২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:৩১:২০ পূর্বাহ্ন


ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির চ্যালেঞ্জে আ.লীগ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১২-২০২৩
ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির চ্যালেঞ্জে আ.লীগ বক্তব্য রাখছেন মেহের আফরোজ চুমকি/ছবি সংগৃহীত


‘ঠিক আছে আপনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেবেন না। আপনি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন না-সমস্যা নেই। আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যিনি তাকেই ভোট দেন। তবু কেন্দ্রে আসুন। ভোট দিন।’ 

আওয়ামী লীগের ভোট ক্যাম্পেইনে এ বক্তব্যটাই মূলমন্ত্র। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলসমূহ নির্বাচনে নেই। এভাবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হয়ে আরেকবার সংসদে যেতে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপরিচালনা করতে কোনো সমস্যা নেই। চ্যালেঞ্জও নেই। যে নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে আছে, শুধু ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পার হলেই বিজয় উৎসবে গোটা দেশ রাঙাতে পারবে ক্ষমতাসীনরা। কোনো সন্দেহ নেই। সমস্যা যেটুকু, তাহলো বিদেশি বন্ধুদের একটা যুঁতসই বুঝ। ওটা দিতে পারলেই হলো। কিন্তু সেটা দেওয়া সম্ভবপর করার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এখন নির্বাচন কমিশন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। 

যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচনটা হচ্ছে এতে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরামর্শ ও প্রত্যাশা সেটা উপেক্ষিত। তবে আওয়ামী লীগ ওই প্রত্যাশা ও পরামর্শ উতরে যেতে চায় ভোটের মাঠে ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতি প্রমাণ দিয়ে। এ জন্যই এখন নানা কৌশল। যদি ২০১৪ বা ২০১৮ সনের জাতীয় নির্বাচনের বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে এবারও আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনাদের পার হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই।

তবে কে কী ভাবলো বা কে কি করলো ওটা নিয়ে চিন্তিত নয় প্রশাসন ও সরকার। ইতিমধ্যে নির্বাচন আলোচিত-সমালোচিত করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটা বেশ জোরেশোরে চলছে। যেমনটা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বী। দুটিই আওয়ামী লীগ। কিছু সিটে জাতীয় পার্টিও আছে। রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই নৌকা প্রতীক গ্রহণ করেছেন। জাতীয় পার্টি নৌকা না নিয়ে রয়েছেন লাঙ্গলে। আর সেই লাঙ্গলের পোস্টারে খোদ মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পোস্টারেই শোভা পাচ্ছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ সমার্থিত। ফলে রেজাল্ট আর কী হবে সেটা নিয়ে নীতিনির্ধারকসহ প্রার্থীরাও নির্ভার। পূর্বের মতো ভোটের দিন পার হওয়া মানেই পাশ।

তাহলে চ্যালেঞ্জ যেটা তা হলো কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি। এটাতে দুর্ভাবনাও আছে। মূলত ভোটের মাঠ গরম করতেই নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র। এটাতে যে লাভ, তাহলো, অনেক প্রার্থী ও নৌকাকেও বিভিন্নভাবে অপছন্দ করেন অনেকেই। এরা যে স্বতন্ত্রতে ভোট দিলেন। দিন শেষে ভোটকেন্দ্রেই গেলেন তারা। আর এরই মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহল দেখলো বিএনপিসহ বিরোধীদলের বড় একটা অংশ ভোটের মাঠে নেই, তার কোনো প্রভাব নেই, মানুষ ভোট দিচ্ছে। ভোট গ্রহণ করেছেন। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে এখন তৃণমূলেও আলোচনা। সাধারণ মানুষের বড় একটা অংশ বলছে সবই তো তারা তারা। সবাই তো আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ। এখানে গেলেই কী না গেলেই বা কী। এ চ্যালেঞ্জটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। বা এটা কৌশলও বটে। 

উঠোন বৈঠক

বড় কোনো সমাবেশ পরিহার করে উঠোন বৈঠক। এটা এখন আওয়ামী লীগের নিয়মিতই হচ্ছে। প্রার্থীরা বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান এবং কোনো ছোট্ট একটা পরিসরে চেয়ার-টেবিল পেতে উপস্থিত মানুষজনকে নিজের দলের বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা যে শুধু আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক প্রাপ্তরাই করছেন তা নয়। স্বতন্ত্র যিনি আওয়ামী লীগেরই, তিনিও করছেন ওই উঠোন বৈঠক। এতে যেটা লাভ, তাহলো একই সঙ্গে অনেকগুলো প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারেন প্রার্থী। চষে বেড়ানো যায় গোটা নির্বাচনী এলাকা। মানুষও প্রার্থীকে কাছে পেয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা বলতে পারছেন, দাবি তুলতে পারছেন। আক্ষেপ জানাতে পারছেন। প্রার্থীরাও রাজনৈতিক নিয়মে সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন। 

