২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:৪৩:১৯ অপরাহ্ন


প্রবাসে ঐতিহাসিক উৎসব
থ্যাংকস গিভিং ডে
সুলতানা রিজিয়া
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-১১-২০২৩
থ্যাংকস গিভিং ডে


উৎসব শব্দটির মাঝে সৃষ্টির আদি - অন্তে একটা কোলাহলমুখর আনন্দমেলার নিবিড় সংযোগ বিরাজমান। দেশে দেশে, কালে কালে, প্রাকৃতিক এবং ভৌগলিক পরিবেশে কত নামে, কত আয়োজনে, সামাজিক, পারিবারিক, লৌকিক এবং ধর্মীয় উপলক্ষে কতশত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য কিম্বা খতিয়ান আমাদের জানা নেই। আমরা শুধুমাত্র কল্পনায় উপলব্ধি করতে পারি সেই সময়কার উৎসবের পরিবেশ, সামাজিক আয়োজন এবং অনুষ্ঠানের বহুল ব্যাপকতা। শতাব্দীর ঐতিহাসিক রোজনামচায়, শিলালিপির ভগ্নাংশে, গুহা মানবের পাহাড়ের গায়ে অমোচনীয় আঁকিবুঁকিতে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অনুসন্ধিৎসু আবিষ্কারে, প্রাচীন পুঁথিপত্রের কল্যাণে যৎকিঞ্চিত ধারনায় পৌঁছুতে পারি। এর বেশি আজো অনাবিষ্কৃত। তবে উৎসব ছিলো, আছে এবং থাকবে।


উৎসব ছাড়া মানুষ্য সমাজ অকল্পনীয়। এই উৎসবের কল্যাণেই প্রচীন সভ্যতায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিলো, হাসি, খুশি, আনন্দ জীবনকে দিগন্তপ্রসারিত উন্মুক্ত তোরণদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিলো, মানুষ মানবিক হয়ে উঠেছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় পারস্পরিক সৌহার্দ্য- সম্প্রীতি, সমঝোতা- সহমর্মিতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় মানুষ আপন দায়িত্ব কর্তব্যের খেয়ায় একদিন খুঁজে পেয়েছিলো সভ্যতার অববাহিকা। প্রাণের উষ্ণতায় তারা সমুন্নত করেছিলো সমাজ, সংসারের অবকাঠামো, জিইয়ে রেখেছিলো আপন বংশলতিকার গৌরবময় ইতিহাস, প্রাণোচ্ছলতায় সংযুক্ত করেছিলো পারিবারিক প্রেম প্রীতি,স্নেহ মায়া মমতার যাপন স্রোতধারা।


আধুনিক উৎসব অনুষ্ঠানসমূহ মানুষের সম্মিলনে, পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতে, মনের ভাব বিনিময়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। বর্তমানে সামাজিক,পারিবারিক, ধর্মীয়, শিল্প,  সাহিত্য - সংস্কৃতি, সভ্যতা- কৃষ্টি, প্রথাগত আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নিছক লৌকিক বিশ্বাস অথবা কুসংস্কারকে কেন্দ্র করেও নানান ধরনের উৎসবের প্রসার ঘটেছে। এইসব উৎসব গোত্রের সমষ্টিতে, মতাদর্শের ভিত্তিতে এবং দেশজ ভাবধারায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশ থেকে দেশে শতসহস্র বছরের আদি উৎসবসমূহের ধ্যান ধারনা নতুনত্বের ছোঁয়ায় এবং পারিপার্শ্বিক প্রয়োজনে কিম্বা আয়োজন উপাচারের সহজলভ্যতায় পরিবর্তিত হয়েছে। একই সাথে উৎসবের নতুন নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। এসবের মূলে রয়েছে দেশজ ও ভৌগোলিক অবকাঠামো, সামাজিক - পারবারিক ঐতিহ্য, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মূল্যায়ন, দল বা গোষ্ঠীর  প্রতিপত্তি -  প্রতাপ অথবা প্রদর্শনবাদী মোহের প্রতিযোগিতা।


