২০২৪ সালে ডারিয়েন গ্যাপ দিয়ে অনিয়মিত অভিবাসনের হার প্রায় ৪১ শতাংশ কমে গেছে বলে গত ৪ জানুয়ারি শনিবার পানামা সরকার এক রিপোর্টে জানিয়েছে। ডারিয়েন গ্যাপ দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে সংযোগকারী বিপজ্জনক জঙ্গল। এই বিপজ্জনক জঙ্গল অভিবাসীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার প্রধান পথ ছিল। ২০২৪ সালে পানামা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির আওতায় ডারিয়েন গ্যাপ হয়ে অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পানামার জন্য নির্বাসন ফ্লাইট এবং অন্যান্য লজিস্টিকের জন্য অর্থায়ন করেছে। ডারিয়েন গ্যাপকে এখন কঠোর নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আওতায় আনা হয়েছে। পানামার অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মতে, গত বছরের তুলনায় প্রায় দুই লাখ কম মানুষ এই বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়েছে। অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় বাইডেন প্রশাসনের একটি বড় সাফল্য হিসেবে এটিকে দেখা হচ্ছে।
মধ্য আমেরিকার দেশ পানামা গত বছরে ডারিয়েন গ্যাপ হয়ে অনিয়মিত অভিবাসনের হার প্রায় ৪১ শতাংশ কমিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই বিপজ্জনক জঙ্গলের পথ পাড়ি দেওয়া অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
পানামার কংগ্রেসে বক্তব্য দিতে গিয়ে পানামার বর্তমান প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেন, আমরা ডারিয়েন জঙ্গল দিয়ে অভিবাসনের প্রবাহ ৪১ শতাংশ হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা প্রতিদিন কাজ করছি যাতে অনিয়মিত অভিবাসন পানামা সিটি বা দেশের অন্য কোথাও পৌঁছাতে না পারে।
সম্প্রতি, অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা উত্তর দিকে বাড়তে থাকায় পানামার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে ২৪.৮ মিলিয়ন অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীর ‘এনকাউন্টার’ নথিভুক্ত করা হয়, যা একটি নতুন রেকর্ড। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অভিবাসন ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিতর্কে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর গণপ্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পানামার অভিবাসন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ২০ হাজার ৮৫ জন। কিন্তু ২০২৪ সালে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩ লাখ ২ হাজার ২০৩-এ। যুক্তরাষ্ট্রেও অনিয়মিত অভিবাসনের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ অর্থবছরে দক্ষিণ সীমান্তে ২.১৪ মিলিয়ন ‘এনকাউন্টার’ নথিভুক্ত করা হয়েছে, যা ১৪ শতাংশ হ্রাস হয়েছে বলে জানা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। সীমান্তের বাইরে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা এবং ফৌজদারি মামলা দায়েরের মতো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২৪ সালে ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়ার সময় অন্তত ৫৫ জন অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১৮০ জন শিশু পরিত্যক্ত হয়েছে।
ইমিগ্র্যান্ট রাইটস নেতৃবৃন্দরা বলছেন, অনিয়মিত অভিবাসন রোধের প্রচেষ্টা প্রায়ই সেই মূল কারণগুলোকে উপেক্ষা করে, যা মানুষকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের ৬৯ শতাংশই ভেনেজুয়েলার নাগরিক ছিলেন। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রায় ৭.৭ মিলিয়ন মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ডারিয়েন গ্যাপের এই অবস্থা অভিবাসন এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
আমেরিকায় আসার ঝুঁকিপূর্ণ পথে বাংলাদেশিরা
বাংলাদেশ থেকে উন্নত জীবনের সন্ধানে আমেরিকায় আসার স্বপ্নে দারিয়েন গ্যাপ হয়ে উঠেছে অনেক অভিবাসীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিপজ্জনক রুট। কলম্বিয়া এবং পানামার মধ্যবর্তী এই ঘন জঙ্গলটি বিপদসংকুল, যেখানে প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ এবং মানবিক সংকট অভিবাসীদের জন্য বড় বাধা তৈরি করে। বাংলাদেশি অভিবাসীরা সাধারণত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে, বিশেষ করে ব্রাজিল বা ইকুয়েডরে, ভিসা সহজলভ্য হওয়ায় ভ্রমণ শুরু করেন। সেখান থেকে কলম্বিয়া হয়ে ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তাদের এই যাত্রার পেছনে কিছু প্রধান কারণ: অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং নিম্ন আয়ের কারণে অনেকেই বিদেশে ভালো জীবনের আশায় পাড়ি দেন। উন্নত দেশগুলোতে বসবাসের স্বপ্ন অনেক বাংলাদেশিকে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে চালিত করে। পানামা সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন বাংলাদেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, নেপাল এবং আফগানিস্তানের অভিবাসীর সংখ্যা বাড়লেও বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ লক্ষ্যণীয়। পানামা সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১১৩২ জন বাংলাদেশি ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিয়েছেন। সরকারি হিসাবের বাহিরে অনেক বাংলাদেশি পানামা কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে এ জঙ্গল পাড়ি দিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। কত বাংলাদেশি পাড়ি দিতে মারা গেছেন তারও কোনো তালিকা পানামা সরকারের কাছে নেই। ২০২৪ সালে পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশিদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
