০৯ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০২:৪৬:৫৪ পূর্বাহ্ন


দেশকে রাজেকুজ্জামান রতন
রাজনীতিতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৭-২০২২
রাজনীতিতে শ্বাসরুদ্ধকর   অবস্থা বিরাজ করছে রাজেকুজ্জামান রতন /ফাইল ছবি


বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেছেন, দেশে একদিকে দুর্নীতি অন্যদিকে দুঃশাসন জনজীবনে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, নারী লাঞ্ছনা এসব তো আছেই এর ওপর বর্তমানে রাজনীতিতে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে। রাজপথে, পত্রিকায়, টেলিভিশনে এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লেখা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ফলে অসন্তুষ্ট জনগণ এবং নিপীড়নমূলক সরকার এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দেশ।  

দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন বলে মনে করেন জানতে চাইলে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে রাজেকুজ্জামান রতন এসব কথা বলেন। 

রাজেকুজ্জামান রতনের জন্মবাংলাদেশের উত্তরের জেলা বর্তমানে বিভাগীয় শহর রংপুরে। সরকারি চাকরিজীবী বাবা ও গৃহিণী মায়ের পরিবারের ৭ জন সন্তানের মধ্যে তিনি ৪র্থ। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া ও বেড়ে উঠেছেন তিনি। রংপুর জিলাস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৮০ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করে ১৯৮১ সালে ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে। রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি তার এই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েই। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টে যুক্ত হন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কৃষি অনুষদ থেকে অনার্স শেষ করে এমএস করাকালীন সময়ে  তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফেলোশিপ পান। পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ৮ম বিসিএসে উত্তর্ঢু হন। কিন্তু উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান না করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক গ্রেফতার হলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে সম্মেলনে তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্ররাজনীতি শেষ করে তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে তিনি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শ্রম আইন সংশোধন কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি, শ্রম আদালতের শ্রমিক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র ব্যবস্থাপনায় তিনি  ইতালির তুরিনে অবস্থিত আইটিসি তে  দুই বার প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল গিয়েছেন। তিনি ন্যাশনাল কো অরডিনেসন কমিটি ফর ওয়ার্কার্স এডুকেশনের প্রবাসী শ্রমিক কমিটিতে সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কনভেনশনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০২২ সালের বাসদের কংগ্রেস তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের মুখপাত্র ভ্যানগার্ড পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।  

দেশ পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে রাজেকুজ্জামান রতন আরো বলেন, দেশ এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় যেমন আছে তেমনি ২০২৩ সালে কি আর একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এই আশঙ্কা জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে। যদি এরকম কিছু করার চেষ্টা শাসকদল আওয়ামী লীগের থাকে, তাহলে দেশের রাজনীতি এক চরম সংঘাতের দিকে ধাবিত হতে পারে। 

দেশ: দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। এদের সাথে বাম প্রগতিশিলরাও আছেন। এ সরকার কি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে কিছু করছে না? 

রাজেকুজ্জামান রতন: আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল, কিন্তু এই দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশে এই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি, বরং বৈষম্য বেড়েছে অনেক। গিনি সহগ অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন চরম বৈষম্যের দেশ। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে যে কোনো ক্ষমতাসীন দলকেই কিছু কাজ করতেই হয়। দেখতে হবে এসব কাজের সুফল জনগণ কতটুকু পাচ্ছে?  বড় বড় মেগা প্রকল্পের নামে যা হচ্ছে তার দায় জনগণকেই নিতে হবে। দুর্নীতি, অপচয়, ভুল নীতির খেসারত জনগণকেই দিতে হয়। জনগণের আকাক্সক্ষা কাজ, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা যেন ব্যয়বহুল না হয় কিন্তু সরকার এসব পূরণের চেষ্টার চাইতে দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের পথে হাঁটছে। অর্থাৎ সরকার চলছে  জনগনের আকাক্সক্ষার বিপরীত পথে।  

দেশ: দেশের পদ্মা ব্রিজের মতো এতো বড় একটা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

রাজেকুজ্জামান রতন: পদ্মা সেতুর মতো এতো বড় সেতু নির্মাণের কারিগরি দক্ষতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর দক্ষ প্রকৌশলী কোনোটাই আমাদের দেশের নেই। প্রধানত চীন এবং আরো ২০টি দেশের কারিগরি, প্রকৌশলগত সহায়তায় পদ্মা সেতু এক বড় অবকাঠামো নির্মাণ। এক্ষেত্রে দেশীয় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অর্থের জোগান এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ করেছে। ঢাকার সঙ্গে ২১টি জেলার যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করবে পদ্মা সেতু। ব্যয়, টোল আদায় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে একটি বড় স্থাপনা। শিল্প এবং কৃষির উন্নয়ন ছাড়া এই সেতু গর্বের বা প্রচারের সেতু হলেও দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে না।  

দেশ: কেমন আছেন আমাদের দেশের শ্রমিকরা?  

