৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৮:৪৪ অপরাহ্ন


রাজনীতি উত্তপ্ত হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৮-২০২৫
রাজনীতি উত্তপ্ত হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপার সেক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে


যেকোনো একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিপদজ্জনক পথে টার্ন নিতে পারে। বিশেষ করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপার সেক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনও হয়ে উঠতে পারে উত্তপ্ত। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি পরিবেশ পরিস্থতি বিশ্লেষণ করে এমন আশঙ্কা হচ্ছে কারো কারো মধ্যে। 

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ওপর জমা হওয়া আবেদনের ওপর শুনানিকালে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি-কিল-ঘুষির ঘটনা ঘটেছে। গত ২৪ আগস্ট রোববার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এই শুনানি শুরু হয়। শুনানিকালে বেলা একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এমন একটি ঘটনা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহর অভিযোগ, তিনিসহ তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলা চালিয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ও তাঁর সঙ্গে থাকা দলীয় নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে রুমিন ফারহানার দাবি, আতাউল্লাহ পরিচিত মুখ নন। তিনি এনসিপি থেকে এসেছেন, না জামায়াত থেকে এসেছেন, তা তিনি জানেন না। প্রথমে তাঁকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। তারপর তো আর তাঁর লোকজন বসে থাকবেন না। তাঁর লোকজনও জবাব দিয়েছেন। 

পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে যা উঠে এলো

এদিকে এমন ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। আর এরপর বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মন্তব্য যা ছিল অনেক বিব্রতকর। এঘটনার পর ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রোববার (২৪ আগস্ট) ইসি সচিব বরাবর এই অভিযোগ করেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মোহাম্মদ আতাউল্লাহ।

অন্যদিকে পর ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা গত ১৫ বছর বিএনপির যে নেতাকর্মীদের জন্য লড়াই করলাম, তারাই এখন আমাকে ধাক্কা দেয়’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। এরপরই তার মুখ ফসকে বের হয়, ‘ঠিক আছে, ধাক্কার বদলে তো ধাক্কা আসবেই’। এদিকে এই ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দুটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) শুনানিকালে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি-কিল-ঘুষির পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৃথক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে দুই পক্ষ। রুমিন ফারহানার অনুসারীরা সরাইলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহসহ অন্যান্য নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এদিকে নির্বাচন ভবনে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের শুনানিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এনসিপির নেতাদের ধাক্কাধাক্কি ও মারধরের ঘটনার রুমিন ফারহানাকে ‘বিএনপির আওয়ামী লীগবিষয়ক অন্যতম সম্পাদক’ বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। 

অফিসার্স অ্যাড্রেস

গত সপ্তাহে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনা সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে কিছু কথা বলেছেন। এসব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান ধরনের জল্পনা কল্পনার ডানা মেলছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক জায়গায় বলেছেন, দেশ এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এজন্য বাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পাশাপাশি সেনা সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশের মানুষ এখন সেনা সদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেসে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে যে বেশ পেশাদারিত্ব রয়েছে তা তার কয়েকটি বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি যে বঝুতে পেরেছেন দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন। এধরনের বক্তব্যে তিনি একটি পেশাদার বাহিনীর পেশাদারিত্বের ইমেজ তুলে ধরেছেন। এবং এর যে একটি সুদূরপ্রসারী ভালো ও খারাপ প্রতিক্রিয়া আছে তা সংস্থাটির নজর এড়ায়নি বলেই সম্ভবত তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে সেনারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন’। তিনি নিজেই জানালেন ‘আগে এত দীর্ঘ সময় মাঠে থাকতে হয়নি। তাই সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দূরত্ব থাকলে তা দূর করতে হবে।’ কেননা মাঠে একটি এই ধরনের চৌকস বাহিনী দীর্ঘদিন থাকা নেতিবাচক দিকই বেশি। 

