২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৩:৫২:৩৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


ফরাশগঞ্জের পুতুল বাড়ির অলঙ্করণে নিষ্ঠুর আঘাত
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৭-২০২৩
ফরাশগঞ্জের পুতুল বাড়ির অলঙ্করণে নিষ্ঠুর আঘাত ফরাশগঞ্জের পুতুল বাড়ি


ফরাশগঞ্জের পুতুল বাড়ির ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা মঙ্গলালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যে এবার শাবলের নিষ্ঠুর আঘাত পড়েছে। হাইকোর্টের রায় অমান্য করেই ঢাকা মহানগরীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এই স্থাপনায় সবচেয়ে আকষণীয় অংশ গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। স্থাপনার মধ্যে যে অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অলংকরণসমূহ ছিল, তার একটি বড়ো অংশ ইতোমধ্যে ধবংসও করে ফেলা হয়েছে। আর এধরনের ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ সরকারের কোনো বিভাগই সক্রিয় হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ার ব্যাপারে প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আর এলাকাবাসীও ভয়ে টু-শব্দ করে না। 

এক নজরে পুতুলবাড়ি

ঢাকা মহানগরীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এলাকাগুলির মধ্যে অন্যতম  ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত বিকে দাস রোডে। এটি সর্ব সাধারণের কাছে পুতুল বাড়ি হিসেবে পরিচিত। ১৯১৫ সালে আশুতোষ দাস এই ভবনটি নির্মাণ করেন। আশুতোষ দাস এই এলাকার অন্যান্য জমিদার ব্যবসায়ীদের মতই নানান রকম ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৭৪০ সালে  মুঘল নায়েব নাজিম নওয়াজিশ আলী খানের  ফরমান নিয়ে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্তমান ফরাসগঞ্জ এলাকায় একটি মার্কেট স্থাপন করার পর এই এলাকাটি ফরাসিদের প্রভাব জমে উঠতে থাকে। ফরাসিদের প্রভাব এখনো বিভিন্ন ভবনের স্থাপত্য শৈলী বিরাজমান। আর এই পুতুল বাড়ি বা অনেকের কাছে ‘মঙ্গলালয়’ ১৯১৫ সালে নির্মিত নান্দনিক কারুকার্যময় জাঁকালো ফরাশগঞ্জের একটি বাড়ি। এ বাড়িটির চুঁড়ায় ও বিভিন্ন অংশে ছিল মানুষ ও ময়ুরের কনক্রিট নির্মিত প্রতিকৃতি। এর উপরের একপাশে ছিল মহিষের মাথা। বিভিন্ন অংশে মানুষের মূর্তি বা প্রতিকৃতি থাকায় অনেকে একে পুতুলওয়ালা বাড়ি বলে ডাকত। রেবতী মোহন দাস, ঋষিকেশ দাস ও আশুতোশ দাস তারা ছিল এক বংশের চাচাত-জেঠাত ভাই। তারা যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। তাদের প্রধান ব্যবসা ছিল কন্ট্রাক্টরি, ইট খোলা ও চিনি ব্যবসা। তারা জাভা থেকে মহিষের শিং ব্র্যান্ডের চিনি আমদানী করতেন। 

পুতুলবাড়ি ভবনের বৈশিষ্ট্য

আশুতোষ দাস এই ভবনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা মঙ্গলালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অলংকরণসমূহ যা ছিল ঢাকা নগরীর অন্য যে কোন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা থেকে স্বতন্ত্র। উল্লেখযোগ্য যে এই ভবনটি এর নান্দনিক গুরুত্বের জন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সচেতন  সংশ্লিষ্ট সকল নাগরিকের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে সমাদৃত। মূল অবয়বে অলংকরণ এর ক্ষেত্রে যে  বৈচিত্র্য রয়েছে তা সম্পূণরূপে স্বতন্ত্র এবং এই দিক থেকে এই ভবনটি  ঢাকায় অদ্বিতীয়। তিন চার দিন আগে শতবর্ষী এই দোতলা ভবনটির ছাদের উপর যে অলংকরণকৃত তিনটি ত্রিভুজাকৃতি পেডিমেন্টগুলো ছিল, যা কি-না ঢাকায় আর কোন ভবনে দেখতে পাওয়া যায় না সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফ্রেঞ্চ রোকোকো স্টাইলে (French Rococo)  অলংকরণ করা মাঝখানের মূল ত্রিভুজাকৃতি পেডিমেন্টের ঠিক কেন্দ্রে ডিম্বাকৃতি ফ্রেমের (cartouche) উপর চুন সুরকিতে ঐরময ৎবষরবভ এ করা মানুষের মুখচ্ছবির প্রতিকৃতির যে অলংকরন ছিল তা একেবারেই স্বতন্ত্র ছিল।

