১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৫:৩২:৬ পূর্বাহ্ন


রূপলাল হাউজ
পুরানো ঢাকায় কালের সাক্ষীগুলি এখন বর্জ্যের ভাগাড়
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৫
পুরানো ঢাকায় কালের সাক্ষীগুলি এখন বর্জ্যের ভাগাড় রূপলাল হাউজ


রূপলাল হাউজ। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরোনো বাড়ি। তবে ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ১৯ শতকের একটি প্রাসাদ বলা যায়, যা ইউরোপিয়ানদের পাগল করে দিতো। বুড়িগঙ্গার পানিতে ভরপুর থাকতো তখন নৌকায় চড়ে রূপলাল হাউজের পাশে দিয়ে চললে মনে হতো প্রাচ্যের ভেনিস। ঢাকার অভিজাত বাড়িগুলোর মধ্যে এটি একটি। গ্রিক ও ইংরেজ স্থাপত্যের সংমিশ্রণের নিদর্শন রয়েছে এই বাড়ির নির্মাণশৈলীতে।

ঢাকার আরেক অতি প্রাচীন বাড়ি নাম ‘মঙ্গলালয়’। মঙ্গলালয় পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে অবস্থিত। অপরূপ নির্মাণশৈলী। যারা দেখেছেন তারা জানেন, চোখ একদম আটকে যায়। ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের অমূল্য স্মারক এটি। 

পুরানো ঢাকায় কালের এমন অতিমূল্যবান সাক্ষীগুলি ছাড়াও আরো অনেক স্থাপনা এখন বর্জ্যরে ভাগাড়ই বলা চলে। এর চেয়েও কোনো খারাপ কিছু থাকলে তা-ও বলা যায়। এর পাশাপাশি আছে ভূমিদস্যুদের গ্রাস করার প্রতিযোগিতা। পুরান ঢাকা প্রত্যেকটি প্রাচীন স্থাপনার পরিবেশ এখন কতো নোংরা তা, সরজমিনের না গেলে বোঝা যায় না। এমন স্থাপনাগুলিকে যে অযন্তে রাখা হয়েছে শুধু তা-ই নয়, সরকারের পুরার্কীতি রক্ষকদের এসব রক্ষণাবেক্ষণে দেখানো হচ্ছে খামখেয়ালীপনা। রূপলাল হাউজ-মঙ্গলালয়সহ ঢাকার অনকেগুলো ঐতহ্যিবাহী পুরনো ভবন সংরক্ষণে বা দেখভালে নেই কারো তৎপরতা। আর এমন সুযোগে যে যেভাবে পারছে এসব স্থাপনায় দখল নেয়ার প্রতিযোগিতায়। কারো একচ্ছত্র আধিপত্যে এসন স্থাপনা ঘেষে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। আর অইসব ভবন থেকেই সব নোংরা আর্বজনা ফেলা হচ্ছে পুরানো ঢাকায় কালের এমন অতিমূল্যবান সাক্ষীগুলি লক্ষ্য করে। 

এমন চিত্র দেখা গেছে সেভ দ্য হেরিটেজেস অব বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘হেরিটেজ ট্যুর’ এ গিয়ে। পুরান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে ‘হেরিটেজ ট্যুরের আয়োজন করে সেভ দ্য হেরিটেজেস অব বাংলাদেশ। গত ৫ এপ্রিল শনিবার ঐতিহ্য সফর ১০০ : পুরান ঢাকা শীর্ষক এই ট্যুরে সরজমিনে দেখানো হয় লালকুঠি, শিব মন্দির,রুপলাল হাউজ, মঙ্গলালয়, বসন্ত বাবুর বাড়ি, বড় বাবুর বাড়ি, বিবি কা রওজা, বিহারী লাল জিউ মন্দির, সুত্রাপুর জমিদার বাড়ি, জলসা ঘর, মুড়াপাড়া জমিদারের ঢাকার বাড়ি, ঋষিকেশ বাবুর বাড়ি, কাজী বাড়ি হেরিটেজ এস্টেট। 

