২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৬:১৭:৪০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


প্রসঙ্গ গ্যাস বিক্রি ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৬-২০২৩
প্রসঙ্গ গ্যাস বিক্রি ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ


চলমান অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে বা বাংলাদেশ নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। দেশটির তিন টার্মে সরকার পরিচালনাকারী প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সম্প্রতি কিছু কথা বলেছেন, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। কিছুদিন আগে তিনি জাতীয় সংসদে প্রকাশ্যে বলেছেন একটি প্রভাবশালী দেশ তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। একটি দেশ বাংলাদেশের নির্বাচনকে উপলক্ষ করে তাদের ভিসানীতিতে পরিবর্তন ঘোষণা করলে তিনি বলেন, কষ্ট করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ৩০ ঘণ্টা কঠিন সফর না করে অন্য মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অন্য মহাদেশেও যেতে পারবে বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেছেন, কোনো দেশ আমাদের নিষেধাজ্ঞা দিলে আমি বলে দিয়েছি সেই দেশ থেকে যেন কিছু কেনা না হয়।’ সম্প্রতি বিদেশ সফর করে ফিরে এসে তিনি জানালেন, ‘গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় থাকেনি তার দল, এখন সাগর দ্বীপ সেন্টমার্টিন ইজারা দিয়েও ক্ষমতায় থাকবে না তার দল।’

আমরা জানি, বদলে যাওয়া বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা কারণেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিলন মোহনা। ২ দশমিক ৭৫ দিক থেকে ভারত পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের একদিকে মায়ানমার, কিছু দূরেই চীন। ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে পরাশক্তিগুলোর চলছে উষ্ণ শীতল যুদ্ধ। বিকাশমান অর্থনীতির দেশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের পশ্চিমা শক্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন মহাযজ্ঞে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। আর তাই বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে প্রবল আগ্রহ। 

সবাই জানে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো আঁতুরঘরে। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছিল নানা কারণেই সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে সর্বজনীন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এযাবৎ অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচন শতকরা শতভাগ অবাধ, নিরপেক্ষ হয়েছে বলা যাবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিজিত দল সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপি বলে। ২০১৪ নির্বাচনে বিরোধীদল অংশগ্রহণ না করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকটা ওয়াক ওভার পেয়েছে শাসক দল। আর কীভাবে ২০১৮ নির্বাচন হয়েছে তা নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য আছে দেশ-বিদেশে। একসময়ে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সিদ্ধান্ত হলেও আদালত নির্দেশনা দেওয়ায় কনস্টিটিউশন সংশোধন করে এই ব্যবস্থা রহিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার বিদ্যমান অবস্থায় সরকার বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওদিকে নির্বাচন কমিশন আইনের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশন তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ শেষ বা ২০২৪ শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে কোনো নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রভাব মুক্ত, অবাধ, নিরপেক্ষ না হওয়ার যুক্তি তুলে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। সরকার কিন্তু শুরু থেকেই নানাভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নানাভাবে পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করছে। 

বাংলাদেশের জন্য ভারত প্রভাবশালী প্রতিবেশী, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়ক। স্থিতিশীল বাংলাদেশ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া যে কোনো দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ভারতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে ইদানীং বাস্তবতার বিবেচনায় পরিলক্ষিত যে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাদের বন্ধু দেশ জাপানের মাধ্যমে প্রভাব বলয় সৃষ্টিতে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। বসে নেই কিন্তু চীন ও রাশিয়া। তবে জনশ্রুতি আছে, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার কোয়াডে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত হতে বাংলাদেশের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ বৈষয়িক অর্থনৈতিক জোট ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা জোট (ব্রিকস) যোগদানের পথে এগিয়ে গেছে। 

এমনি যখন অবস্থা তখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন উপলক্ষ করে ভিসানীতি ঘোষণা করায় প্রাথমিকভাবে সরকারি দল এবং বিরোধীদল এটিকে নিজেদের মাইলেজ ভাবলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াগুলো এখন সুস্পষ্ট। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের প্রতি সরাসরি সমর্থন দিয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন। ভারত প্রকাশ্যে কিছু না বললেও কূটনৈতিক পর্যায়ে সক্রিয় আছে। 

