২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:২৯:৩৭ অপরাহ্ন


পদ্মায় চাঙ্গা আ.লীগ কোণঠাসা বিএনপি
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৬-২০২২
পদ্মায় চাঙ্গা আ.লীগ কোণঠাসা বিএনপি


পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়লো? পদ্মা সেতুর সাফল্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ইস্যুতে যে কিছুটা প্রেশারের মধ্যে ছিল, সেটা কী ওভারকাম করে ফেললো? রাজনীতির মাঠে এ বিষয়টা এখন হট কেক। প্রচুর আলোচনা দুই শিবিরে। বলতে গেলে রাজনীতির মাঠ পদ্মা সেতুর ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগ যেমনটা ব্যাস্ত বিএনপিকে ঘায়েল করতে, তেমনি বিএনপি সেটা ওভারকাম করতে ব্যাবহার করছে সিলেটসহ উত্তরাঞ্চলের বন্যা। বিএনপির অভিযোগ সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের বন্যায় সরকার একেবারেই বরাদ্দ দেয়নি।

যেটুকু দিয়েছে তা খুবই নগণ্য। মাথাপিছু ৫-৬ টাকার মত। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানাদির খরচ হয়েছে, তার সিকিভাগ দিলেও বন্যার্তরা স্বস্তি পেতো। সরকার সেটা করেনি। মির্জা ফখরুলসহ দলের অন্যান্য নেতারাও বলছেন, সিলেটের বন্যার্তদের নিয়ে সরকারের কোনো চিন্তা নেই। তারা ব্যাস্ত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন-উৎসব নিয়ে। এর পাল্টা জবাবটাও দিচ্ছে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেই। তারা বলছে, বন্যার্তদের সহায়তায় যা করছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি মাঠে নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বন্যার্তদের দেখতে গিয়েছেন। ত্রাণ দিয়েছেন। সকল ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। 

তবে এটাও ঠিক, আমন্ত্রণ জানানোর পরও বিএনপির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলছেন, বিএনপি সঠিক কাজই করেছে। সারাক্ষণ পদ্মা সেতু নিয়ে অহেতুক মিথ্যা অপপ্রচার চালাবে। সেখানে আবার কেন যাবে। কেউ কেউ মনে করেন, যত যাই হোক এটা বাংলাদেশের মানুষের অর্থে হয়েছে। ফলে এটা কারোর নিজের পকেটের অর্থে হয়নি যেহেতু, তাই এ অর্জন সবার। সেখানে বিএনপির থাকাটা উচিত ছিল। বিএনপি অবশ্য এর ব্যাখ্যা দিয়েছে, মির্জা ফখরুল বলেছেন, যে সেতু থেকে আমাদের নেত্রীকে পানিতে টুস করে ফেলে মারতে চায়। সেখানে আমরা কেন যাব? 

বিএনপি বরাবরই পদ্মা সেতুর খরচ হওয়া অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। যেখানে দশ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে অতিরিক্ত ত্রিশ হাজার কোটি টাকা খরচা কেন? ওই অর্থ কোথায় গিয়েছে এ অভিযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর দিয়ে আসছে। সরকার পদ্মা নিয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনাদের সমালোচনাকে অপপ্রচার বলে প্রকাশ করেছে। যেমনটা অপপ্রচার করে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছিল। তারা বলছে, বিএনপি সে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। দেশের মানুষ চাইলেও তারা চায়নি পদ্মা সেতু হোক।  

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা। অনেকস্থানে খালেদা জিয়ার ২-৩টি বক্তব্য ভাইরাল হতে দেখা গেছে। যেখানে খালেদা জিয়া বলছেন,‘পদ্মা সেতুও গেল। বলেছিল পদ্মা সেতু হবে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরা সরে গেছে। কাজেই পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করতে পারবে না। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু হবে না। ক্ষমতায় গেলে আমরাই পদ্মা সেতু করবো।’ অবশ্য খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্য নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেক আগের বক্তব্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দ্রুত ভুলে যাবার অভ্যাস। তাই পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বক্তব্যটা আর সেভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না। আসলে যেহেতু আওয়ামী লীগ টানা তিন ট্রার্ম ক্ষমতায়- সে সুবাদে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন সহজ হয়ে গেছে। ফলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলছেন, এখন বিএনপি নেতাদের সাঁতরে পদ্মা পার হওয়া উচিত। তাদের নেত্রীর কথা অনুসারে তাদের সেতু দিয়ে পার হওয়া উচিত নয়। এমন বহুকথা।  