রাজেকুজ্জামান রতন: বাংলাদেশের শ্রমশক্তি এখন প্রায় ৭ কোটি। সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম শ্রমশক্তির দেশ। কিন্তু শ্রমশক্তির ৮৮ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। ফলে তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি ৬৫ ডলারের কম। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রফতানিকারক দেশ হলেও এই খাতের শ্রমিকদের মজুরি বিশ্বের সবচেয়ে কম যা ৯০ ডলারের কম। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে না, বরং প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। জাতিসংঘের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য কিনতে পারে না। পুষ্টিহীনতা, স্বল্প দক্ষতা, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কোনোরকমে টিকে আছেন। 

দেশ: কেন দেশের শ্রমিকদের বারবার বেতন-ভাতা বা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে হয়?

রাজেকুজ্জামান রতন:শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর পর পর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে মজুরি কোনোভাবেই মেলে না। মালিক এবং সরকার এই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চায় না এবং আলোচনায় কোনো ফল হয় না বলে শ্রমিকদের আন্দোলনের পথে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। 

দেশ: এর জন্য মাালিক বা সরকার কারা দায়ী? 

রাজেকুজ্জামান রতন:প্রধানত মালিক দায়ী। কারণ শ্রমিককে মজুরি দেয়ার দায়িত্ব মালিকের। কিন্তু সরকার দায় এড়াতে পারে না। শ্রমিকদের রেশন, আবাসন, চিকিৎসাব্যবস্থা করলে শ্রমিকরা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে এই ব্যাপারে  সরকারের দায়িত্বহীনতা শ্রমিকদের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। 

দেশ: অভিযোগ রয়েছে একশ্রেণির শ্রমিকনেতারা দেশের শ্রমিকদের অযথাই আন্দোলন সংগ্রামে উসকানি দেয়। এতে শ্রমিকদের চেয়ে ওইসব নেতার লাভ হয় বেশি। এমন মন্তব্য কীভাবে দেখেন? 

রাজেকুজ্জামান রতন:শ্রমিক অসন্তোষের কারণগুলো দেখলেই এই মন্তব্য যে ঠিক নয় বুঝতে অসুবিধা হয় না। মালিকপক্ষ কখনো কিছু শ্রমিকনেতাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে থাকে, তবে সেটা আন্দোলনের প্রধান বিষয় হয় না কখনো।  

দেশ: এ সরকার কি শ্রমিকদের জন্য কিছুই করেনি? 

রাজেকুজ্জামান রতন: কিছুই করেনি এভাবে বলা ঠিক নয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ইত্যদি বিষয়ে অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু  শ্রমিক এখনো তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থাকছে এটাই নির্মম বাস্তবতা। এখনো জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি, কর্ম ক্ষেত্রে নিহত হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা, কাজ হারানো শ্রমিকদের কোনো সুরক্ষা নেই।  

দেশ: কোন কোন সেক্টরে শ্রমিকরা বেশিমজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন? 

রাজেকুজ্জামান রতন: দেশে ৪৩টি সেক্টরে মজুরি বোর্ড আছে। যাদের মধ্যে ২৯টি ২০১৩ সালের পর মজুরি বোর্ড পুনর্গঠিত হয় নি। ফলে মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী পুরোনো স্কেলেই তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন। গত ৯ বছরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ অথচ শ্রমিকদের মজুরি তার তুলনায় বাড়েনি। তবে সবচেয়ে বেশি মজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন  পাটকল, চা, পুস্তক বাঁধাই, প্রিন্টিং, রি-রোলিং, হোটেল রেস্টুরেন্ট খাতের শ্রমিকরা। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেও প্রাপ্য মজুরি পাচ্ছেন না পরিবহন, নির্মাণখাতের শ্রমিক। কৃষি শ্রমিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কোনো নির্দিষ্ট মজুরি এবং কাজের ব্যবস্থা নেই। ফলে তাঁরাও দুর্দশায় থাকেন। 

দেশ: এই দুই ঈদে গার্মেন্টস শ্রমিকরা কি তাদের বেতন ভাতা সঠিক সময়ে পায়নি? 

রাজেকুজ্জামান রতন:শ্রমিকরা বোনাস এবং বেতন-ভাতা পেয়েছে ঠিক ঈদের আগের মুহূর্তে। ফলে তাদের ভীষণ কষ্ট হয়েছে বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে। 

দেশ: আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে শ্রমিকনেতারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে দেশের মান সম্মান নষ্ট করছে-এমন অভিযোগের জবাব কীভাবে দেবেন। 

রাজেকুজ্জামান রতন:শ্রমিকনেতাদের বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিছু বিদেশি এনজিও এবং দাতা সংস্থা দেশে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। তাঁরা তো সরকারের অনুমতি নিয়েই কাজ করে ফলে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আন্দোলন করলে দেশের মান সম্মান নষ্ট হয় না বরং কম মজুরি, অগণতান্ত্রিক শ্রম আইন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। রানা প্লাজা, তাজরিন, স্পেকট্রাম, হাসেম ফুডস, বিএম ডিপোতে শ্রমিকের মৃত্যু দেশের মানসম্মানের অবনমন ঘটায়। এসবের জন্য দায়ী মালিক শ্রেণি এবং সরকার।


শেয়ার করুন