০১ মে ২০১২, বুধবার, ০১:৫৬:২২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে এবার বন্দুকধারীর গুলিতে তিন আইনশৃংলাবাহিনীর সদস্য নিহত ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের প্রতিভা বিকাশে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবে না’ সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ


রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারনে বিপ্লবী নেতা সাইফুল হক
ঘুমের মধ্যেই দেখতাম মিছিল হাটছি বিক্ষোভ করছি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৪-২০২২
ঘুমের মধ্যেই দেখতাম মিছিল হাটছি  বিক্ষোভ করছি বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সাইফুল হক


বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সাইফুল হক এর জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। মাতা-পিতার তিনি বড় সন্তান। মাকে হারিয়েছেন তার জন্মের সোয়া তিন বছরের মাথায় ১৯৫৯ সালে, আর বাবাকে হারিয়েছেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৬০ সালে তাদের পরিবার স্থায়ীভাবে নিবাস গড়েন বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার লকপুর গ্রামে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়, খুলনা ল্যাবরেটরী হাইস্কুল, খুলনায় বিএল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবন কাটে। ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী বহ্নিশিখা জামালীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৮২ সালে। তাদের একমাত্র সন্তান মোশরেকা অদিতি হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সাথে জীবনের বেশ কয়েকটি স্মরনীয় ঘটনা তিনি তুলে ধরেন। স্মৃতিচারণটি তুলে ধরা হলো। 

রাজনৈতিক দিক থেকে বলতে হয় যে উনসত্তর সালের গণঅভুক্ষান আমার জীবনে এক স্মরনীয় ঘটনা।  উনসত্তের জানয়ারিতে আমি তখন খুলনায়। গ্রামে গেছি। গ্রাম থেকে আমরা তখন দল বেধে খুলনায় যাচ্ছি ছাত্র ধর্মঘটে যোগ দেবো। বেশ শীত তখন। আর সে জন্য রুপসা নদী পার হতে পারছি না। কারণ ঐদিন প্রচন্ড ঠান্ডা ও বৃষ্টি। কিন্তু খবর পেলাম যে খুলনা জেলা স্কুলে সবাই জমা হচ্ছিল। খুলনা ল্যাবরেটরি স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র আমি। কিন্তু আমি সেখানে যেতে না পারায় কান্না পাচ্ছিল। কস্ট পাই। চোখে পানি চলে এসেছিল। অবশ্য তার দু’দিন পর হোস্টেলে চলে আসি। ধর্মঘটে অংশ নেই।

দেখলাম হাজার হাজার শ্রমিক রাজপথে। সব্বাই বিক্ষোভে উত্তাল। আমার মনে হয় দেশে বিপ্লব মনে হয় সন্নিকটে। মনে হচ্ছিল আমরা কেবল একটা স্বাধীন দেশ পাবো না, পাবো একটা বিপ্লবী সমাজ দেশ পাবো। সারাক্ষণ ভাবতাম বিপ্লবের দারপ্রান্তে আমরা। মনে আনন্দে দিন কাটতো। নাস্তা খাওয়া বা দুপুরের খাওয়া দাওয়ার খবরই থাকতো না। রাতে আসতাম স্কুল হেস্টেলের রুমে। সারা শরীরে উত্তেজনা বিল্পর দ্বারপ্রান্তে এসেছে মনে করে। রাতে স্বপ্ন দেখতাম। ঘুমেই দেখতাম মিছিলে হাটছি,বিক্ষাভ করছি। 

এরপর একাত্তর সালের একটা ঘটনা মনে পরে। ১৯৭১সালে আমি ক্লাস টেইনে পরি। ১৯৭২ সালে আমার মেট্টিক দেয়ার কথা ছিল। আমাদের বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানায় লগপুর গ্রামে। ২৫ মার্চের কথা। স্কুলে পড়ি। তখন চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। আমি তখন প্রথম আমাদের বর্তমানের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি প্রথম শুনতে পাই রেডিওতে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে তখন  ফিলিপস রেডিও ছিল।। কাকেই জাতীয় সঙ্গীত শুনতে পাইে। জাতীয় সঙ্গীত শুনেতো মনের মধ্যে উত্তেজনা আরো বেড়ে গেলো।

আমরাতো স্বাধীন হয়ে যাচ্ছি। আর তখনতো শহরের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। শহরের ছাত্রদের একটা অংশ গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। তো আমরা ছাত্ররা তখন দলবেধে বেধে গ্রামে  গ্রামে গিয়ে এই জাতীয় সঙ্ঘীত গাইতাম। হাতে থাককো ডামি পিস্তল,কাধে থাকতো খেলনা বন্ধুক। আমি তখন স্কাউটিং করতাম। তো এভাবে প্রায় প্রতিদিনই আমরা স্কুলে ছাত্ররা জাতীয় সঙ্ঘীত গেয়ে গেয়ে লগপুর গ্রামের একটা বিশাল মাঠ ছিল তাতে জমা হতাম। এর অর্থ হচ্ছে মনের মধ্যে তখণ  স্বাধীনতার একটা প্রচন্ড উত্তেজনা।