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট ভিক্ষা

প্রার্থীরাই শুধু নন। ভোট চান দলীয় নেতাকর্মীরাও। প্রতিটা বাসায়, বাড়িতে গিয়ে গিয়ে ভোট চাইছেন। হ্যান্ডবিল, পোস্টার দিচ্ছেন। বিজয়ী হলে কী কী করবেন, দিচ্ছেন সেসব প্রতিশ্রুতি। মোটকথা, ভোট চাইছেন নরম সুরে। বলছেন পেছনের ভুলত্রুটির কথা। এলাকার দাবি-দাওয়া শুনছেন। এটাতে তারা এতোটাই নমনীয় যেটা অনেকেই ভোট ভিক্ষার সঙ্গে তুলনা করছেন। অবশ্য এটার যে কারণ তাহলো দেশের বিরাজমান অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সবকিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া নিয়ে যে ক্ষোভ আপামর মানুষের। সেটার জন্য। মানুষকে বোঝানোও হচ্ছে দেশের উন্নয়নের কথা। সব মিলিয়ে ওই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা। তবে এ চিত্র সব এলাকাতে সেটাও না। কারণ অনেক স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও সেটা থ্রেট নয়। ফলে সেখানে মূল প্রার্থী নির্ভার। তারা অবশ্য নিশ্চিন্তেও। আর ভোটারদের কেন্দ্রে আনয়নের সেটা হয়তো ভোটের আগে একটা প্ল্যান করে ব্যবস্থা নেবেন ওই সবরা। 

তাবলিগ জামায়াতের মত দাওয়াত দেওয়া

অনেক প্রার্থী ও দলের নেতৃবৃন্দ এবারের ভোটটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা উপলব্ধিতে সক্ষম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ছাড়াও মিডিয়ার অ্যালার্ট। ফলে কেন্দ্রে যাওয়ার আবেদনের পাশাপাশি প্রয়োজনে তাবলিগ জামায়াত যেভাবে বাড়ি বাড়ি, রাস্তায়, হাটবাজার, পাড়া-মহল্লাতে মানুষকে দাওয়াত দেন দ্বীনের পথে। ঠিক সেভাবেই ভোটের দিন কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাবেন বলে জানিয়েছেন। 

নতুন টেকনিক 

ইতিপূর্বে দেখা গেছে বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় খোদ আওয়ামী লীগের ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যান না। ভোট দেন না। তাদের বক্তব্য গিয়ে লাভ কী, প্রতিপক্ষ নেই-এমনিতেই তো পাস হয়ে যাবে। কিন্তু এবার সেটা আর চলবে না। নানাভাবে অন্তত আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থিত ও দোদুল্যমান যারা, তাদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার প্ল্যানের কথা শোনা যায়। এর মধ্যে রয়েছে, প্রতিটা কেন্দ্রে দুইশো বা ততোধিক আওয়ামী লীগ বা তাদের সমার্থিত লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন। এরা তো ভোটের দিন উপস্থিত থাকবেন এর সঙ্গে এদের পরিবারবর্গকেও ভোটের কেন্দ্রে উপস্থিত রাখতে হবে। এতে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বেশ মন্দ হবে না। এর সঙ্গে আরো কোনো প্রক্রিয়া যুক্ত করা যায় কি না-সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। সেজন্য কেন্দ্রে যাতায়াতের ব্যবস্থা, নানা এন্টারটেনমেন্ট। 

এর বাইরে কেউ কেউ ক্ষোভের কারণে কিছুটা হুমকি-ধমকির কথাও শোনাচ্ছেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেমনটা রেশন কার্ডসহ যে সুবিধাদি তৃণমূল নিম্নশ্রেণির মানুষ পেয়ে আসছে। বিভিন্ন ভাতা প্রাপ্ত। ভিজিএফ কার্ডহোল্ডার নানারকম লোকজন যারা গত ১৫ বছর সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে জীবনযাপন করছে তারা। ভোট দিতে না গেলে সে সুবিধাদি বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। তবে সবাই এমনটা বলছেন না। বিচ্ছিন্নভাবে দু-চারজন। 

নিরাপত্তা জোরদার 

নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২৯ ডিসেম্বর থেকেই মাঠে সেনা টহল থাকবে। এছাড়াও পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখার লোকজনও নিরাপত্তার দায়িত্বটা সুচারুভাবে পালন করবে। যাতে ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। 

সর্বশেষ

৭ জানুয়ারি ভোটের দিনকে কেন্দ্র ছুটির উৎসবে এখন বাংলাদেশ। ওইদিন রোববার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগের দুইদিন শুক্রবার ও শনিবারও ছুটি। এতে করে বৃহস্পতিবার থেকেই মানুষ ছুটতে শুরু করবে গ্রামের বাড়িতে। রাজধানী তথা মহানগরীর বাইরে গ্রামগঞ্জ এমন ছুটিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনমুখী। হয়তো বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না যাওয়ায় অনেকেই কেন্দ্রে হয়তো যাবেন না। কিন্তু প্রিয়জনদের কাছে থেকে নির্বাচনের উত্তাপটা তারা ঠিকই অনুভব করার চেষ্টা করবেন চিরাচরিতভাবেই।

শেয়ার করুন