২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০১:৬:০০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


নীল পাহাড়ের খোঁজে
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৫-২০২২
নীল পাহাড়ের খোঁজে


আমি পৃথিবীর যে সব দেশে ভ্রমণ করতে যাই চেস্টা করি ওয়াকিং ট্যুর নিয়ে সেসব শহরের অলি গলি ঘুরে দেখতে। স্হানীয় গাইডরা অত্যন্ত যত্ন সহকারে খুঁটিনাটি জিনিষগুলি ঘুরে ঘুরে দেখায়। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে দেখেছি গাইডরা কোন ঐতিহাসিক স্হাপনায় কোথায় ১ম বা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুলির আঁচড়টি লেগেছে তারও সন্ধান জানে এবং টুরিস্টদের তা দেখায় । কিন্তু আমি হোম ওয়ার্ক করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে যা জেনেছি তা দেশটি সম্পর্কে আমাকে খুব লোভনীয় করে তুলেনি। যেমন ক্রিকেটে বিশ্ব চ্য্যম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার পরিচয় দেখেছি হিংসুটে জাতি হিসাবে। আর তাও নাকি এক নম্বরে। আমার বিষয় ভ্রমণ তাই সে বিষয়ে বিস্তারিত লেখার কোন ইচ্ছে নেই। তবে একবার একটা লেখা পড়ে জেনেছিলাম আরো একটা বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার স্হান প্রথম কাতারে। তাহলো অনাচারে। বিবিসির ফোকাস ম্যাগজিন জানিয়েছিল তথ্যটি। যৌন কামনা, লোভ, গর্ব, ঈর্ষা, অতিভোজন, আলস্য, রাগ ইত্যাদি বিষয়ের উপর জরীপ করে এই তালিকাটি করা হয়েছিলো। যেমন আলস্যের তালিকার শীর্ষে ছিলো আইসল্যান্ড, লোভি দেশের শীর্ষে মেক্সিকো, যৌননকামনার শীর্ষে দক্ষিন কোরিয়া আর আমি নিজে যে দেশটিতে বসবাস করি সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নাম্বার তালিকায় ছিলো অতিভোজনে। অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য আমার কাছে ছিলো তা হলো পাপী দেশের তালিকার শীর্ষেও একবার দেশটির নাম উঠেছিলো। অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট ছিলো ৪৬, যুক্তরাষ্ট্র ৩২, কানাডা ২৪ এবং তারপরে বিশ্বের আরো কিছু দেশ। তাই সিডনি শহরটির আনাচে কানাচে না ঘুরে দর্শনীয় স্হানগুলি দেখার আগ্রহই ছিলো বেশী।

তবে ভ্রমনের প্রসঙ্গে যাবার আগে আরো একটি তথ্য আমার পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। তাহলো অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশী প্রসঙ্গ। এদেশে বাংগালির আগমনের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো । ১৮৭০ সালে কোলকাতার বাংগালিরা জাহাজে করে এখানে প্রথম নেমেছিলো।তারা নেমেছিলো বৃটিশ জাহাজের কর্মী হিসাবে। যাকে আমরা বলি শিপ জাম্পার ।আমেরিকাতেও বাংগালীদের প্রথম আগমন ছিলো এভাবেই শিপ জাম্পার হিসাবে। আর চট্রগ্রামের সন্তান মাসুদুল করিম চৌধুরি ১৯৬২ সালে এখানে এসে স্হিতু হন বৈবাহিক সুত্রে। সে প্রসঙ্গ অন্য সময় বিস্তারিত লিখবো।

আজ আমার দর্শনীয় স্হানের তালিকায় ছিলো ব্লু মাউন্টেইন বা নীল পাহাড়। স্হানটি সিডনি শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। জায়গাটি সী লেভেল থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উপরে অবস্হিত। আগেই জেনেছিলাম ১০ লক্ষ হেক্টরের এই বিশাল পাহাড়ী অন্চলে বেশ কিছু শহর, নদী ও প্রাচীন ইউক্যালিপ্টাস বন, জল প্রপাত, চুনা পাথরের খাড়া পাহাড়ের দেয়াল সৌন্দর্যের ঢালি সাজিয়ে বসে আছে।