কেনো এই অবহেলা

আশুতোষ দাস এই ভবনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা মঙ্গলালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অলংকরণসমূহ যা ছিল ঢাকা নগরীর অন্য যে কোন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা থেকে স্বতন্ত্র যা আজ অবহেলার শিকার। ঐতিহ্য সংরক্ষণে যারা সোচ্চার তারা মনে করেন, সংরক্ষণবাদীদের বহুদিনের চেষ্টার পরেও এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এটাকে তারা একদিকে যেমন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির  স্বেচ্ছাকৃত  দায়িত্বের  অবহেলা হিসাবে দেখেন।  অন্যদিকে এই দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির ব্যর্থতার অন্যতম কারণ প্রয়োজনীয় সক্ষমতার যে অভাব সেটিও তারা মনে করেন। তাদের মতে, প্রকৃত পক্ষে ঐতিহাসিক, স্থাপতিক এবং নান্দনিক গুরুত্বের বিবেচনায় ফরাসগঞ্জ-বি কে দাস রোড এই সম্পূর্ণ এলাকাটি এলাকাভিত্তিক  সংরক্ষণের দাবি রাখে। 

আশুতোষ দাসের পরিবার কেনো ভারতে পাড়ি দিল? 

এদিকে ১৯১৫ সালে যে আশুতোষ দাস এই ভবনটি নির্মাণ করেন। তিনি নানান ধরনের প্রতিকূলতায়ও ফরাশগঞ্জের এই নয়ানাভিরাম এলাকা ত্যাগ করে যাননি। বলা চলে, নিজের হাতেই গড়া এমন স্থাপনা তিনি বিভিন্ন সময়ে ত্যাগ তা ফেলে যাননি। আশুতোষ দাস এই এলাকার অন্যান্য জমিদার ব্যবসায়ীদের মতই বিভিন্ন রকম ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত ছিলেন। যেমন কনস্ট্রাকশন বিজনেস,  ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং, ইমপোর্ট বিজনেস ইত্যাদি।  তবে ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের সময় এই পরিবারের সকলে ভারতে চলে যান।  কিন্তু সে সময় কেবলমাত্র তার পুত্র গোপালদাস ঢাকায় থেকে যান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ভবনটির সম্মুখভাগ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গানপাউডার দিযে পুড়িয়ে দেয়। এই এলাকার অন্য সকল হিন্দু পরিবার থেকে ব্যতিক্রম এই পরিবারটি যুদ্ধের পরও বাংলাদেশেই  থেকে যান। তবে অজ্ঞাত কারণে অতি সম্প্রতি সেই আশুতোষ দাসের পরিবারের সদস্য তারই নাতি দিলীপ দাস ভবনটি বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। যা এলাকায় ক্ষোভ চাঞ্চল্য ও নানান ধরনের হতাশাও তৈরি করেছে।

ঠিক ঈদের আগেই ধ্বংসলীলা

ফরাশগঞ্জের পুতুল বাড়ির ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা মঙ্গলালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যে শাবলের নিষ্ঠুর আঘাত বারবারই এসেছে। কিন্তু বেশ কয়েকবারই পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আরবান স্টাডি প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলামের নেতৃত্বে বাধা দেয়া হয় তারই স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে নিয়ে, যারা সব্বাই বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের নিয়েই বারবার চেষ্টা করেছেন এই ভবনের অলংকরণকৃত অংশগুলি ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে। কিন্ত এতো সর্তকতার মধ্যে এটি ধবংসের মোক্ষম সময় বেছে নেয়া হয় এবার ঈদের আগে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় এবারের ঈদের তিন চারদিন আগে শতবর্ষী এই দোতলা ভবনটির ছাদের উপর যে অলংকরণকৃত তিনটি ত্রিভুজাকৃতি পেডিমেন্টগুলো ছিল, যা কিনা ঢাকায় আর কোন ভবনে দেখতে পাওয়া যায় না, সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফ্রেঞ্চ রোকোকো স্টাইলে অলংকরণ করা মাঝখানের মূল  ত্রিভুজাকৃতি পেডিমেন্টের ঠিক কেন্দ্রে ডিম্বাকৃতি ফ্রেমের উপর চুন সুরকিতে হাই রিলিফে করা মানুষের মুখচ্ছবির প্রতিকৃতির যে অলংকরন ছিল তা একেবারেই স্বতন্ত্র ছিল। এধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এর পাশাপাশি  গত কয়েকদিন ধরে ধ্বংস করার যে আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে তার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঈদের আগেই ভবন এমন স্থাপত্য রক্ষায় আরবান স্টাডি প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম প্রতিবাদ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির প্রতি এই অমার্জনীয় অপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাবিহিত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিও নেন। 

