২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১০:৪৬:২৯ অপরাহ্ন


বিশ্বমিডিয়ায় তোলপাড়
দোষ না করেও শাস্তি পেলাম: ড. ইউনূস
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০১-২০২৪
দোষ না করেও শাস্তি পেলাম: ড. ইউনূস ড. মুহাম্মদ ইউনূস


২০২৪ সনের প্রথম দিনেই বিশ্বজুড়ে খবর উঠলো বাংলাদেশের নাম। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কারাদ- দিয়েছে ঢাকার একটি শ্রম আদালত। শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ মোট চার জনকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পহেলা জানুয়ারি সোমবার ঢাকার শ্রম আদালত-৩-এর বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এই রায় দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত বাকি তিনজন হলেন, গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রায় ঘোষণার সময় ড. ইউনূসসহ চার জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। 

বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে প্রফেসর ইউনূসের উপস্থিতিতে বিচারক ৪৮ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন, যা মুহূর্তে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে। তোলপাড় হয় এমন ঘটনায়। দণ্ড দেওয়ার রায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন আর্টিক্যালও প্রকাশিত হয়। 

ড. ইউনূসের প্রতিক্রিয়া 

গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক ঠকানোর মামলায় ছয় মাসের সাজার রায় শোনার পর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন, তিনি দোষ না করেও সাজা পেয়েছেন। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত রায় ঘোষণার পর বাইরে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যে দোষ করিনি, সেই দোষের শাস্তি পেলাম। এটাকে ন্যায়বিচার যদি বলতে চান, তাহলে বলতে পারেন।’

যেসব মিডিয়ায় গুরুত্ব পায় প্রফেসর ইউনূস 

তখনো ইংরেজি ২০২৪ বর্ষবরণে মিডিয়ার লিড স্থানগুলো দখলে। কিন্তু বাংলাদেশে একজন নোবেলজয়ীকে দণ্ডাদেশ দেওয়ার খবরে বদলে যায় মিডিয়ার শীর্ষ খবরের স্থান। প্রকাশিত হতে থাকে ইউনূসের ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশে প্রফেসর ইউনূস খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তার গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে বিশ্বের অনেক দেশে। এতেই প্রফেসর ইউনূস ইস্যু ব্যাপক গুরুত্ব লাভ করে। 

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি মুহাম্মদ ইউনূস ছয় মাসের কারাদ-ের মুখোমুখি হয়েছেন। সোমবার শ্রম আইনের একটি মামলার রায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও তার সমর্থকরা এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করেছেন। 

এএফপির প্রতিবেদনই বিশ্বের বেশির ভাগ গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোম্পানির শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন না করার অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে চার জনই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। 

রায়ের আগে প্রধান প্রসিকিউটর খুরশিদ আলম খান এএফপিকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্যরা শ্রম আইনের বাধ্যতামূলক প্রয়োজনীয়তা লঙ্ঘন করেছেন, এটা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। 

এছাড়াও ফ্রান্স ২৪, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ, ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা, হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান টাইমস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের গালফ নিউজ, মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়ান ইনসাইট, পাকিস্তানের এআরওয়াই নিউজসহ বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণার সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত: ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির আরো শতাধিক অভিযোগ রয়েছে। গত মাসে এক মামলার শুনানিতে অংশ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে যে ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তার কোনোটি থেকে নিজে লাভবান হননি। এসব প্রতিষ্ঠান তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য করা হয়নি বলেও দাবি করেন ড. ইউনূস। 

ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্ববরেণ্যদের উদ্বেগ 

২০২৩ এর আগস্টে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৬০ নাগরিক ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে একটি যৌথ চিঠি প্রকাশ করেন। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে শতাধিক নোবেলজয়ীসহ প্রায় ২০০ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বরা ছিলেন। সে সময় তারা বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। একই সঙ্গে বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধের আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। 

যেভাবে মামলার রায় 

পূর্ব শিডিউল মোতাবেক নববর্ষের প্রথম দিন বেলা ১টা ৪০ মিনিটে ড. ইউনূস আদালতে উপস্থিত হন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, তার স্ত্রী অ্যাকটিভিস্ট রেহনুমা আহমেদ, রাজনীতি-বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন। দুপুর ২টা ১৩ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর ২টা ১৫ মিনিটে ইউনূসের উপস্থিতিতে আদালত ৮৪ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন। 

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, আসামিপক্ষ এক নম্বর আসামির বিষয়ে প্রশংসাসূচক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। যেখানে তাকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই আদালতে নোবেলজয়ী ইউনূসের বিচার হচ্ছে না, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচার হচ্ছে। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন-গ্রামীণ টেলিকমের এমডি মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার জনের পক্ষে মামলার আইনগত বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। আদালতে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলার আইনগত বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন। ওইদিন যুক্তি উপস্থাপন অসমাপ্ত অবস্থায় পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়। গত ২৪ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ২০২৪ এর ১ লা জানুয়ারি দিন ধার্য করেন। 

২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করেন। মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। গত ৬ নভেম্বর এ মামলার বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। গত ৯ নভেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ এ মামলার চারজন আসামির ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। গত ১৬ নভেম্বর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে। 

গত ৬ জুন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চার সাক্ষীর জবানবন্দিও রেকর্ড করা হয়। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলাটি করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) এস এম আরিফুজ্জামান। মামলার নথি অনুসারে, আইএফইডি কর্মকর্তারা ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণ টেলিকমের অফিস পরিদর্শন করে শ্রম আইনের বেশকিছু লঙ্ঘন খুঁজে পান। সেই বছরের ১৯ আগস্ট গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির ৬৭ কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। 

এছাড়া কর্মচারীদের পার্টিসিপেশন ও কল্যাণ তহবিল এখনো গঠন করা হয়নি এবং কোম্পানির যে লভ্যাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা ছিল তার ৫ শতাংশও পরিশোধ করা হয়নি।

শেয়ার করুন