খালেদা জিয়ার যে হিসাব ছিল, তাতে তো এক সরকার তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। যেমনটা যমুনা বা বঙ্গবন্ধু সেতু। যেটা এরশাদ,বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগ শেষ করেছে। কিন্তু সত্যিই আওয়ামী লীগ দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থেকে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখে সড়ক চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু উন্মুক্ত করে দিতে পেরেছে। যদিও আরো একটি বড় পার্ট, রেল যোগাযোগ সেটা বাকি। তবে আগামী এক বছরের মধ্যে সেটাও করে ফেলার টার্গেট ধরেই পদ্মা বহুমুখী প্রজেক্ট এগোচ্ছে। ফলে এ সফলতা আওয়ামী লীগের এটা দ্বিমতের সুযোগ নেই। 

যা হোক, খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যটা যেভাবে প্রচার পেয়েছে, তাতে আর বিএনপি নেতাদের কিছুই বলার থাকছে না। তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বা রিয়াল ঘটনাটা বলার চেষ্টা করছেন, সেটা আর হালে পানি পাচ্ছেনা। পদ্মা সেতু খুলে দেয়া বা বাস্তবায়ন হয়ে গেছে, এটাই এখন সবার কাছে অবিশ্বাস্য এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ২১ জেলা এতে উপকৃত হচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষ দল-মত-নির্বিশেষে এ সুবিধা ভোগ শুরু করে দিয়েছে। বরিশাল এখন ঢাকা থেকে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাচ্ছে বাস। খুলনার পথও অর্ধেক সময়ে নেমে এসেছে। এই যে অগ্রগতি এটাকে মানুষ খুবই পজেটিভভাবে নিয়েছে। সেখানে বিএনপিকে বা খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্য প্রচার করে বিএনপিকে কার্যত স্পষ্ট স্তব্দ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। 



শুধুই যে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের ক্রেডিটটা আওয়ামী লীগ সরকার নিচ্ছে তাই নয়। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, তিনি যা বলেন সেটা করে দেখান। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া-বিএনপি এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে পদ্মা সেতু যাতে না হয় সে অপপ্রচার চালিয়েছিল দেশ ও বিদেশেও। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ দেখছে কোনটা সত্যি। 

পদ্মা সেতুর সাফল্যটা আসলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যও বড় একটা সাফল্য। যেভাবে তারা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন, বা করেছেন রাজনীতিতে। এটা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের মতো। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগ সরকার সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক পন্থায় ও দেশকে ডিজিটাল করে এগিয়ে নিচ্ছে। বিএনপি এ সবের পেছনে শুধু ষড়যন্ত্র করছে এবং বাধা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের ওই কথা অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এর বড় একটি প্রভাব আগামী ২০২৩ সনের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে আওয়ামী লীগ বলছে, এবার ওই নির্বাচন হবে ইভিএমে। বিএনপি ওই পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিএনপির ওই কথার ওপর কতটা আস্থা রাখবে সময় বলে দেবে।

পদ্মা সেতুর এ লগ্নে বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বেও অনেকটাই নিশ্চুপ। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের করোনা পজিটিভ। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা (যদিও শীর্ষনেতা নয়, কিন্তু ভোকাল) অসুস্থ। মির্জা আব্বাসও অনেকটাই অসুস্থ। সব মিলিয়ে শীর্ষনেতাদের মধ্যেও কিছুটা সমস্যা যাচ্ছে। অন্যরাও তেমন কিছু বললেও সেটা মিডিয়ায় খুব একটা হাইলাইট হচ্ছেনা।  

তবে এটা ঠিক, এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে দলটির কিছুটা সময় লাগবে। বিএনপি এ মুহূর্তে ব্যস্ত বন্যার্তদের ত্রাণসহায়তা নিয়ে এবং এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অনেকটাই নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা নিয়ে। আসলে ওগুলো খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেনা সাধারণ মানুষও। মিডিয়া ওই বিষয়গুলো অনেকটাই দুর্বলভাবে উপস্থাপন করে পদ্মার প্রতিটা সেকেন্ড যেভাবে হাইলাইটস করছে সেখানে বিএনপির ত্রাণ তৎপরতার মহৎ উদ্যোগ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। 

