২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:৫১:৩৬ পূর্বাহ্ন


দেশকে হাসনাত কাইয়ুম
রাষ্ট্রের সংস্কার ছাড়া রক্ষার উপায় নেই
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৯-২০২৩
রাষ্ট্রের সংস্কার ছাড়া রক্ষার উপায় নেই হাসনাত কাইয়ুম


রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এবং গণতন্ত্র মঞ্চের পরিচালনা কমিটির সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, রাষ্ট্রের সংস্কার করা ছাড়া এদেশকে রক্ষা করার আর কোন উপায় নেই। আজকে এই রাষ্ট্রের অর্থনীতি, নির্বাচন, সংসদ, প্রশাসন, আইন-আদালত-বিচার, স্থানীয় সরকার, মৌলিক অধিকার তথা, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম যেসব সাংবিধানিক ভিত্তি বা বোঝাপড়া থাকে, যা কাজ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো বা সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি অনুযায়ী, তার সবই মর্মান্তিকভাবে জনগণের বিপক্ষে চলে গেছে। তাই এদেশকে ন্যূনতম বসবাসযোগ্য করতে হলেও রাষ্ট্রের এসব ক্ষেত্রগুলোকে সংস্কার করতেই হবে। 

আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ। 

হাসনাত কাইয়ুম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ এবং ১ম সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন। ছাত্রজীবন শেষে কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন। কৃষক আন্দোলনের এক পর্যায়ে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে জেলেদের নিয়ে ‘জেলে ফেডারেশন’ গঠন এবং ইজারবিরোধী অন্দোলন গড়ে তোলা। বহুবার কারা বরণ। রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় এবং পরবর্তীতে পানি ও পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত হওয়া। ‘হাওর অঞ্চলবাসী’ গঠন এবং ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন বাস্তবায়ন আন্দোলন’-এর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন। পাশাপাশি ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ এবং পরবর্তীতে ‘রাষ্ট্র সরকার আন্দোলন’ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ।  বর্তমানে রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এবং গণতন্ত্র মঞ্চের পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত।

দেশ: কেনো রাষ্ট্রসংস্কার বা মেরামতের কথা বলছেন?

হাসনাত কাইয়ুম: কারণ রাষ্ট্রের সংস্কার ছাড়া এদেশকে রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। আজকে এই রাষ্ট্রের অর্থনীতি, নির্বাচন, সংসদ, প্রশাসন, আইন-আদালত-বিচার, স্থানীয় সরকার, মৌলিক অধিকার তথা, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম যেসব সাংবিধানিক ভিত্তি বা বোঝাপড়া থাকে, যা কাজ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো বা সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি অনুযায়ী, তার সবই মর্মান্তিকভাবে জনগণের বিপক্ষে চলে গেছে। তাই এদেশকে ন্যূনতম বসবাস যোগ্য করতে হলেও রাষ্ট্রের এসব ক্ষেত্রগুলোকে সংস্কার করতেই হবে। 

দেশ: মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রণীত হয়েছে একটি সংবিধান। সেই সংবিধান সংস্কার বা পরিবর্তন করতে চান কেন? কি কি পরিবর্তন চান?

হাসনাত কাইয়ুম: দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে সংবিধানকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে দেখতে হবে। সংবিধানের প্রথম ভাগে আছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র কেমন হবে তার রূপরেখা। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত এসব আকাঙ্ক্ষার কথা লেখা আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ আর তৃতীয় অধ্যায়ে আছে নাগরিকের ‘মৌলিক অধিকার’-এর বিবরণ। আর সংবিধানের ৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত আছে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের ক্ষমতা কাঠামোর বিবরণ। অর্থাৎ সংবিধানের প্রথম অংশে যেসব আকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি দেওয়া আছে, সেসব আকাঙ্ক্ষা কারা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তাদের কার কাছে কি ক্ষমতা থাকবে, সেসব বিষয় এই নির্বাহী অংশে বলা আছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এই ক্ষমতা কাঠামো অংশ সংগতিপূর্ণ নয়, বরং বিপরীতমুখী, পরস্পর পরস্পরের পরিপন্থী। আমরা আমাদের সংবিধানের আকাঙ্ক্ষা বা মূলনীতি পরিপন্থী যেসব ক্ষমতা নির্বাহী অংশে দেওয়া আছে, সেই অংশের, সেই ক্ষমতা কাঠামোকে সংস্কার করে, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী করতে চাই।

দেশ: কোনো এমন পরিবর্তনে প্রয়োজন মনে করেন?

