটি ভাবেননি।

এরকম অনেক কারণে ছেলেটি বড় হবার পরও মেয়ে মানুষ এবং মেয়েলি বিষয়সমূহে শিশুরও অধম হয়ে রইলো। এই ছেলেটিরই বিবাহিত জীবনের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যা নিয়ে তার স্মৃতিচারণ আমরা আজ ভাষাবন্দি করবো যেটি কারো জন্যই খুব বেশি কষ্টকর হবে না। এটি রোমাঞ্চ এবং বেদনার একটা ঝাল-টক-মিষ্টি ককটেল চকোলেট হয়ে উঠতে পারে। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, পড়বার সময় আছে তো হাতে? খুব লম্বা সময় নেবো না, ছোট্ট করেই লিখবো।

এরই মধ্যে আমাদের এই হাবলা বন্ধুটির জীবন নদীতে অনেক স্রোত বয়ে গেছে, উজান-ভাটি ঘটেছে, নৌকাডুবি জাতীয় দুর্ঘটনাও ছিলো। অতঃপর জীবনের এক স্তরে যখন অভিজ্ঞতার তিক্ত হাতের অনেক কিল-চড়-থাপ্পড় খেয়ে একটু স্থিতিশীল হবার পথে তখন সে এক অন্যরকম সমস্যার মধ্যে পড়লো। তার জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে এই সমস্যা। ওকে তার কাছে কখনো বালিকা, কখনো মহিলা আবার কখনো রহস্য মনে হয়।

আপনারা হয়তো বলবেন, সেটা আবার কেমন জটিলতা? এওকি সম্ভব! তার মতে ওকে যখন মুখের একপাশ থেকে দেখি, তখন মনে হয় সে একটি বালিকা, আবার যখন অন্যপাশ থেকে দেখি, তখন মনে হয় মহিলা। সরাসরি সামনে থেকে দেখলে কি মনে হয়? সরাসরি সামনে থেকে দেখলে মনে হয় রহস্যজনক, ওই দুই রকমের মিশ্রণ, স্পষ্ট করে বুঝবার আগেই মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলতে হয়। কারণ বউ যখন চোখ তুলে তাকায়, তখন আমাদের এই বন্ধুটি হয় চোখ নামিয়ে ফেলে অথবা অন্যদিকে তাকায়।


চার দশকেরও বেশি সময় পরও তাকে টোকা দিয়ে দেখলাম, অবস্থা প্রায় ওই রকমই রয়ে গেছে। একজন আরেকজনের কাছে পারিবারিক তৈজসপত্রের মতো হয়ে গেলেও বন্ধুটির কাছে তার স্ত্রী এখনো এক রহস্য-মানবী। তার বক্তব্য হলো, আদম স্যারও পুরা জীবনে হাওয়া ম্যাডামকে স্পষ্ট করে বুঝতে পারা দূরে থাক পরিপূর্ণভাবে দেখার কাজটিও সেরে উঠতে পারেননি। এটা সৃষ্টির একটা জটিল রহস্য।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আজকের লেখাটি আর দীর্ঘায়িত করবো না। আপনারা কি আমাদের এই বন্ধু, তার জীবন সাথী এবং যুগল জীবনের রহস্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চান? আমি ওর কথা শুনবার পর একটা উপসংহার টানবো বলে ভাবছিলাম, কিন্তু এই স্তরে এসে আর সাহস পেলাম না। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যে বিষয়টি রহস্যের মায়াজালে জড়িয়ে রেখেছেন তা আমরা কীভাবে উন্মোচিত করতে পারি। আমি নিজেও তো এই রহস্যের জালে আটকে আছি। অনেক সময় আমি নামক আমাকেই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

শেয়ার করুন