আমরা ঘরে বাইরে সর্বত্রই কোন না কোন উপলক্ষে উৎসব আয়োজনে কম বেশি মেতে উঠি। এইসব উৎসবমুখর পরিবেশ আমাদের আনন্দ দানের সাথে পুরাতন পরিচয় বা সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে সাহায্য করে, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি সুযোগও করে দেয়।  এছাড়াও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়, আত্মীয়তার গ্রন্থি মায়াময় হয়ে উঠে। সামাজিক দায় দায়িত্ব পালন সহাজতর ও সাবলীলতায় "দশে মিলে করি কাজ" এই মতাদর্শ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।


বিদেশ বিভূঁইয়ে বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও  প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বারোমাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। এর বিবাহ কিম্বা গায়ে হলুদ, তার বিবাহ বার্ষিকী বা জন্মদিন, অমুক পরিবারে নতুন সন্তান আসছে, তাই আসন্ন মা'য়ের স্বাদ খাওয়া (বেবী সাওয়ার ), বাচ্চার  আকিকা, মুখে ভাত, নতুন জব ( চাকরি ), গ্রাজুয়েশন, অষ্টাদশী বা সাবালকত্ব লাভের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো তো  হরহামেশাই অনুষ্ঠিত হয়, হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত থাকে বাঙালির পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের  আয়োজন। বাংলাদেশীদের বাংলাভাষা দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও ছোট বড় আয়োজন হতে দেখেছি। নিউইয়র্ক, জ্যাকশন হাইটসে অনুষ্ঠিত বইমেলার উৎসবও কোন অংশে কম নয়। প্রবাসী বাঙালি পরিবারের অংশগ্রহণে মেলা প্রসঙ্গে গড়ে উঠে বাংলাদেশীর অকৃত্রিম আবহ! কত পুরাতন মুখ খুঁজে পাওয়া যায়! কত নতুন মুখ আপন হয়ে সম্পর্ককে প্রানময় করে তোলে। তাই এইসব উৎসবের তুলনাই হয় না।


মার্কিন আমেরিকা আয়োতনে যতোবড় দেশ, ততোধিক এদেশে বসবাসরত স্থানীয়দের সাথে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর জাতি, ধর্ম, ভাষা, শিক্ষা, গোত্র, রং, আকার - প্রকার, সাজ - পোশাক, আচার - অনুষ্ঠান, শিল্প - সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি -কালচার মিলে মিশে একাকার হয়েছে! আমেরিকার মাটি, পাহাড়- পর্বত, বন-বনানী, সমুদ্র নদী গাঙ, ঝর্ণার উৎস, প্রপাতের অঝর জলস্রোতের সাথে প্রবাসী জনগোষ্ঠীর নাড়ীর টান সুদৃঢ় হয়েছে, বংশ পরম্পরায় জন্মসূত্রে কিম্বা নাগরিকত্ব লাভে তারাও আইনগত ভাবে আমেরিকান হয়েছে। সুতরাং সুবৃহৎ এই রাষ্ট্রে স্বভাবতই উৎসবের কমতি নেই, বাধা নেই, আয়োজনে কৃপণতাও নেই। এখানের সকল জাতি-গোত্র, ধর্মীয় অনুশাসনের জনসাধারণ যার যার মতো আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসব, পালা-পার্বণ উদযাপন করেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উৎসবসমূহে সকলেই আন্তরিকতায় অংশগ্রহণ করেন। আমেরিকায় সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে অন্যতম আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। এর পাশে স্থান করে নিয়েছে জনপ্রিয় উৎসব হ্যাপী হ্যালোইন, ফসলকাটার উৎসব, থ্যাংকস গিভিং ডে, ফ্রি ফ্রাইডে, বড়দিনের উৎসব সহ আরো কত্ত উৎসব! এদেশে সকল উৎসবই ঘটা করে, আনন্দ বিনোদনে এবং  সম্মিলিতভাবে পালিত হয় থাকে। তারমধ্যে ঐতিহাসিক উৎসব "থ্যাংকস গিভিং ডে" একটু ভিন্নমাত্রায়, সৌহার্দ্য সম্প্রীতির আবহে আনন্দের সাথে পালিত হয়। প্রতিবছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বা শেষ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবেই "থ্যাংকস গিভিং ডে" উদযাপন করা হয়। ১৮১৭ সালে সরকারীভাবে সর্ব প্রথম "থ্যাঙ্কস গিভিং ডে" উদযাপিত হয়েছিল নিউইয়র্কে। এরপর থেকে প্রতি বছর এই উৎসব নিয়মিত ভাবে পালিত হয়ে আসছে। একই সাথে অন্যান্য স্টেটেও উৎসবটি সম্প্রসারিত হচ্ছে। দিনটি আমেরিকায় সরকারি ছুটির দিন। একই মতাদর্শে, আনন্দ বিনোদনের আমেজে পার্শ্ববর্তী দেশ কানাডায় এ দিনটি পালন করা হয় প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার।