বিশ্লেষকদের মতে, আরেকটি বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। কেননা সেনাবাহিনী নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তির করার বিষয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কিছু বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এসবের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েননি। তিনি তার বক্তব্যে ভয়ভীতি, হিংসা কিংবা প্রতিশোধপরায়ণতা দেখাননি। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি সেনাবাহিনীর যে একটি কঠিন সহনশীলতা রয়েছে তা ফুটে উঠেছে ওয়াকার-উজ-জামান এর বক্তব্যে। কেননা দেশের এই স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে সম্প্রতি অত্যন্ত অল্পবয়সী শিক্ষার্থী যারা ২০২৪সালে রাজপথে দাবি আদায়ে রক্ত দিতে নেমে এসেছিল, তাদের কেউ কেউ হেন নেতিবাচক মন্তব্য না-ই যে করছে না। 

কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় যে সেনাবাহিনীর একটি আধুনিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন সেটি ওয়াকার-উজ-জামান এর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। স্বভাবত তিনি জুলাই বিপ্লবীদের সাহসী শিক্ষার্থীদের অবদানকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলেছেন, এসব মন্তব্যে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম। তারা আমাদের সন্তানের বয়সী। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এমন বক্তব্য খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ধরেই নেয়া যায় যে তিনি জুলাই বিপ্লবীদের মতো সাহসী মেধাবী দেশপ্রেমিকদের ভূমিকাকে ভবিষ্যতে দেশ গড়ার কাজে লাগানোর ব্যাপারে সচেতন। কারো কারো মতে, তার এই ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বই নয়, দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি কঠিন দেশপ্রেমের পাশাপাশি ভবিষ্যতে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় সে-ই শিক্ষাথীদের পাশে থাকার ইঙ্গিত করে। 

কেনো আশঙ্কা এবার নাহিদের কণ্ঠে

এদিকে চলমান নানান ধরনের আলাপ আলোচনা বাক-বিতণ্ডার মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিস্ফোরক মন্তব্য সবাইকে দ্বিধায় ফেলেছে। কেননা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে মনে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। রোববার এনসিপি ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স, মালয়েশিয়ার আয়োজনে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান বীরত্বগাথা ও বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ গঠনে প্রবাসীদের ভূমিকা শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এবং পরে প্রবাসী সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা জানান।

যেকোনো হট ইস্যুতেই হট হয়ে যেতে পারে দেশ

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট, জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করা নিয়ে নিয়ে নতুন আলোচনা রাজনৈতিক মাঠে। কারো হিসাবে হচ্ছে এখন জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে গণভোট করার চিন্তা। এনিয়ে বিএনপি স্পস্টতই বুঝতে পারছে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করা হলে কোনো কোনো দল এটাকে নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত করছে। দেখা যাচ্ছে আবারও জুলাই সনদের কতটি প্রস্তাব নিয়ে গণভোট হবে, সেটাও আলোচনা করা হচ্ছে। এরপর আলোচনায় আছে রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন বা বিশেষ সাংবিধানিক ঘোষণা জারির সম্ভাবনাও। 

এদিকে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে হলেও জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট করার প্রস্তাব দেওয়া হলে তাতে জামায়াতে ইসলামী আপত্তি জানাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। খসড়া সনদের কিছু বিষয় নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি আপত্তি জানিয়েছে। জানা গেছে, এগুলোর নিষ্পত্তি এবং সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে জুলাই জাতীয় সনদ। কিন্তু খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে সনদ। কোনো আদালতে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ দুই অঙ্গীকারে বিএনপি রাজি না হলেও জামায়াত একমত। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। দলগুলোর দাবি, সনদের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এভাবে একের পর এক বিষয়গুলিতে সমঝোতায় না এনে দেশ-কে নির্বাচনের দিকে টার্ন নিলে চরম বিপদের মুখে পড়বে। 

বিপজ্জনক পথে মোড় নেবে। এসব কারণেই কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে মনে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম? ইতোমধ্যে শোনা যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বহাল রেখে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে না বলেও এনসিপিসহ কয়েকটি দল মাঠে নামতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেনোইবা নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে ফেলেছেন- ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের মতো চোর-ডাকাত নয়। লুটপাট করে না। কিন্তু এই সরকার কি ভালো ভোট করতে পারবে?

শেয়ার করুন