যা দেখা গেলো

প্রথমে আসা যাক রূপলাল হাউস নিয়ে। উনিশ শতকের প্রথমদিকে নির্মিত ঢাকার একটি মনোরম ও সুবৃহৎ অট্টালিকা। এটি বাকল্যান্ড বাঁধ ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরস্থ ভ্রমণের স্থানের দিক মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকার দুই বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। ঢাকার বণিক সমাজে বেশ নামডাক হয়েছিল দু’জনেরই। ১৮৩৫ সালের দিকে তারা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের সামাজিক মর্যাদার সাথে মানানসই একটা বাড়ি কেনা দরকার তাদের। আর অঢেল টাকার এই দু-ইজন বেছে নিলেন সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে বড় বাড়িগুলোর একটিকে। আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন ১৮২৫ সালের কাছাকাছি সময়ে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। যখন বাড়িটির বয়স ছিল ১০ বছর তখন রূপলাল কিনে নেন, নাম দেন ‘রূপলাল হাউজ’। এই বাড়ির পুননির্মাণের কাজ দেওয়া হয় কলকাতার বিখ্যাত ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মার্টিন এন্ড কোংয়ের কাছে। বিশাল নির্মাণযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় ভাবে পোড়ানো ইট আর প্রচুর লোহা। নির্মাণ কাজ চলেছিল দীর্ঘসময়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা শহরে নবাব পরিবারের পরই স্থান ছিল রূপলাল পরিবারের। নবাব আব্দুল গণির আহসান মঞ্জিলের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না তাদের এই বাড়িটি। শরৎচন্দ্র ওস্তাদ গোলাম আলীর মত বিখ্যাত লোকেদের পদচারণা ছিল এই বাড়িতে। আর এমন মুল্যবান প্রাচীন স্থাপনা পুরাকীর্তি কর্তৃপক্ষের দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ দুরে থাক গত শনিবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বর্তমানে বাড়িটির অবস্থা বেহাল। নিচতলা হলুদ, মরিচের আড়ত, ওপরের তলা সরকারি কর্মচারীদের নিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটির তিনপাশ টিন শেডের আড়ত দিয়ে ঘেরা। পুরো বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে অবৈধ দখলদাররা। বাড়িটির যত্রতত্র টয়লেট বানানো হয়েছে। রুমের ভেতর অনেক স্থান রুম ডাস্টবিন রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। লোহা লক্করের স্তুপ। খিলানের মধ্যে মানুষের মূর্তিগুলো সিমেন্ট বালুর প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। নিচতলার আড়তগুলোতে পুরনো কোনো স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাতের নাগালের মধ্যে আছে এমন সবকিছুর মধ্যেই ধ্বংসের ছোঁয়া পাওয়া গেছে। অখচ বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকায় থাকলেও সরকারি পর্যায়ে রূপলাল হাউসের কোনো সংস্কার কাজ হচ্ছে না। 

ঢাকার অতি প্রাচীন বাড়ি ‘মঙ্গলালয়’ সরজমিনে গিয়ে দেখা গেলো অপরূপ নির্মাণশৈলীতে গড়ার এমন ভবনের সেই সৌন্দয্যের নামমাত্র আর এখন নেই। তবে এই ভবনের ভবনের সামনের অবয়বে ছিল ডিটেইল কারুকাজ, যা এখন আর নেই। একতলায় মূল প্রবশে পথে একাধিক খিলান ধবংস করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি খিলানরে ওপরে গোলাকার কারতুশ (cartouche) ছলি চুরি কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাই রিলিফে অনন্দ্যিসুন্দর ফিগারটেভি কাজ করা হয়ছিলো তার দেখা মিলবে না এখন। ভবনের ছাদের ওপর ছিল অলঙ্করণ করা তিনটি ত্রিভূজাকৃতির পডেমিন্টে চুরি হয়ে গেছে। ফ্রঞ্চে রোকোকো স্টাইলে অলঙ্করণ করা মূল পডেমিন্টেটি ছিল মাঝখানে। এর কন্দেরে ডিম্বাকৃতি ফ্রেমের (cartouche) উপর চুন-সুরকির হাই রিলিফ ওয়ার্ক। তাতে মানুষরে মুখচ্ছবি,যা এখন আর চোখে পড়ে না কারো। বাড়ির বিভিন্ন অংশে মানুষের বিচিত্র ফিগার থাকায় স্থানীয়দের কাছে এটি পুতুলবাড়ি নামেও পরচিতি।