সৃষ্টির সূচনা থেকেই শ্রমনির্ভর পরিশ্রমী মনুষ্যজাতিকে জীবন ধারনের জন্য, পরিবার পরিজনের প্রয়োজনে, দেশ ও জাতি কল্যাণে, নিজস্ব অভিমত, মুক্তচিন্তা  চেতনাকে সমুন্নত রাখতে শত সহস্র প্রতিকূলতাকে পরাভূত করে, সংগ্রামের মাঝ দিয়েই সামনের কাতারে এগিয়ে আসতে হয়েছে। একই সাথে সমষ্টির জীবন যাপনে নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতার জন্য, আপন আচার আচরণের নিরাপত্তা জন্য, সর্বপরি ধর্মীয় অনুশাসন, বিশ্বাস পালনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার জন্য মানুষকে জীবন উৎসর্গের সাথে বাড়িঘর ছাড়া, গ্রাম ছাড়া থেকে দেশও ছাড়তে হয়েছে। এমন স্থানান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়েই আজ বিশ্বজুড়ে জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর সকল মানুষ প্রায় একত্রে, পাশাপাশি, কাছাকাছি বসবাসের সুযোগ পেয়েছে। পারস্পরিক ভাব ভাষা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচার প্রচরণায় দ্বন্দ্ব সংঘাত নিরসনের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, মুক্তচিন্তার আলোকে পরমত সহিষ্ণুতার উন্মেষ ঘটেছে। এভাবেই আজকের সভ্যতায় কিছু কিছু ত্যাগের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজয় উৎসবের মাধ্যমে। এই সব বেদনার্ত উৎসব মূলতঃ প্রাপ্তির আনন্দে এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মনুষ্যসমাজ তার স্রষ্টার কাছে নতজানু হয়েছে, কৃতজ্ঞতায় প্রকাশে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। মানুষ জন্মগত ভাবেই তার স্রষ্টার মাহাত্ম্যপূর্ণ অনুগ্রহ, মহানুভবতা এবং করুণায় বিশ্বাসী। এমন বিশ্বাস থেকেই শুরু হয়েছিলো আজকের "থ্যাংকস গিভিং ডে" এর ঐতিহাসিক বিজয় উৎসব।


থ্যাংকস গিভিং ডে এর শুভ সূচনাঃ


থ্যাংকস গিভিং ডে- উৎসবে জড়িয়ে আছে এক মর্মান্তিক  বিষাদময় ইতিহাস। শাসক দ্বারা শোষিতের উপর দমন পীড়ন, জেল জরিমানা থেকে প্রাণ নাশের হুমকি, সমূলে  উচ্ছেদের রীতি নীতি কমবেশি আজও বহাল রয়েছে। অহেতুক নিপীড়নের শিকার হন প্রধানতঃ শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী ( আমজনতা ),  দরিদ্র জনসাধারণ এবং ধর্মপ্রাণ বিজ্ঞজনরা। ১৬২০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস একটি চার্চ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সবাইকে ওই চার্চে রাজার প্রথানুসরণ করতে বাধ্য করতে শুরু করে। কিন্তু অনেক ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান "পিলগ্রিম সম্প্রদায় "এর বিরোধিতা করেন। তারা রাজার চার্চে না গিয়ে সাধারণ চার্চেই ধর্মচর্চা অব্যাহত রাখেন। ইংল্যান্ডের তৎকালীন অত্যাচারী শাসকদের অবাধ্য হওয়ার কারণে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান পিলগ্রিমদের নেতাকে আটক করা হয়। বাকিরা নিজ নিজ নিরাপত্তার কারণে বাড়ি ঘর বিক্রি করে নির্বিঘ্নে, একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য  একটি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়।