এমন আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি ও তার সেচ্ছাসেবীরা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের সোচ্চার হন। যদিও এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুও আগেই ভবনটির সামনের ভাগের বা  সামনের অবয়বের যাবতীয় অলংকরণের কারুকাজ অপসারণের কাজ শুরু করা হয়ে যায়। তবে আরবান স্টাডি গ্রুপের গ্রুপের পক্ষ থেকে সুত্রাপুর থানায় গিয়ে তাদেরকে বিস্তারিত জানালে কর্মকর্তাদের সহায়তায় দুপুর নাগাদ কাজটি এমন গর্হিত কাজ বন্ধ করা হয়। তবে দু:খজনক হলেও সত্য এরই মধ্যে অলংকরণ এর ক্ষেত্রে অনন্যতা ছিল  তার সব চিহ্ন ধ্বংস করে ফেলা হয়। একতলায় মূল প্রবেশ পথে যে খিলানের সারি রয়েছে তার প্রতিটি খিলানের উপরেই ছিল গোলাকার কারতুশ এর উপর হাই  রিলিফে করা মানুষের মুখের প্রতিকৃতি। এ ধরনের অলংকরণ ঢাকায় আর কোন ভবনে  দেখতে পাওয়া যায় না। 

এদিকে এব্যাপারে আরবান স্টাডি প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলামের সাথে দেশ পত্রিকার প্রতিনিধি যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ২০০৯ সালে পুরো এলাকাটিকে সরকার  সংরক্ষিত ঘোষণা করে গেজেট পাস করে। তবে অজানা কারণে ২০১৭  সালে তা বাতিল করে নতুন করে তালিকা গেজেট করা হয় এবং তাতে এই এলাকাভিত্তিক সংরক্ষণ বিষয়টি সম্পূণরূপে বাদ দেয়া হয় বলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান। তিনি বলেন, এই এলাকাগুলোতে অবস্থিত বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে সেই ভবনগুলোর অস্তিত্ব মুনাফালোভী ডেভেলপারদের সামনে ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। তিনি জানান সেসময় এই এলাকায় প্রায় ৪/৫ টি গুরুত্বপূর্ণ ভবনসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো ভবন ধ্বংস করা হয়। তিনি বলেন, আরবান স্টাডি গ্রুপের তালিকাভুক্ত এই ভবনটির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ধ্বংস করে ঢাকা মহানগরীর ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে অপরিমেয় ক্ষতি  করা হলো  তা অবশ্যই আদালত অবমাননার শামিল। এছাড়া হাইকোর্টের এক রায়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালকের প্রতি আরবান স্টাডি গ্রুপের তালিকাভুক্ত ২২০০ ভবন  যাচাই বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করার সরাসরি নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও গত ৫ বছরেও  এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আমরা হারিয়ে ফেলছি বলে তাইমুর ইসলাম আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তাইমুর ইসলাম অবিলম্বে পুরান ঢাকাকে  ঐতিহ্যবাহী নগরী হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণার দাবি জানান। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় এলাকাভিত্তিক সংরক্ষণ এর আওতায় আরবান স্টাডি গ্রুপ চিহ্নিত আটটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল সংরক্ষণ করতে হবে। এই অঞ্চলগুলি হচ্ছে সুত্রাপুর, কোতোয়ালি, নবাবপুর, বংশাল, আরমানিটোলা, চকবাজার, লালবাগ, গেন্ডারিয়া। আর তা করা গেলেই ঢাকাকে  ঐতিহ্যবাহী নগরী সংরক্ষণে সুবিধা হবে।

শেয়ার করুন