২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৫:৪৩:০২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


বিজয়ের আনন্দ
ফকির ইলিয়াস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১২-২০২২
বিজয়ের আনন্দ


বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিজয়ের পতাকা। মানুষজন খোঁজখবর নিচ্ছেন  প্রিয়জনের। কে কেমন আছেন! কোথায় আছেন। এ যেন ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত একটি দেশ। সড়ক নেই, সেতু নেই, আগুনে পোড়া স্তূপ, নদীতে নদীতে তখনো ভেসে উঠছে লাশ। কার লাশ কে দেখবে!

কী এক বিষণ্ণতায় ভরা বিজয়ের আনন্দ। ভারতের দিল্লিতে পশ্চিম জার্মানির এক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘পাকিস্তানের অঞ্চল নিজেদের দাবি করার কোনো আকাক্সক্ষা ভারতের নেই। আমরা বাংলাদেশের জন্যই লড়াই করেছি। এমনকি আমরা যতো শিগগির সম্ভব বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেবো।’

ভারতীয় সৈন্যরা কবে বাংলাদেশ ছাড়তে পারে জানতে চাইলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী কবে নাগাদ বাংলাদেশ ছাড়বে তা বলা শক্ত। তবে এটি বাংলাদেশ সরকারের ওপরেই নির্ভর করছে। সেখানকার জনগণের নিরাপত্তা এর সঙ্গে জড়িত।’ এদিন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান আইন প্রশাসক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রেডিও পাকিস্তানে জাতির উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘১৪ দিনের যুদ্ধে কেবল যুদ্ধবিরতি হয়েছে মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান আমাদের অধিকার এবং আমাদেরই দেশ। পূর্ব পাকিস্তানকে যতোক্ষণ না আমরা আমাদের দখলে আনতে পারবো, ততোক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবো। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই পাকিস্তানকে আমরা সত্য করে তুলবো, এই বিশ্বাস আমার আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদেরকে সাময়িক ধৈর্য ধরতে হবে। নতুন সংবিধান শিগগির রচিত হবে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা হবে। তবে আমাদের কিছুদিন সময় দিতে হবে।’

জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান ও সামরিক প্রশাসকদের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের লোভ আর খামখেয়ালিপনার কারণে আজ পাকিস্তানের এই অবস্থা। আমরা চাই না দেশে কোনো সামরিক আইন চালু থাকুক। আমরা জনগণের হুকুম ছাড়া এক ইঞ্চি মাটিও সামনে এগোতে পারি না। পাকিস্তানের জনগণের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি রূপেই আমি আমার ভাষণ দিচ্ছি, এটি আমার পদাধিকার বলে নয়। গত নির্বাচনে আপনারাই আমাকে নির্বাচিত করেছেন। আমার বিরোধীরা আজ বলছেন, আমি ক্ষমতা লোলুপ হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি তা নই। আমি দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়েছি। এই সংগ্রামের ফল আমরা বৃথা যেতে দিতে পারি না।’

ভুট্টো বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নিয়ে তার বক্তব্যে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সমাধান শুধু একটি শর্তের মধ্যেই রয়েছে। সেই শর্ত হলো পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থাকতে হবে। এই কাঠামো যদি ছাড়া ছাড়া হয় তাতেও কিছু যায় আসে না। এক ও সম্মিলিত পাকিস্তান এই আদর্শের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানকে থাকতে হবে অবশ্যই। যেসব বিরোধ আমাদের মধ্যে পূর্বে হয়েছে যেসব বিরোধ আমাদের মধ্যে এখনো আছে, তার মীমাংসা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ও জনগণের মধ্যে হবে। এর মধ্যে কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ চলবে না। নিশ্চিতভাবে ভারতীয় সৈন্যদের এবং অপরাপর বিদেশি শক্তির দ্বারা পাকিস্তানি অঞ্চল দখলের দ্বারা এটির সমাধান হবে না। মুসলিম বাংলা সর্বদাই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকবে।’ এর সবই ছিল পাগলের প্রলাপ। ভুট্টো, নিজ দেশের মানুষকে ফাঁকি দিয়েছিলেন মাত্র!

এদিকে ঢাকায় ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ডা. এ এম মালিক অস্ট্রিয়াতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। অস্ট্রিয়া সরকার তাকে জানিয়েছেন যে, রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হবে না এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলে তার ও তার পরিবারের ভিসা মঞ্জুর করা হবে। ডা. মালিককে নিরাপত্তার স্বার্থে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি অফিসারদের সঙ্গে রাখতে বলা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বাঙালি’।

এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ মানুষের পুনর্বাসনের কাজ তরান্বিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রামে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ওইদিন সন্ধ্যায় জহুরুল হক হলে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার জন্য সর্বপ্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘তার মুক্তির জন্য ভারত বিশ্ব মহলে সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এ সময়ে বেগম মুজিব অরোরাকে চা পানের অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি করে আমি আপনার বাড়িতে এসে পেট পুরে খাবো।’ ২০ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস বলেন, ‘আত্মসমর্পণের আগে ২০০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি জান্তা। এর জন্য দায়ী ১০ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা। তারা সবাই মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল ও ক্যাপ্টেন। আমি গতকাল তাদের নাম জানতে পেরেছি। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিটির মতো আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন গণহত্যা ও পৈশাচিকতা আর সংগঠিত হয়নি।’ তবে তিনি তার বক্তব্যে সাংবাদিকদের এই ১০ সামরিক অফিসারের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সময় হলেই নাম প্রকাশ করা হবে।’

এদিন পিটিআইয়ের সাংবাদিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জন স্টোনহাউস বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার এ সপ্তাহেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারণ জুলাই মাসে যখন আমি হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব তুলেছিলাম তখনই ৬৩০ জন সদস্যের মধ্যে ২১০ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে সই করেছিলেন। তবে তখন কোনো রক্ষণশীল দলের সদস্য সই করেননি। কিন্তু এবার সমান সংখ্যক সরকারি ও বিরোধীদলের সদস্য তাতে সই করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এই প্রস্তাব হাউস অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।’

২০ ডিসেম্বর যুদ্ধবন্দি হিসেবে ঢাকা থেকে কলকাতায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ উড়োজাহাজে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ঢাকা থেকে কলকাতায় নিতে সহায়তা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ধারণা করা হয়, তাদের ফোর্ট উইলিয়ামে রাখা হয়েছে।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের এক মুখপাত্র বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বমোট যুদ্ধবন্দির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৭০ জনে। একইসঙ্গে চট্টগ্রামে আটক রয়েছে ৮ হাজার সৈন্য। তাছাড়া প্রায় ২০ হাজারের মতো পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আধা সামরিক সৈন্য রয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী ১ মাসের মধ্যে তাদের ভারতে নিতে পারবো।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধরকে বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের এক মুখপাত্র বলছেন, ‘ডিপি ধর অস্থায়ীভাবে যে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তা রাষ্ট্রদূতের সমমর্যাদাসম্পন্ন নয়, তার নতুন পদের নাম দেয়া হয়েছে স্পেশাল এনভয়।’

দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ফোরাম অব সাউথ আয়োজিত এক সভায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পাকিস্তানের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জনাব ভুট্টো বাংলাদেশে বাস্তবতা ও অস্তিত্ব স্বীকার করবেন। বাংলাদেশকে মুছে ফেলা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে সৃষ্টিকর্তা যেন ভুট্টোকে সুবুদ্ধি দান করেন। ভুট্টোর প্রথম কাজ হবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া।’ বাংলাদেশজুড়ে তখন একই মাতম- শেখ মুজিব কবে দেশে ফিরবেন!

শেয়ার করুন