১৬২০ সালে"মে ফ্লাওয়ার" নামের এক মালবাহী জাহাজে তারা ১০২ জন ইংল্যান্ডের সাউথ হ্যাম্পটন থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো। জানা যায় তাদের দলটিতে ৭০ জন নারী ও পুরুষ ছিলেন। বাকিরা ছিল শিশু। দলটির সকলেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। তাদের প্রাথমিক গন্তব্য ছিল ভার্জিনিয়া কোস্ট, যেখানে আরও কিছু পিলগ্রিমের বসবাস ছিল। কথিত আছে সে দলটির সকলেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। জাহাজে তাদের পানি ও খাবারের সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। ডিসেম্বরে তীব্র শীতের মধ্যে তারা ম্যাসাচুসেটসে (বর্তমান বোস্টন) পৌঁছান। যাত্রীদের সকলেই জাহাজ থেকে অবতরন করেন এবং ভার্জিনিয়া কোস্টে পৌঁছানোর পরিকল্পনা বাতিল করে নতুন আশা বুকে বেঁধে মেসাচুসেটসেই কলোনী গড়ে তোলেন, যাকে বলা হয়ে থাকে প্লিমথ কলোনী। দলটিতে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক ও বিচারক থাকলেও কর্মী শ্রেনীর মানুষ ছিল না  বিধায় শুরুতে তাদের অনেক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, শীতের তীব্রতায় প্রতিদিনই দুই একজনের জীবন সংকট দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ মৃত্যু বরণও করেন। শীত পেরিয়ে যখন বসন্ত ঋতুর  আগমন ঘটে তখন বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন উদ্যমে তারা ধীরে ধীরে ঘর-বাড়ি বানাতে শুরু করেন, আশেপাশের স্থানীয় ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন, উপজাতিদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে চাষ-বাস শুরু করেন। এরপর থেকেই উপজাতিদের সাথে উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় প্রথা চালু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্লীমথ কলোনী বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। তারা কঠোর পরিশ্রমে ফিরে পান মুক্ত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সাথে ধর্মচর্চার স্বাধীনতা।


১৬২১ সালের নভেম্বর মাসে প্লিমথবাসী প্রথমবারের মত নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলে। ফসলের মধ্যে ভুট্টার ফলন এত বেশী ভালো হয়েছিল যে তৎকালীন গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড এই উপলক্ষে সমস্ত ইন্ডিয়ান উপজাতি এবং প্লীমথ কলোনিবাসীদের সৌজন্যে ‘ফিস্টি’ আয়োজন করেন। কথিত আছে যে,

ফিস্টির দিনটিকে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সকলেই কৃতজ্ঞ চিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের কৃপায় তারা বেঁচে আছে, প্রভুর দয়ায় তাদের সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, পতিত বন্যভূমিকে সকলে মিলে বাসযোগ্য কলোনি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে, ঈশ্বর কৃপা করেছেন বলেই উৎপাদিত ফসলে তাদের গোলা ভরে উঠেছে। ফসলের ফলন এত বেশী হয়েছে যে আগামী শীত কেটে গিয়েছিলো কোন খাদ্য ঘাটতি ছাড়াই। ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে নিজেদের মধ্যে ধন্যবাদ বিনিময় হয়, খাওয়া দাওয়া হয়, সকলে মিলে আনন্দ-ফূর্তিতে কাটিয়ে দেন একটি দিন। পরস্পর-পরস্পরে ধন্যবাদ বিনিময়ের সেই দিন থেকেই অনুষ্ঠানটি আমেরিকার সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্লীমথ কলোনিবাসীর দেখাদেখি থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপনের এই রীতি অন্যান্য কলোনিবাসীদের মাঝে সম্প্রসারিত হতে থাকে। তবে তখন বছরের নির্দিষ্ট দিনে এই উৎসব পালিত হতো না। কলোনিবাসীদের নিজেদের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী  বছরের একটি দিন থ্যাঙ্কস গিভিং ডে হিসাবে উদযাপন করতো।