ব্লু মাউন্টেইনেরএই ট্যুর প্যাকেজটি নিউইয়র্ক থেকেই বুক করে গিয়েছিলাম। সাধারনত গাইডরা হোটেলের লবি থেকেই ট্যুরিস্টদের উঠিয়ে নেয়। তবে এই প্যাকেজের পিক আপ পয়েন্ট ছিলো আমার সিডনি হিলটন হোটেল থেকে অল্প দূরত্বে চায়না টাউনের ম্যাকডোনাল্ডের সামনে থেকে সকাল আট টায়। সময়ের আগেই পৌছে গেলাম ওখানে।ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ৮টায় ঝকঝকে একটি বাস এসে থামলো সামলে। গাইড নেমে তার লিস্ট মিলিয়ে আমাদের তুলে নিল ।

সারা বিশ্বের জনাপন্চাসেক টুরিস্ট বাসের পেটে । তবে আমেরিকান এবং জার্মান টুরিস্টই বেশী। বাস ছুটে চল্লো রাজপথ ধরে। রাস্তা ক্রমসই উপর দিকে উঠতে থাকে। পাহাড়ী পথ হলেও মসৃন রাস্তায় মনে হচ্ছিলো গাড়ী যেন উড়ে চলেছে। দু পাশের পাহাড়ী সৌন্দর্য মুগ্ধতার আবেশ ছড়ালেও ভয়ের কাছে আনন্দ যেন হার মানছিলো। একটু পরেই শুরু হলো গাইডের লেকচার । ভয় কাটাতে গাইডের লেকচারে মনযোগী হলাম।

সিডনি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে এই ব্লু মাউন্টেইন। আর এই ব্লু মাউন্টেনের ইকো পয়েন্টে গেলে দেখা যায় তিনটি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। যাদের উচ্চতা ছোট থেকে বড় ক্রমান্বয়ে ৯০৬, ৯১৮ ও ৯২২ মিটার। এরাই বলা হয় থ্রি সিস্টারস। এই তিন বোন বা থ্রি সিস্টারস নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি মিথ হচ্ছে কাতুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন মিহমি, উইমলাহ এবং গুননেডু, বাস করত জামিসন উপত্যকায়। তারা প্রেমে পড়ে আরেক গোষ্ঠীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু উপজাতীয় আইনে তাদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই তিন ভাই এই নিয়ম মানতে রাজি ছিল না, যেভাবেই হোক তিন বোনকে তারা বিয়ে করবে। অবশেষে তারা যুদ্ধ বাঁধাল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। যুদ্ধের মধ্যে তিন বোনের সমূহ বিপদ দেখে কাতুম্বা গোষ্ঠীর এক জাদুকর মন্ত্র বলে তাদের জাদু করে তিন বোনকে তিনটি পাথর বানিয়ে রাখে—যে যুদ্ধ শেষ হলে আবার তাদের আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু জাদুকর নিজেই যুদ্ধে নিহত হয়। আগের রূপে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র একমাত্র জাদুকর জানত। সেই থেকে এই তিন বোন তিনটি পাহাড় রূপে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছে প্রেম আর যুদ্ধের স্মারক হিসেবে।

এই ব্লু মাউন্টেনের গল্পটাই অন্য একটি বইয়ে অন্যভাবে পড়েছিলাম। তাহলো অনেক কাল আগে ব্লু মাউনটেইন্স-এ তিন বোন মিহমি, উইমলাহ এবং গুননেডু থাকতো। তাদের বাবা ছিলো একজন তান্ত্রিক চিকিৎসক। যে তাইয়াওয়াহ (Tyawah) নামে পরিচিত ছিলো। বুনিপ (Bunyip) নামে সেখানে একটি ‘জিনিস’ (ভূত-প্রেত জাতীয় কিছু) ছিলো। সে সংলগ্ন গভীর গর্তের ভেতর বাস করতো। সবাই তাকে ভয় পেতো। তাইয়াওয়াহ বাইরে যাওয়ার সময় তার তিন কন্যাকে নিরাপদে রেখে বিদায় নিতো। এরকমই একদিন বাবা কন্যাদের কাছে বিদায় নিয়ে বুনিপের গর্ত পার হয়ে গেলো। হঠাৎ পাহাড়ের ওপর থেকে কিছু একটা আছড়ে পড়লো নিচে। মিহমি ভয় পেয়ে গেলো। ভীতি থেকে সে নিজেও পাহাড় থেকে পাথর তুলে ছুড়ে মারতে থাকলো। এক পর্যায়ে সমস্ত পাহাড় ভেঙেচুড়ে পড়তে লাগলো বুনিয়াপের গর্তে। বুনিয়াপ হ্মিপ্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। তিন বোনকে দেখে ভীষণ ক্ষেপে গেলো সে। এবং তাদের শাস্তি দেয়ার জন্যে ছুটে গেলো।