বিবিসি’র ছিল তখন একটা বিরাট ভুমিকা। বিবিসি’র সংবাদ শুনতে তখন আমাদের বাড়ির উঠানে তখন সবাই জমায়েত হতো। তখন এ অয়োজনে সবাই আসতো। কিন্তু যারা সেদিন সে সময়ে বিবিসির সংবাদ শুনতে পারতো না তাদেরকো আবার আমাকে শুনাতে হতো। তারা জানতে চাইতো বিবিসি কি সংবাদ দিয়েছে ,কি বলেছেন? দেখা গেলো আমিই বিবিসির সাংবাদিক হয়ে সববাইকে তা বলতে হতো। এটাই আমার প্রতিদিনের দায়িত্ব ছিল। এটা অবশ্য কয়েকদিন চলেছে। পরে আস্তে আস্তে দিন পাল্টাতে থাকে। গ্রামে শান্তি বাহিনী গঠনের তোড়জোর শুরু হয়েছে। আমাদের গ্রামে তখন প্রচুর রাজাকাররা কর্মকান্ড শুরু করলো।

আমাকে তখন বাড়ি থেকে পরামর্শ দেয়া হলো গ্রামে না থাকার জন্য। আমি তখন জায়গা বদল করে চলে যাই। আমিতো তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সাথে কাজ করি। ৭০ শেষ দিকে বিপ্লবী ছ্রাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হই। তখন আমরা কয়েকজন ছ্রাত্ররা মিলে হাতে লিখে প্রতিদিনে মুক্তিযদ্ধ সংক্রান্ত কি কি খবর আছে তা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতাম। আর গ্রামে গ্রামে পতাকা লাগিয়ে দিতাম। কিন্তু এর পর থেকেতো রাজাকাররা তৎপরতা আরো বেশি বাড়িয়ে দেয়। এত করে হলো কি আমরা আমাদের পতাকা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাংগিয়ে দিতাম। আর পাকিস্তানিরা এসে রাজাকারদের সহায়তায় সেসব পতাকা নামিয়ে দিতো। আমাদের টিম গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা ছিড়ে ফেলে দিয়ে আবার আমাদেরই জাতীয় পতাকা গ্রামে গ্রামে উঠিয়ে দিতাম। এভাবে চলছিল ঠিকই ।

কিন্তু পাকিস্তানিরা আরো বেশি তৎপর হলে আমাদের পক্ষে গ্রামে একাজ চালিিেয় যাওয়া হয়নি। নিজ পাশের গ্রামে আশ্রয় নিযেছি তখন। তবে ভারতে যাইনি। দেশেই ছিলাম। তো এভাবে তিন চার মাস কেটে যায়। ঠিক অক্টোবরের শেষে আমাদের গ্রামের পাশে এক মামা ছিলেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার দায়িত্বে ছিলেন। তার বাড়ি ছিলো খুলনার তেরো খাদায়। নভেম্বরের ১০ তারিখের দিকে সে মামার নেতৃত্বে লগপুর ইউনিয়নের পাশে গ্রামের এক স্কুলে উপস্থিত হন। এখানে ক্যাম্প করা হয়। সে ক্যাম্পে আমিও সেখানে থেকে যাই। তার সাথে কাজ করি। সেখান অনেক কিছু লেখালেখির ব্যাপার ছিল তা করি। ওনার সাথে থাকি। বলা যায় দেশ বিজয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত।

এসময়ে রাজাকারদের সাথে আমার সে মামার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এতে রাজাকাররা পরাজিত হয়। বন্দি হয়। এবং তাদের কে সেই স্কুল মাঠে নিয়ে আনা হয়। চলে বিচার কার্য। সন্ধ্যা বেলায় বিচার কাজ শুরু হয়।  প্রায় দীর্ঘক্ষণ বিচার চলে, বলা যায় রাত অবধি। আর এসব রাজাকারদেরতো সকাল থেকেই মাঠে পিঠমোড়া দিয়ে বেধে রাখা হয়। রাত পর্যন্ত এভাবেই চলে। এক পক্ষ এদেরকে পাকিস্তানিদের সাথে আতাতের কারণে মেরে ফেলার ব্যাপারে বিচারের রায় দেয়। আরেকপক্ষ তাদের শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দিতে বলে। তবে এদের মধ্যে অনেকে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। কেহ কেহ জানায় তারা কি কি কারণে রাজাকার হয়েছে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে এমন ভুল পথে এসেছে তারা।  কারো কারো মুখে উঠে আসে কিভাবে চাপে পড়ে রাজাকার হয়েছে। কেউ জানায় অভাবের তাড়নায় রাজাকার হয়েছে।জানায়।

এদের কথা শুনে খানিকটা বিশ^াসযোগ্য বলে মনে হয়। একপর্যায়ে বিচারে রায় হয় যে এদের মাফ করে দেয়া হবে। এদের মধ্যে একজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকিদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করতে রাখা হয়। তবে এদের গতি বিধি পর্যক্ষেণে আমাদের পক্ষ থেকে দু’জনকে দায়িত্ব দেয় হয়। আর পুরো বিচার কাজের রায়টা বলা যায় আমার উপরই ছেড়ে দেয়া হয়। আমি তখন এদের ক্ষমা করে দেয়ার ব্যাপাারে বলি। তবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করার শর্তে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে অবশ্য জানতে চাওয়া হয় যে তারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে চায় কি-না? এর মত দিলে ছেড়ে দেয়া হয়। তকে আমাদের নজরদারির মধ্যে থাকতে হং।  আসলে বিষয়টা ছিল যদি সেদিন বলা হলো তাদের মেরে ফেলতে তাহলে সাথে সাথে গুলি করেই মেরে ফেলা হতো। যার এটা আজও মনে পরে। আমার কারণেই তাদের প্রাণ বেচে যায়। 



শেয়ার করুন