এদিকে পদ্মার খরচাদি নিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রচার চালালেও তাদের এক সময়ের শরিকদল জামায়াত ইসলামি নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর দলটির আমির ড.শফিকুর রহমান তার ভ্যারিফায়েড টাইমলাইনে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত মিলছে।

 জামায়াত আমির তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন,‘যুগযুগ ধরে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে যাতায়াত ও যোগাযোগে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে আসছিলেন। এমনকি মাঝেমধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের কারো কারো মৃত্যু ফেরি ঘাটেই হয়েছে। চিন্তা করলে যা খুবই হৃদয়বিদারক। আজ তাদের সে কষ্টের অনেকখানিই অবসান হলো। মহান রবের দরবারে এজন্য শুকরিয়া আদায় করছি, আলহামদুলিল্লাহ। সেতু নির্মাণে যার যেখানে যতটুকু অবদান কিংবা ভালো-মন্দ, তার বিচারের ভার জনগণের ওপর। পৃথিবীতে যা কিছুই কল্যাণকর হয়, তার জন্য মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায় করাই হচ্ছে মানুষের দায়িত্ব। আর মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত মানুষ বিনয়ী হয়। বিনয় হলো ভালো মানুষের পোশাক। মহান আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করি জনগণের ভ্যাট, ট্যাক্সের অর্থ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক ও কারিগরি অংশগ্রহণে যে সেতু তৈরি হলো, তা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হোক। কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান, যানবাহনে উচ্চহারের টোল যেন তাদের পুনর্বিবেচনায় স্থান পায়।

জামায়াত আমিরের এ মন্তব্য মূলত জামায়াতের চিন্তাধারা বা নীতির প্রকাশ পেয়েছে। সরকার বিরোধী বা আওয়ামী লীগের জোটের বাইরের যারা তারা পদ্মা ইস্যুতে বিএনপির মতোই তাদের মন্তব্য বা বক্তব্য প্রকাশ করতে দেখা গেছে। জামায়াতও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরের এবং সরকারের কঠোর সমালোচক। কারণ এ সরকার দলটির অনেক নেতা মানবাধিকার অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হওয়ায় ফাঁসি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জামায়াত তাদের নির্বাচনী প্রতীক দাড়িপাল্লা নিয়ে ও তাদের দলের নিবন্ধন নিয়েও সমস্যা তৈরি করে রেখেছেন। এমনি মুহূর্তে জামায়াতের এমন চিন্তাধারা বেশ কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাময়াত নেতাদের নতুন সখ্যতার যে আভাস রাজনীতিতে উড়ে বেড়াচ্ছিল, তারই প্রতিফলন কি-না সে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা অবশ্য জামায়াতের রাজনীতি, তাদের অধিকার। কোথায় কখন তারা কী করবেন। তবে পদ্মা সেতু ইস্যুতে সরকারি দল যেভাবে বিএনপিকে কোণঠাসা করে ফেলছে, তেমনি মুহূর্তে জামায়াতের এমন স্বস্তির বাক্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কিছুটা হলেও আনুকূল্য পাবে বৈকি। ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের এমন মূল্যায়ন যা বিএনপির জন্য কঠোর বার্তাও বটে। 

কারণ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতকেও তাদের সরকারবিরোধী বৃহত্তর প্লাটফর্মে সাথে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগোচ্ছিল বলে জানা গিয়েছিল। বিএনপি এ মুহূর্তে কী করবে সেটা অবশ্যই তাদের নিজস্ব পলিটিক্যাল বিষয়। আপাতত দৃষ্টিতে দেখলে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, পক্ষান্তরে বিএনপি কিছুটা হলেও বেটার অবস্থানে চলে গিয়েছিল। পদ্মার উদ্বোধনী ও সাফল্য সেটা অনেকটাই পেছনে ফেলে ভালো একটা অবস্থানে যেতে পেরেছে বলেই অনেকে মনে করেন এবং বিএনপি ওই একই ইস্যুতে কিছুটা হলেও কোণঠাসা এবং এখান থেকে উত্তরণটা কীভাবে ঘটাবে তারা সেটাই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে গেছে।    


শেয়ার করুন