২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:৫৭:২৫ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশকে নিয়ে চতুর্মুখী লড়াই
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১২-২০২২
বাংলাদেশকে নিয়ে চতুর্মুখী লড়াই


পিটার হাসের ১৪ ডিসেম্বর শাহীনবাগের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড়। যেমনটা এটাকে সহজ কিছু মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি বারবার মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে নানান কথা বলছেন দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের কেউ কেউ। যেটুকু ঘটেছে সেটাকে সহজেই সমাধান দেয়া যেত। কিন্তু বিষয়টি ইস্যু করে কথার ফিরিস্তি দীর্ঘ হয়ে গেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের এক নম্বর মোড়ল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ছোটখাট একটা বিষয়ে যেটা সহজে সমাধানযোগ্য সেটা এতোদূর বাড়তে দেয়া উচিত কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের অন্যতম। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পশ্চিমা তথা, বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন সহযোগী দেশের সঙ্গে অলিখিত এক জোটবদ্ধ দলের নেতৃত্বেই মনে করা হয় দেশটিকে। সরকার তাদের প্রত্যাশিত বিষয়গুলো নিয়েও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও। 

সেখানে ছোটখাট ইস্যুতে যেটা কূটনৈতিক ধারায় মেটানো যেত, সেটা না করে যেভাবে বিষয়টা বড় হয়ে উঠলো এটা কী বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক। বাংলাদেশ এখনো ওই পর্যায় গেছে কি, যে দাতা দেশ বা উন্নয়নশীল দেশের সহায়তা ছাড়াই চলার যোগ্যতা রাখে। 

এটা বাস্তবতা যে, বাংলাদেশ যেহেতু একটা ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে, অনেকের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজনও আছে। সেখানে অনেকেই বাড়তি কিছু করতে চাইলেও সেটা হজম করে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সেখানে অহেতুক কথার অস্ত্রমালা দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার কোনো অর্থ হয় কিনা সেটাই বলছেন কেউ কেউ। 

শাহীনবাগে মায়ের কান্না কেন এলো?

জানা গেছে, দীর্ঘদিন আগে নিখোঁজ সাজেদুল নামের এক বিএনপির নেতার খোঁজ করে চলছে তার পরিবার। বিষয়টি তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতাও কামনা করেছিলেন। সে সূত্র ধরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শাহীনবাগে চলে গিয়েছিলেন নিখোঁজ ব্যক্তির বাসায় সহমর্মিতা দেখাতে। কিন্তু সেখানে বলা নেই কওয়া নেই ‘মায়ের কান্না’ নামক নতুন আরেকটি সংগঠন যাদের দাবি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক আদালতে শাস্তি পাওয়া ও ফাঁসি হওয়া পরিবারের সদস্য। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর যেসব সদস্যের ফাঁসি, কারাদ- ও চাকরি গিয়েছিল, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’।

যারা কিছুদিন পূর্বে সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে সমাহিত সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর অপসারণেরও দাবি করে আসছেন। 

একটা গণতান্ত্রিক দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগঠন ও তাদের কার্যকলাপ করার অধিকার রাখে। কিন্তু আরেকটি সংগঠনের ডাকে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে সেখানে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়ে স্মারকলিপি দিতে যাওয়াটা কতটা নিয়মের মধ্যে পড়ে বা ভদ্রতার আওতায় আসে। স্মারকলিপি দিতে হলে সেটা ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যোগাযোগ করে তাদের সেখানেই মানবন্ধন বা স্মারকলিপি দিতে পারে। কিন্তু একজনের বাড়িতে যাওয়া একজন ‘মেহমান’কে পাশের বাড়ির কেউ যেয়ে বিব্রত করার কালচার বাংলাদেশে নেই। তারপরও সেটা যদি ‘মেহমান’ পজিটিভভাবে নিত সেটা হলেও হতো। কিন্তু তিনি (পিটার হাস) তো অনেকটা ভয়ে তটস্থ হয়ে বের হয়ে গেছেন। 

জানা গেছে, ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের নেতা কর্মীদের অবস্থান দেখে নিরাপত্তাকর্মীদের পরামর্শে সাজেদুলের বাসার কর্মসূচি সংক্ষেপ করে বেরিয়ে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ সময় মায়ের কান্নার লোকজন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ওই ঘটনার পরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তার গাড়ি ঘিরে ধরার সময়ে তার গাড়িতে আঁচর লাগতে পারে বলে ধারণা করেন। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে। একইসঙ্গে মানবাধিকার প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান ও দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন। 