দূর থেকে এই দৃশ্যটি দেখে ফেলে তিন বোনের বাবা তাইয়াওয়াহ। সে নিরুপায় হয়ে বুনিয়াপের অত্যাচার থেকে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য তার হাতের জাদুর হাড্ডি দিয়ে তিন বোনকে পাহাড়ে পরিণত করে দিলো। ক্রুদ্ধ বুনিয়াপ এবার আক্রমণ করলো কন্যাদের বাবাকে। তাইয়াওয়াহ বুনিয়াপের হাত থেকে বাঁচার জন্য যাদু বলে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে গেলো। সবাই নিরাপদ হলো। কিন্তু জাদুর হাড্ডি পড়ে গেলো তার হাত থেকে। এর মধ্যে বুনিয়াপ চলে গেলো। তাইয়াওয়াহ ফিরে এসে জাদুর হাড্ডি খোঁজা শুরু করলো। কিন্তু পেলো না।


অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের (Aborigional) মধ্যে কথিত আছে তাইয়াওয়াহ এখনো তার সেই জাদুর হাড়টি খুজে বেড়াচ্ছে। ওটা পেলেই তিন বোন আবার তাদের আগের রূপ ও সতেজ প্রাণ ফিরে পাবে। তারা অপেক্ষায় আছে।

বিদেশে প্রায় সব দর্শনীয় স্হানেই একটি গল্প বা মিথ থাকে। ট্যুর গাইডরা যুগ যুগ ধরে সে গল্প শুনিয়ে টুরিস্টদের আনন্দ যোগায়। রিলাক্সমুডে ছুটির আমেজে সে সব গল্প শুনতে খুব একটা খারাপ না লাগলেও বিশ্বাস করতে কস্ট হয়।

গল্প শুনতে শুনতে পৌছে গেলাম একটা স্পটে । গাইড জানালো জায়গাটার নাম মেরিস লুক আউট। এখানে আছে ক্যাফে রেঁস্তোরা, স্যুভেনির শপ ইত্যাদি। সামনে আদিগন্ত পাহাড়, খাদ দূরে বিস্তীর্ণ আকাশ। চারদিকে হাল্কা নীলের আভা। পাহাড়ের সবুজ গাছ গাছালির সাথে আকাশের নীল মিশে একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ যা ভাষায় বর্ননা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিলো একটা নীল পর্দা দিয়ে যেন গোটা পরিবেশটাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

গাইড আমাদের নিয়ে গেলো খোলা আকাশের নীচের রেস্তোরাঁয়। সবাই যে যার পছন্দমত খাবারের অর্ডার দিয়ে খেয়ে নিলাম। একটা স্যুভেনির শপে গিয়ে টুক করে কিনে নিলাম কিছু ভিউ কার্ড, চাবির রিং ইত্যাদি। তারপর আবার এসে বসলাম বাসে। একটু পরই বাস এসে থামলো ইকো পয়েন্ট লুক আউট বলে একটা জায়গায়। এখান থেকেই দেখা যাবে আমাদের কাঙ্খিত থ্রি সিস্টার্স বাতিনবোনকে। এটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ।

আমরা দূর থেকেই তিন বোনকে দেখতে পেলাম। সময়ের অভাবে গেলাম শুধু এক বোন মিহমিকে দেখতে। বড় রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে একটু নীচে নামতে হলো। একেবারে কাছে না গিয়ে দূর থেকে ছবি তুলে ফিরতে হলো গাইডের তাড়ায়।

আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। সূর্যের আলো কমেই নিভে আসছিলো। চলতি পথেই গাইড আমাদের হাত দেখিয়ে পরিচয় করে দিলো কাতুম্বা ফলস, ওয়েন্ট ওয়ার্থ ফলস, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাথে। কাঁছে যাবার সময় ছিলো না। বাস ছুটে চল্লো সিডনির দিকে।

শেয়ার করুন