হাসনাত কাইয়ুম: এমন পরিবর্তন ছাড়া তো চিন্তার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, এমনকি ভোটের অধিকারও এদেশের জনগণ ভোগ করতে পারে না, আর পারবে না। তারা স্রেফ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর জীবনযাপন করতে বাধ্য হবেন। আপনি যদি এদেশে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন করতে দেন, তাহলে কোনোদিনই সরকারি দল পরাজিত হবে না। আপনি যদি ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার না করেন, তবে প্রধানমন্ত্রী যেমন চাইবে সংসদ তেমন আইনই বানাতে বাধ্য হবে আর আইনি পথেই তার পছন্দের লোকজন দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যাবে। তার মর্জি এবং ফরমায়েশ মাফিক বিচার বিভাগ খুনিকে মুক্তি দিয়ে নির্দোষকে সাজা দিতে বাধ্য হবে। যে কোনো অন্যায়ই আইনি পথে, আইন-কানুনের দায়িত্ব পালনকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেই সম্পন্ন করা যাবে। আপনি যদি এই ধারা বহাল রাখলে উপকৃত হন, তাহলে পরিবর্তন আপনার প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাকিদের জন্য পরিবর্তন লাগবেই।

দেশ: বলা হয়, আপনারা একটি অসৎ উদ্দেশ্যে সংবিধান সংস্কারের দাবি তুলছেন..

হাসনাত কাইয়ুম:  কোনটা  সৎ উদ্দেশ্য আর কোনোটা অসৎ উদ্দেশ্য, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যখন সরকার এবং সরকারের দালালদের হাতে চলে যায়, তখন এমন আলাপ করা সম্ভব। গত ৫২ বছরের অভিজ্ঞতা বারবার প্রমাণ করেছে, সংবিধানের জবাবদিহি বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো এমনকি শাসকদের জন্যও দীর্ঘমেয়াদে কোনো ইতিবাচক ফল এনে দেয়নি। এদেশের জনগণের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। নিজেদের জীবন এবং মর্যাদা দিয়ে এরা মাফিয়াদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। আজ যারা আমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলে, দুই দিন পর থেকে তারাই এসব সংস্কারের জন্য জোরেশোরে কান্নাকাটি করবে।

দেশ: আপনারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছেন। বিএনপি কি আপনার এ ধরনের উদ্যোগের কথা জানেন? তারা কি ক্ষমতায় গিয়ে এ বিষয়টি গুরুত্ব দেবে?

হাসনাত কাইয়ুম: অবশ্যই জানে। আমরা দীর্ঘসময় নিয়ে আমাদের এসব দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা করেছি, ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এবং দুই বার ড্রাফট পরিবর্তন করে পরবর্তীতে ৩১ দফা এবং এক দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে একমত হয়ে বর্তমানে আন্দোলন করে যাচ্ছি। ক্ষমতায় গিয়ে তারা এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেবে কি না সেটা তো আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো না। তবে দেশের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন আর কেবল একদলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন করতে রাজি নয়। তারা তা করছেও না। জনগণ একটা মৌলিক পরিবর্তনের জন্য আগের যে কোনো সময়ের চাইতে এখন অনেক বেশি আগ্রহী। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানি করে আগের মতো আর পার পাওয়া সহজ হবে না। আর আমরা তো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, যে কোনো ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুত আছি। আগে এমন শক্তি মাঠে ছিল না।

দেশ: নাকি কথার কথায় আপনাদের এখন সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি? কারণ বিএনপি যে ধরনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী তারা কি আপনাদের দাবিকে গুরুত্ব দেবে?

হাসনাত কাইয়ুম: এটার আর দরকার নেই।

দেশ: বলা হয়ে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের স্বার্থরক্ষায় আপনারা রাষ্ট্র মেরামত বা সংবিধান সংস্কারের আওয়াজ তুলছেন?

হাসনাত কাইয়ুম: স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী তো তারা, যারা একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি দেশকে স্বাধীন করার পর, সেই দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে যেসব আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে তা বাস্তবায়ন না করে দেশেকে পাকিস্তানি আইনকানুন দিয়ে পরিচালনা করেছে। যারা এখনো সেসব পাকিস্তানি আইনকানুন আর ক্ষমতা কাঠামো, সরকার পরিচালনার নিয়মনীতি বহাল রাখতে চায়।

দেশ: বিএনপি তো জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে অতীতে ছিল। অনেকে বলে এখনো দলটির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ আছে। এমন দলের সঙ্গে রাষ্ট্র বা সংবিধান সংস্কারের কতটা আশাবাদী?

হাসনাত কাইয়ুম: অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে জামায়াতের সঙ্গে সখ্য রেখেছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জামায়াত প্রশ্নে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা কখনো জামায়াত প্রশ্নে কোনোরকম দোদুল্যমানতা দেখাইনি। বিএনপি এখনো গোপনে যোগাযোগ রাখে কি না সেটা আমার জানা নেই। না জেনে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে প্রকাশ্য কোনো যোগাযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

রাষ্ট্র বা সংবিধান সংস্কারের দাবির সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতির সংযোগকে শর্তযুক্ত করে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা মনে করি, বিদ্যমান রাষ্ট্র এবং সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো যে দেশ, দেশের মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভব্যতা, নীতি-আদর্শ পরিপন্থী এবং পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলেও এই রাষ্ট্রের সংস্কার ছাড়া যে আর কোনো বিকল্প নেই, এটা দেশের মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। মানুষের এই আগ্রহকে বিভ্রান্ত করার জন্য কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে এসব উদ্ভট প্রশ্ন তুলতে পারে, কিন্তু আমরা আশাবাদী এবার আর জনগণকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব হবে না।

শেয়ার করুন