একজনের সাহায্য প্রত্যাশা করতে যেয়ে তার ওপর প্রেসার তৈরি করাটা কতটুকু সমীচীন। পিটার হাস সেখান থেকে নিরাপত্তার অজুহাতে দ্রুত প্রোগ্রাম শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন। এবং সরাসরি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যেয়ে দেখা করে তার নিরাপত্তার বিষয়ে তুলেছেন সেটা মোটেও ভালো কিছু নয়। 

প্রশ্ন হলো ‘মায়ের কান্না’ আসলে কারা? কেন তারা এমন কার্যক্রম। যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়ার মতো এক জঘন্য কাজ করে বসলো। কারণ এটা তো সত্য যে বাংলাদেশের মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায় এবং খুব দ্রুতই ভুলে যায়। এটা আমাদের মজ্জাগত স্বভাব। কিন্তু মার্কিনিরা এটা তাদের দেশের প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবেই ধরে নিয়েছে, যা তাদের দেয়া বিভিন্ন উদ্বেগ জানানো বিবৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়টি তারা ভুলবে? বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন বিষয়ে তারা দ্বিপাক্ষিক অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেখানে তাদেরকে এভাবে বিব্রতকরন সমীচীন কি-না? এর আগেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা চালানো হয়েছিলো।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বশেষ যা বললেন 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার বলেছেন, রাষ্ট্রদূতকে রাস্তাঘাটে ধরে স্মারকলিপি দেয়ার কোনো সংস্কৃতি তো বাংলাদেশে নেই। ‘মায়ের কান্না’ নামের সংগঠন কেন মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ না করে ওখানে স্মারকলিপি দিতে গেল? এটা তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। এদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সরকার এমনটি করতে উৎসাহিত করছে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘না, আমরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে বিশ্বাস করি এবং তা উৎসাহিত করি। এভাবে স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টাকে আমরা উৎসাহিত করি না।’ 

পিটার হাস কেন প্রশাসনকে জানিয়ে যাননি!

শাহীনবাগের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতির আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘এটা ছোটখাটো ঘটনা, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত ও গভীর।’ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শাহীনবাগের যে বাড়িতে গিয়েছিলেন, সে বাড়ির দরজা পর্যন্ত মায়ের কান্নার লোকজনকে কেন যেতে দেয়া হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো জানতাম না উনি ওখানে গেছেন।’

তবে সাংবাদিকের আরেক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘না, হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব নিবিড়। আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনেক ভালো। যার কারণে তারা আমাদের অনেক কিছু বলতে পারে।’ 

উল্লেখ্য, এর আগেও (২০১৮ সনের ৪ আগস্ট) একবার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি বহরে হামলা হয়েছিল। সেটাতে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তারও আগে (২০০৪ সনে) যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের ওপর সিলেটে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। অনেকেই বলেছিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনভাবেই সরকারের বিরোধে জড়ানো উচিত হচ্ছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবারের ঘটনাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। এই ঘটনার খেসারত অবশ্যই বাংলাদেশকে দিতে হতে পারে। ইতিমধ্যেই স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে ডেকে পাঠিয়েছে এবং তাদের উদ্বোগের কথা জানিয়েছে। এর আগের কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এতো দ্রুত নিতে দেখা যায়নি। এমনকি রাষ্ট্রদূতকেও ডেকে পাঠানো হয়নি। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের হাসের ঘটনায় কার লাভ, কার ক্ষতি। নিশ্চয় বাংলাদেশের নয়। মন্ত্রীদের কথায় বোঝা যাচ্ছে পিটার হাস শাহবাগে গিয়ে অপরাধ করেছেন। পিটার হাস যে শাহবাগে যাচ্ছেন সেটা কীভাবে মায়ের ডাক জানলো? অনেকই বলেছেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আর ২০২২ সালের বাংলাদেশ এক নয়। এ ছাড়াও ২০১৮ সাল এবং ২০২২ সালের বাংলাদেশের ওপর মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। বিশেষ করে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর। অনেকেই বলেছেন, পিটার হাসের ঘটনায় বাংলাদেশকে মূল্য দিতে হবে এবং বাংলাদেশের ওপর অসন্তুষ্ট মার্কির প্রশাসন। যে কারণে তাদের অ্যাকশন দ্রুত। এদিকে পিটার হাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিমুখী লড়াই শুরু হয়েগিয়েছে। ভারতের আর্শীবাদে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এটা সবাই জানে। পিটার হাসের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কঠিন অবস্থানে। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে রাশিয়া প্রমাণ করেছে তারা বাংলাদেশের পক্ষে।

শেয়ার করুন