এরপর বাকি পুরাকীর্তিগুলি পরিদর্শনে গিয়েও একই হাল দেখা গেলো। বসন্ত বাবুর বাড়ি, বড় বাবুর বাড়ি, বিবি কা রওজা, বিহারী লাল জিউ মন্দির, সুত্রাপুর জমিদার বাড়ি, জলসা ঘর, মুড়াপাড়া জমিদারের ঢাকার বাড়ি, ঋষিকেশ বাবুর বাড়ি কোনোটাতে নেই কারো যত্ন বা তদারকি। অবহেলা, অনাদরে আর খামখেয়ালীপনায় ধবংস হয়েছে যাচ্ছে।

পরিদর্শনের এক ফাকে এব্যপারে সেভ দ্য হেরিটেজেস অব বাংলাদেশ’র পরিচালক সাজ্জাদুর রশীদ বলেন, দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে মানুষকে জানাতেই এ ভ্রমণ আয়োজন। তিনি বলেন, তাদের সংগঠন সচেতনতা তৈরি করতে পারে, ধারণা বা তথ্য দিতে পারে। তবে সেগুলো রক্ষার সক্ষমতা তাদের নেই, ফলে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।

সেভ দ্য হেরিটেজেস অব বাংলাদেশ’র এই ট্যুরে আসা স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ দেশ প্রতিনিধি বলেন, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে সরকারের পুরার্কীতি কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোভাবেই এমন ঐতিহ্যকে ধবংস করতে দেয়া যাবে না। তিনি অভিযোগ করেন যখনই দেশে বড় ধরণের সরকারি ছুটি হয় ঠিক তখনই হাতুড়ি আর শাবলের আচড় পড়ে পুরান ঢাকার পুরাকীর্তির ওপর। 

শেষ কথা

পুরান ঢাকার স্থপনাগুলি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্যের স্থাপনা। এতে এমন কিছু অলঙ্করণ যা ঢাকায় আর কোনো ভবনে দেখা যায় না। অথচ ২০০৯ সালে পুরো এলাকাটিকে ‘সংরক্ষিত’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিল সরকার। কিন্তু ২০১৭ সালে তা বাতিল করে নতুন তালিকা করা হয়। তাতে এলাকাভিত্তিক সংরক্ষণের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। ঢাকার বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করায় সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে দস্যুরা। পুরান ঢাকার সব পুরাকৃতির বেলায়ও তা-ই ঘটে যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরবান স্টাডি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তাইমুর ইসলাম ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু ভবন সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী ভবনগুলো ভাঙা যাবে না। পুরান ঢকার অনেক পুরানো স্থাপনার বেলায়ও এই আদেশ বহাল আছে। এদিকে ২০০৯ সালে পুরো এলাকাটিকে ‘সংরক্ষিত’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিল সরকার। কিন্তু ২০১৭ সালে তা বাতিল করে নতুন তালিকা করা হয়। তাতে এলাকাভিত্তিক সংরক্ষণের বিষয়টি সম্পূণরুপে বাদ দেয়া হয়েছে রহস্যজনক কারণে। আর এতে করে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করায় সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে দখলদার ও পুরাকৃতি ধবংকাীরা। স্থপতিবিদদের মতে, পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য বলতে শুধু পুরাকীর্তি কিংবা পুরোনো স্থাপনা নয়। পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য, খাবার, ভাষা, জীববৈচিত্র নদ-নদী ও জলাশয়। তাই পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

শেয়ার করুন