দিসবটিতে ধনী-গরিব সবাই মেতে উঠেন ঐতিহ্যবাহী টার্কি ভোজে। পারিবারিকভাবে প্রতিটি ঘরেই চলে টার্কি লাঞ্চ আর ডিনার। থ্যাংকস গিভিং ডিনারকে আরো মুখরোচক ও আকর্ষণীয় করার চেষ্টায় প্লীমথ  কলোনীবাসীরা বনে বাদাড়ে পাখি পশু শিকার করতেন।এই ঋতুতে বন জঙ্গলে প্রচুর টার্কি দেখা যায়। টার্কি হচ্ছে ময়ূরের মত দেখতে কিন্তু ময়ূর নয়, অনেকে বনমোরগও (দেশীয় মোরগের চেয়ে আয়তনে বড়, ওজনে বেশি ) বলে। তারা দলবদ্ধভাবে টার্কি শিকার করে টার্কির মাংস দিয়ে উৎসব করতেন। থ্যাংকস গিভিং ডিনারে বর্তমানে নানারকম খাবারের আয়োজন থাকে, কিন্তু টার্কি রোস্ট এবং সবশেষে পামকিন পাই, আদি ও অকৃত্রিম হিসেবে আজও রয়ে গেছে খাদ্য তালিকায়।


"থ্যাংকস গিভিং ডে"কে স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটঃ


[[ উল্লেখ্য যে ১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারী রাইম ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’ রচয়িতা সারাহ যোসেফা প্রথম উদ্যোগ নেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পত্র-পত্রিকায় আর্টিক্যাল, এডিটোরিয়েল লিখাসহ এই আবেদনের সপক্ষে প্রচুর চিঠিপত্র গভর্নর, সিনেটর, প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদদের কাছে পাঠিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সারাহ যোসেফের আবেদন খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন এবং ‘সিভিল ওয়ার’ চলাকালীন সময়েই জনগণের উদ্দেশ্যে আবেদনমূলক ঘোষনা দেন, সকলেই যেন পরম করুনাময় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে ঈশ্বর! তোমার স্নেহের পরশ, অপার করুণা তুমি তাদের উপর বর্ষণ করো, যারা গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে নারী স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান পিতৃহারা হয়েছে, যে মা সন্তান হারিয়েছে, যা ক্ষতি সমস্ত জাতির হয়েছে, সমস্ত ক্ষতি যেনো দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। জীবিত সকলের যেন মঙ্গল হয়"।

একই বছর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নভেম্বার মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়। ‘গ্রেট ডিপ্রেশান’ হিসেবে পরিচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট রিটেল সেল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনার ঘোষনা দেন। সেই থেকে শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে নভেম্বার মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ পালিত হয়।]]



থ্যাংকস গিভিং ডে র উৎসব পরবর্তী উৎসব শুরু হয় ব্লাক ফ্রাইডে সেলএর কিনি বিকি। ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলে আমেরিকান জনগণের জন্য প্রিয় পণ্যসামগ্রী সীমিত পরিমাণে কিন্তু জলের দরে বিক্রি করার ঘোষণা দেয়া হয়। যেহেতু সীমিত পরিমাণ তাই কার আগে কে পাবে, এই নিয়ে হুড়োহুড়ির প্রতিযোগিতা চলে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষজন কম দামে ভালো একটা কিছু কেনার জন্য দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই টিভি ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয় তাদের পণ্যের মূল্যহ্রাসের তালিকা। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মুল্যহ্রাস করা হয় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির। এই দিনে অনেকের চাহিদা থাকে ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্যের প্রতি। এরমধ্যে টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, আইফোন, আইপ্যাড ইত্যাদি দ্রব্যের প্রতি মানুষের চাহিদা বেশি থাকে। ক্রেতারা বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে দোকানের সামনে লাইন ধরে ভোর ৬টায় পর্যন্ত অপেক্ষা করেন দোকানে প্রবেশের জন্য। কিন্তু প্রতিবছরই ঘটে ব্যতিক্রম ঘটনা। ওইদিন রাত ১২টার পরিবর্তে রাত ৮-৯টা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে যান অসংখ্য মানুষ।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে এই সেল শুরু হয়, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে সেল চলে, বেলা একটু বাড়ার সাথে তা শেষ হয়ে যায়। ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলে আমেরিকার প্রতিটি রিটেল স্টোরে অতি সুলভ মূল্যে আকর্ষণীয় পণ্য বিক্রয় করা হয়।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেলের বাণিজ্যিক লাভের অংশটুকু আমেরিকার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখে বলে এই সেলের আবেদন রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।


কানেকটিকাট, ইউএসএ


শেয়ার করুন