এবার গ্যাস বিক্রি এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইজারা প্রসঙ্গ। আমরা জানি, ১৯৯৬-২০০১ সরকার গঠন করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। ভঙ্গুর অর্থনীতি, নড়বড়ে জ্বালানি-নিরাপত্তা অনেকটাই পুনর্গঠন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিলো। প্রতিবেদক নিজেও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল গ্যাস-বিদ্যুৎ উন্নয়ন যজ্ঞে। এই সময় দেশে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির অধীনে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। মার্কিন কোম্পানি ইউনোকোল বিবিয়ানায় একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর বড় তেল কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। মনে আছে ৯ নম্বর ব্লকসহ অন্য ক্লকগুলোর জন্য বিপুল সাড়া পড়েছিল। আমি নিজে পেট্রোবাংলার সমন্বয়কারী ছিলাম ইউনোকলের কাজে। তখন কিন্তু দেশব্যাপী গ্যাসসঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আমরা সবে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির তরফ থেকে জাতীয় গ্যাস গ্রিড নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছি। ইউনোকোল প্রস্তাব দিলো বিবিয়ানার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে দক্ষিণ বাংলা দিয়ে একটি অংশ ভারতে রপ্তানি করার। তখন পর্যন্ত কতটা গ্যাস আছে বিবিয়ানায় বা সারা দেশে বিস্তারিত হিসাবনিকাশ হয়নি। দেশজুড়ে প্রতিবাদ হলো। এই সময় বাংলাদেশে আসার সময় হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের। মনে আছে, সফর উপলক্ষে এই অঞ্চলের মার্কিন দূতাবাসগুলোর ব্যবস্থাপনায় নেপালের কাঠমান্ডুতে একটি শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের হয়ে গ্যাসসম্পদ বিষয়ে একমাত্র প্রেজেনটেশন করেছিলাম। স্বভাবতই বলেছিলাম নিজেদের প্রমাণিত গ্যাস সম্পদের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ এবং নিজেদের জন্য সংরক্ষণের আগে গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন হবে না। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বাংলাদেশে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌক্তিকভাবে বিবিয়ানার গ্যাস ভারতে রপ্তানির বিষয়ে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। স্বাভাবিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কথা মনে ধরেনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের। রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সরকারি দল থেকে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা বিরোধী দলে চলে যায়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সচিব পর্যায়ে ব্যাপক রদবদল করে। নির্বাচনে হেরে যায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি, জামাতের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে। তবে জনমতের প্রচ- চাপের কারণে ভারতে গ্যাস রপ্তানি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কথামতো বিএনপি গ্যাস রপ্তানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কি না নিশ্চিত নই। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমানকে বলতে শুনেছি মাটির নিচে গ্যাস না রেখে রপ্তানি করতে অসুবিধা কোথায়? যা হোক ইউনোকোল চলে যায় শেভরন আবির্ভূত হয়। ২০২৩ সালে সেই শেভরন জালালাবাদ, বিবিয়ানা মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করছে। ২০০০-২০২৩ সব সরকার গ্যাস অনুসন্ধান উন্নয়নে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আবার মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিল দরপত্র ছাড়াই এককভাবে গভীর সাগরে সব ব্লক ইজারা চাচ্ছে। 

আসুন, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন প্রসঙ্গে। দীর্ঘদিন থেকেই দ্বীপটির ওপর শ্যানদৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের। একসময় ভারত মহাসাগরে দিয়াগো গার্সিয়ায় নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা স্মরণে আছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে মার্কিন চাপের কথা বলেছেন। আমি মনে করি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কোনো অবস্থায় দেশের কোনো অংশ ভিন্ন দেশের কাছে ইজারা দিতে পারে না। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উচ্চারণ এবং অঙ্গীকারের প্রতি ১৭ কোটি বাংলাদেশির সমর্থন থাকা অত্যাবশ্যক। তবে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষ যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করে। কথায় এবং আচরণে সরকারি মন্ত্রী এবং নেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ী দেশ। শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করা চলবে না।

শেয়ার করুন