ডারিয়েন গ্যাপের বিপজ্জনক পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য একটি জীবন-মরণ সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। উন্নত জীবনের আশায় তারা এই বিপদসংকুল রুট বেছে নিলেও বাস্তবতা প্রায়ই তাদের জন্য আরো চরম বিপদ এবং অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ, অপরাধী চক্রের আক্রমণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে অনেকে এই পথে প্রাণ হারান, যদিও তাদের সঠিক সংখ্যা জানা অসম্ভব। বাংলাদেশি অভিবাসীদের এই সংকট কেবল একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট। উন্নত জীবনের সন্ধানে তাদের এই বিপজ্জনক যাত্রা বন্ধ করতে সচেতনতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং নিরাপদ অভিবাসন নীতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। অন্যথায়, দারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দেওয়া অনেক বাংলাদেশির জন্য উন্নত জীবনের স্বপ্ন একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে।
নরক: এক মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র
ডারিয়েন গ্যাপকে অভিবাসীরা ‘নরক’ হিসেবে অভিহিত একটি জঙ্গল। এটি কলম্বিয়া এবং পানামার সীমান্তে অবস্থিত একটি ভয়ানক এলাকা। এই স্থানটি বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক এবং আইনশৃঙ্খলা শূন্য জায়গা, যেখানে মাদক পাচারকারীরা এবং সশস্ত্র ডাকাতরা অত্যাচার করে। চলাচলের জন্য কোনো সড়ক না থাকায়, এটি অভিবাসীদের জন্য এক কঠিন পথ, যেখানে শ্বাসরুদ্ধকর আর্দ্রতা, বন্য পরিবেশ এবং মরণফাঁদ নদীগুলোর ঝুঁকি তাদের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি, অতি সামান্য ভুলও এই অঞ্চলে প্রাণঘাতী হতে পারে।
এই ভয়ানক পরিবেশে, অভিবাসীরা শুধু নানান প্রাকৃতিক বিপদের সম্মুখীন হন না, বরং এখানে রয়েছে ভয়ঙ্কর পোকামাকড়, বিষাক্ত সাপ এবং অপরাধী চক্রের উপস্থিতি। জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ ও হাড়ের স্তুপ, যাদের মৃত্যুর কারণ এই অমানবিক যাত্রা, এরই মধ্যে ডারিয়েন গ্যাপের ভয়াবহতা প্রমাণ করে। বহু মানুষ তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, এবং তাদের পরবর্তী কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এত বিপজ্জনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, ডারিয়েন গ্যাপ উত্তর আমেরিকায় অভিবাসীদের জন্য একটি প্রধান যাত্রাপথ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এই বিপজ্জনক পথে আসছে, যার মধ্যে ভেনেজুয়েলা, হাইতি, কিউবা, আফ্রিকা, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যও অন্তর্ভুক্ত। ২০২১ সালে পানামা সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ এই পথটি পাড়ি দিয়েছে এবং ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসে এই পথটি অতিক্রম করা শিশুর সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অনেক শিশুই একা এসে এই জঙ্গলে হারিয়ে গেছে, যা একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়।
ডারিয়েন গ্যাপের নামকরণ করা হয়েছে প্যান-আমেরিকান হাইওয়ের হারিয়ে যাওয়া একটি লিঙ্ক থেকে, যা আলাস্কা থেকে টিয়াররা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত বিস্তৃত। মাত্র ৬০ মাইল দীর্ঘ হলেও এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হিসেবে পরিচিত। ১৯৭২ সালে, ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল প্রথমবারের মতো ডারিয়েন গ্যাপ পার হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তবে তাদের অভিযানে প্রায় অর্ধেক দলের সদস্য চিকিৎসা সমস্যার কারণে ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং ১১ জন কলম্বিয়ান সেনা নিহত হয়। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত, ডারিয়েন গ্যাপ মানবিক বিপর্যয়ের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডারিয়েন গ্যাপ শুধু একটি ভূগোলগত স্থান নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। এখানে অতিক্রান্ত জীবনসমূহ শুধু আকাশের দিকে নয়, বরং একটি সংগ্রামী সত্যকেও তুলে ধরে, সেখানে বেঁচে থাকা মানুষের চেষ্টাগুলো, যা তাদের জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে বাধ্য করে, সেই সংগ্রামকে অতিক্রম করতে গিয়ে তারা কতটা ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। ডারিয়েন গ্যাপ আজও সেই ভয়াবহতার সাক্ষী, যেখানে প্রতিটি পা যেন মানবিক দুঃখের গভীরতা স্পর্শ করছে।
ডারিয়েন গ্যাপ দিয়ে অনিয়মিত অভিবাসনের হার হ্রাস পাওয়া অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলেও, এটি কেবল সাময়িক সমাধান। ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা অভিবাসনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। তাই, এই সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অভিবাসন সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের একমাত্র পথ। ডারিয়েন গ্যাপের অভিজ্ঞতা বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় যে, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই প্রকৃত অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি।