২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০১:৩২:২৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


আমার দৃষ্টিতে নাটক ‘তীর্থযাত্রী’
সঞ্জীবন কুমার
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৪-২০২৩
আমার দৃষ্টিতে নাটক ‘তীর্থযাত্রী’ তীর্থযাত্রী নাটকের দৃশ্য


বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্র ও নক্ষত্রের প্রথম নাটক ‘তীর্থযাত্রী’ গত ১৮ মার্চ নিউইয়র্কের কুইন্স থিয়েটারে প্রদর্শন করা হলো। হুমায়ুন কবিরের ‘তীর্থযাত্রী তিন জন তার্কিক’ গ্রন্থ থেকে ‘তীর্থযাত্রী’ নাটকটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর মূল বিষয় ছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সেনাপতি ঘোষণা দিলেন, সবাইকে যে যার মতো চলে যায়। সেনাপতির কথায়, জীবন যুদ্ধে সবাই বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু তিন জনের ফেরা হয় না। কারণ এদের বাড়ি নেই। তাই এরা জ্ঞানের সন্ধানে পথে নামে। এবং এই পথেই শুরু হয় নাটকের নানা ঘাতপ্রতিঘাত। এই পথেই সেই তিন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে সরাইখানা, ডেরা, কবরস্থান, পাহাড়, উপত্যকায়সহ নানা জায়গায় নানান মানুষের দেখা হয়। কথা হয় আধ্যাত্মিক, রাহস্যিক ও সিম্বলিক তত্ত্বের বিষয় নিয়ে।

নাটকটি ছিল সংলাপনির্ভর। দর্শন ও দ্বন্দ্বে ঠাসা বিমূর্ত চিত্রশিল্পের মতো। এই ধ্রুপদী নাটকটি, দ্বান্দ্বিকতা, যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির সংলাপের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। প্রশ্ন, সৃষ্টি, জয়-পরাজয়, জ্ঞান, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শ্রেষ্ঠত্ব, ভাগ্য, যুদ্ধ, ভালোবাসা, অপরাধ ইত্যাদি শব্দ নিয়েই নাটকটির দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এসব নিয়েই সাধারণ ও মৌলিক প্রশ্ন এবং উত্তর খোঁজার দীর্ঘ উপাখ্যান। 

তীর্থযাত্রী নাটকে সবাইকে চলতে হয়েছে, যার যার আপন পথে। নাটকের ২৩ দৃশ্যপটের প্রায় সমস্তটাই পথের ধারে ঘটেছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘কালমৃগয়া’ ও ‘মায়ার খেলা’, সেখানে পথকেই দেখি। ‘রাজা ও রানী’, ‘প্রায়শ্চিত’ ও ‘বিসর্জন’ নাটকের চরিত্ররাও পথে পথেই ঘুরে বেড়ান। চলার অর্থই গতি, থেমে থাকা মানেই জড় ‘তীর্থযাত্রী’র সে কথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। 

৫৬টি চরিত্রকে একই সুতোয় গেঁথে নিতে দর্শকদের হিমসিম খেতে হয়েছে। নাটকে জাকির হোসেন রনির দুটি সংলাপ ছিল- ‘কথা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।’ এবং ‘আপনি অনেক জ্ঞানীলোক, কিন্ত আপনার কথা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয়।’ সাধারণ দর্শকদেরও একই অবস্থা হয়েছে। নাটকের ভাষা এবং বিষয় বুঝতে তাদের জন্যও কঠিন হয়েছে। ঘটনার বৈচিত্র্য বা বিবিধ চিত্তচমকপ্রদ ঘটনার প্রেক্ষাপট খুব একটা ছিল না। 

সংলাপ এবং নাটকীয়তা হচ্ছে নাটকের প্রাণ। আখ্যানভাগকে ভিত্তি করে কুশীলবদের চরিত্র ও সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকের নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হয়। এছাড়া এই নাটকে নাটকীয়তা ছিল না। তাই সব চরিত্রকেই সংলাপের ওপর খুব খুব যতœশীল হওয়া উচিত ছিল। এবং নাটকের মধ্য দিয়ে দশর্কদের কাছে যে বার্তা দেয়া জরুরি ছিল সেটিও খুব একটা সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে নাটকের বিষয়বস্তু সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছে। যতদিন মানুষ থাকবে, নাটকের এই আবেদন ঠিক ততদিনই থাকবে।

কিছু কিছু শব্দ/বাক্য/উচ্চারণ শ্রোতাদের কান অবধি ঠিকঠাক মতো পৌঁছায়নি। যার জন্য কবিগুরুর ‘তীক্ষè শাণিত তীরের মত মর্মে বাজিল স্বর’ চরণটি ব্যর্থ হয়েছে। এই কম শোনার দুষণে হঠাৎ করে দর্শক-শ্রোতাদের ঘোরের মধ্যে থাকতে হয়েছে।

কিছু কিছু কঠিন শব্দ ও দৃশ্যপট দর্শকদের কাছে একেবারে অপরিচিত ছিল। যার জন্য দর্শকদের কিছুটা বিভ্রান্তির ডুবোজলে হাবুডুবু খেতে হয়েছে। যেমন নাটকে ব্যবহৃত ‘দ্রোনাচার্য’ শব্দটি বুঝে নিতে হলে দর্শককে মহাভারত সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকতে হবে। আবার প্রাচীন রোমান সভ্যতার গ্ল্যাডিয়েটর সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, নাটকে ‘গ্ল্যাডিয়েট’ বিষয়ক প্লট তাদের সঙ্গে সফল যোগাযোগ স্থাপন করে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়েছে।

মিলায়তনে উপস্থিত কয়েকজন দর্শক জানান, নাটকটি খুব ‘হাই থটের’। আবার দুই একজন তাদের মন্তব্যে বললেন, অনেক কিছু বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। একজন নাট্যব্যক্তিত্ব বলেন, এটি আসলে ফিলোসফির নাটক, যার জন্য সাধারণ দর্শকের জন্য অনুধাবন করা সহজ ছিল না। আর নাট্যপ্রিয় বোদ্ধারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে নাটকটি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন। তৌকিরের মতো একজন পোড় খাওয়া, অভিজ্ঞাতা সমৃদ্ধ নাট্যব্যক্তিত্ব এই নাটকটি নিদের্শনা দিয়েছেন। সে জন্যই  তীর্থযাত্রীর মতো উচ্চ মার্গের নাটক দর্শকরা পাতে নিতে পেরেছে। 

অভিনয়ে কামাল হোসেন, মিল্টন আহমেদ ও আহমেদ নাসিম যথেষ্ট দক্ষতা ও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। জাকির হোসেন রনি মঞ্চ ও দর্শকের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, যদিও  প্রথম দিকে কিছুটা আড়ষ্ঠতা ছিল। তবে তার উচ্চারণ ছিল ভরাট ও সাবলীল। মঞ্চে বাচিক শিল্পী শুক্লা রায়ের সংলাপে প্রচ্ছন্নভাবে কবিতা আবৃত্তির ঢং এসে গেছে। মার্জিয়া স্মৃতির উচ্চারণ পিছনে বসা দর্শকদের শুনতে বেশ কিছুটা অসুবিধা হয়েছে। প্রতিমা সুমির অভিনয় ছিল সাদামাটা। বাদ বাকিরা ভালোই করেছেন। 

উত্তরীয় অন্যের গলায় পরিয়ে দিয়ে তীর্থযাত্রীর চরিত্র বদল করা কৌশল অনেক দর্শক ধরতে পারেননি। মাঝে মাঝে স্পট লাইট ঠিক স্থানে পড়ছিল না অথবা স্পট লাইটের নিচে অভিনেতারা যুঁৎসইভাবে যেতে পারছিল না। কোরাস গান কিছুটা দুর্বল ছিল।

গ্রন্থ থেকে নাট্যরূপ দেয়া খুব কঠিন কাজ। বলতে গেলে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো। সম্ভবত তৌকীর আহমেদ জেনে-বুঝে প্রচ- ঝুঁকি ও সাহস নিয়েই গ্রস্থকে নাট্যরূপ দিয়েছেন, সঙ্গে নিয়েছন গ্রস্থের লেখক হুমায়ুন কবিরকে।

একটি বিষয়ে আয়োজকরা অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। সেটি হলে, এই প্রথম কোনো নাটকের অনুষ্ঠানে নতুন নতুন দর্শকের উপস্থিতি দেখা গেল। তার অর্থ  হলো, তীর্থযাত্রীর মধ্য দিয়ে নতুন দর্শক সৃষ্টির নতুন যাত্রা শুরু হলো। যদিও তৌকীর বলেছেন, এটি ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ নাটক। সেদিক থেকে পরীক্ষায় বেশ সফল হয়েছেন তিনি। মিলনায়তন পরিপূর্ণ ছিল। মঞ্চ সজ্জা, পোশাক নির্বাচনকে বাহবা দিতে হয়। 

নির্ধারিত সময়ে চেয়ে, অনেক দেরিতে নাটক শুরু হলো। তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াত, জাকির হোসেন রনি, বাশিরুল হক ও আবু হোসাইন বকুলের মতো দক্ষ সংগঠক থাকায় ধরে নিয়েছিলাম, নাটকটি  ঠিক সময়ে শুরু হবে। কিন্তু বাঙালির দেরি করার যে ঐতিহ্য, সেই সংস্কৃতি এখানেও  জারি থাকলো। দুঃখ থেকে গেল।

নাটকের কলাকুশলী

নাট্যরূপ : হুমায়ুন কবির ও তৌকীর আহমেদ।

নিদের্শনায়: তৌকীর আহমেদ। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামাল হোসেন, জাকির হোসেন রনি, আহমেদ নাসিম, শুক্লা রায়, মিল্টন আহমেদ, লায়লা ফারজানা, হীরা চৌধুরী, মমিনুল বসুনিয়া, প্রতীমা সুমি, মিলাদুন নাহার এ্যানি, শরীফ হোসেন, হৃদয় খন্দকার অনির্বাণ ও মার্জিয়া স্মৃতি।

সংগীতা আয়োজন: পিন্টু ঘোষ ও বিপাশা হায়াত, হারমোনিয়াম: সাত্তার মাহমুদ, ঢোল: চামেলী গোমেজ, গিটার: আল-আমিন বাবু, মন্দিরা : শহীদ হাসান, প্রপস ও সেট নির্মাণ: আইনুল ইসলাম অপু ও হৃদয় খন্দকার অনির্বাণ, পোশাক পরিকল্পনা: মার্জিয়া স্মৃতি, আলোক পরিকল্পনা: শামীম মামুন লিটন ও জিয়াউল হক, ব্যবস্থাপনা: রহমতউল্লা তুহিন, প্রধান সমন্বয়কারী: জাকির হোসেন রনি, প্রযোজনা অধিকর্তা ছিলেন বাশিরুল হক ও আবু হোসাইন বকুল। 

বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্র ও নক্ষত্রের ‘তীর্থযাত্রী’ নাটকটি প্রথম। তাদের লক্ষ্য ও যাত্রা পথ আরো দীর্ঘ। এভাবে নাটক করতে করতেই একদিন তারা ঠিকই পৌঁছে যাবে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নঘোরের উৎসভূমে। চড়ুই বেতী।

শেয়ার করুন